ময়ূরী মিত্রের গল্প : টিয়া ক কথা
টিয়া ক কথা
মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল ... এদের মানেহীন হাসিতেই রয়েছে প্রাণ ৷ মানুষের মান ৷ জ্ঞান জ্ঞান শোনাবে বলে কিছু আর বললাম না ৷
একটি এসে বসল আমার ঠিক পাশে ৷ হাসছে ৷ ঝুঁটি নাড়াচ্ছে ৷ বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখতে চাইছে সব ৷ একসাথে কত কীই যে করে চলেছে মেয়েটা ৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম --তুই এক্কেবারে একটা পাখি ৷ আমার কোলের পাখি ৷ ওমা ! শোনা মাত্তর আমার কোল ঘেঁষে বসল ৷ তার ঠাণ্ডা ঘাম আমার চামড়া ছুঁল ৷
হঠাৎ দেখি, সে তার ঠিক সামনের সিটের পিছনের টিনের পাতকে কখন যেন আয়না বানিয়ে নিয়েছে ৷ আর সেই আয়নায় নিজের মুখটাকে নিয়ে নানা পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে ৷ বাঁকিয়ে ভেঙ্গিয়ে ৷ কখনো বা সাপের মতো জিভ লকলক করে ৷ নিজেই নিজের সুন্দর হবার পরীক্ষা নিচ্ছে ৷ তার চেয়েও আমার কাছে যেটি বড় কথা বলে মনে হয়েছিল --শিশুটি নিজের মুখে সৌন্দর্য অন্বেষণ করছিল এবং আবিষ্কার করে আনন্দ পাচ্ছিল ৷ আনন্দ ----
ওই দেখো আবার কী করছিস রে ? বারবার নিজের মুখ নিজেই উল্টোপাল্টা করে ফেলছে ৷ চামড়া কুঁচকে ভুরু তুলছে মাঝআকাশে ৷ আর তারপর সিটের আয়নায় নিজের আঁকাবাঁকা মুখ দেখে দুঃখে মলিন হচ্ছে ৷ কখনো রেগে চোখ রাঙাচ্ছে আয়নাকে ৷ আরো মুখ ভেঙাচ্ছে আপনার প্রতিবিম্বকে ৷ কতরকম অভিব্যক্তি যে সেসময় তার মুখে খেলল। একবার যদি খেয়াল করে দেখতেন উইকলি টেস্টের খাতায় ব্যস্ত মা ৷
ও মেয়ে চাররঙা লুডোর বোর্ডে ছক্কা পাঞ্জা পুট ফেলবি কতবার ? নিজেকে নিজের প্রিয় করার এ মিষ্ট খেলা শেষ করবি কখন ! একসময় স্কুল ব্যাগ খুলে টিপের পাতা থেকে সবথেকে ছোট্ট লাল টিপ গলায় এবং গালের যেখানে সেখানে বসাতে বসাতে লাগল ৷ নিশ্চুপ দেখেই যাচ্ছি ৷ মনে মনে বলা কথাগুলো আমার বন্ধ হয়ে কখন ৷ একসময় দেখলাম টিপটা সে কপালের মাঝেই বসিয়েছে ৷ বসিয়েই আকুলব্যাকুল এক হাসি ৷ অজানা কোনো এক সৌন্দর্য অনুভবের সফল এক হাসি ৷ মুখ ভরে হেসে বলল-- নাচের ফাংশনের জন্য মা কিনে দিয়েছে ৷
সে হাসিতে বাসের টিনের পাত হাসল | শত কিরণ ছড়াল শিশুর প্রসাধন ৷ নিজেকে দেখে বড়ো খুশি সে ৷তৃপ্ত বড়ো ৷
ঠাসস ---!
"কী করেছিস আজ খাতায় ? বাড়ি চল আজ ---! দেখাচ্ছি তোকে !"
মারমূখী মায়ের একটা চড়েই গালে একটা লাল চাকতি বসে গেছে বাচ্চাটার ৷ আচমকা চড় খেয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে ৷ টিনের আয়নার হাস্যমুখ দুফালা হচ্ছে ৷ চিরে যাচ্ছে চড়চড় করে ৷
মামনি একটু অপেক্ষা করলে পারতেন তো ! একবার ভাবতে পারতেন তো ... যে শিশু এত যত্নে নিজেকে সাজায়, মধুর আনন্দে ভরিয়ে দেয় অচেনা এক যাত্রীকে, পারলে সেই পারে গোটা জগতকে সজ্জিত করতে !
দার্শনিক উইল ডুরান্ট বলেছিলেন - জীবজগতের সব্বার আত্মসৌন্দর্য বোধ আছে ৷ থাকাটাই স্বাভাবিক বলে সাহেব বারবার যুক্তি দিয়েছেন ৷ ডুরান্ট প্রথমেই উদাহরণ এনেছেন পাখির -- যে কিনা গৃহস্থের ফেলে দেয়া রঙিন ফিতে, মুক্তহারের ছেঁড়া অংশ, চকচকে চাকতির টুকরো দিয়ে গাছের আড়ালের আবাসটি সাজায় ৷ উদ্দেশ্য বোধহয় --একঢালা সবুজের মাঝেও তার রঙিন বাসাটি যেন সবাই চিনে নয় ৷ সেক্ষেত্রে শিশুর নিজেকে সুন্দর করার স্বাধীনতা কি খুব অসঙ্গত? সেদিন এ প্রশ্ন উৎপাত করছিল আমাকে ৷
বেশি নয়, কেবল একটুখানি পাল্টা হাসি হাসুন ভাই ! বড় তৃষ্ণার্ত আমাদের শিশু ! খেলাটা চলুক ৷ অটুট দর্পণে ৷
তোমার এই লেখা সব মায়েদের পড়া দরকার শিশুদের কলোহাস্য মনকে রাঙিয়ে দেয় খুব সুন্দর লিখেছো তুমি ❤️❤️❤️
ReplyDeleteবড় সুন্দর এই লেখাটি। মামণিরা তো বোঝেনই না শিশুর ইচ্ছে কোন খাতে কোন প্রবাহে ভাসে।
ReplyDeleteঅসামান্য প্রাণবন্ত ও আন্তরিক লেখা।
ReplyDeleteসংবেদনশীল মন । সংবেদনশীল লেখা । শিশুর কাছে শিশু হতে পারো তুমি । সবাই পারেনা ।
ReplyDeleteসংবেদনশীল মন । সংবেদনশীল লেখা । শিশুর কাছে শিশু হতে পারো তুমি। সবাই পারে না ।
ReplyDelete