ভিনদেশী রূপকথা

 নাপিত ও রঙমিস্ত্রী



গল্পটি এক রঙ মিস্ত্রি আর এক নাপিতকে নিয়ে। তারা ছিল প্রতিবেশি। প্রতিবেশি মানে দু'জনের দোকান ছিল পাশাপাশি। রঙমিস্ত্রি মানে কাপড় রঙ করার কাজ যাকে ডায়িং বলা হয়।

এই মিস্ত্রির নাম ছিল আবু কির আর নাপিতের নাম ছিল আবু সাব্‌র। আবু কির ছিল খুবই ধুরন্ধর প্রকৃতির। যেমন ছিল মিথ্যাবাদি তেমনি ছিল প্রতারক। তবে রঙের কাজটা সে খুবই ভালো জানতো। ভালো জানলে কী হবে সে কিন্তু তার কাজটা প্রতারণার মধ্য দিয়েই করতো। সোজা বা সহজভাবে উদার মনোভাব নিয়ে করতো না। কেউ যদি রঙ করার জন্য তার কাছে কোনো কাপড় দিতো সে প্রথমেই তার মজুরিটা নিয়ে নিতো। তারপর বলতো: যাও! কাল এসে তোমার কাপড় নিয়ে যেও। কাস্টমার এ কথা শুনে চলে যেত এবং পরদিন তার কাপড় নিতে আসতো।

আবু কির তখন বলতো: গতকাল অতিথি ছিল সেজন্য কাপড়টা রঙ করে উঠতে পারি নি। এক কাজ করো, কাল এসো। কাস্টমার কী আর বলবে, চলে যেত এবং পরদিন আবার আসতো তার কাপড় নেয়ার জন্য। কিন্তু পরদিনও সে একইরকম আচরণ করতো। তরতাজা একটা মিথ্যা কথা সাজিয়ে কাস্টমারকে বিদায় করে দিত। রঙ করা কাপড় আর নেয়া হতো না। এভাবে কাল পরশু করতে করতে কাপড়ের মালিক ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে যেত। এক কাপড়ের জন্য কতোবার আসা যায়। অবশেষে কাপড়ের মালিক বাধ্য হয়ে বলতো: ঠিক আছে, আমার কাপড় রঙ করা লাগবে না, রঙ না করা আস্ত কাপড়টাই ফেরত দাও, নিয়ে যাই।

আবু কির তখন অদ্ভুত এক কথা বলে বসতো: ওরে ভাই আমার! কী করে যে বলি তোমাকে! লজ্জায় আমার মুখে কথা আসছে না। সাধে কি আর তোমাকে ঘুরাই। সেই প্রথম যেদিন তুমি কাপড়টা রঙ করতে দিয়েছিলে, সেদিনই আমি কাপড়টা রঙ করে রেখেছিলাম। কিন্তু দু:খজনক বিষয়টা হলো সেদিনই চোর এসে কাপড়টা চুরি করে নিয়ে গেছে। কাস্টমাররা তখন কী করবে! কেউ কেউ ঝগড়াঝাটি করতো কেউবা আবার চুপচাপ চলে যেত। মোটকথা ওই রঙ মিস্ত্রির দোকান থেকে প্রায়ই ঝগড়ার শব্দ শোনা যেত। এভাবে ধীরে ধীরে আবু কিরের বদনাম ছড়িয়ে গেল পুরো বাজারময়। তাই তার দোকানে রঙ করার জন্য কাস্টমারের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেল।

রঙের মিস্ত্রি আবু কিরের কথা তো শুনলেন, এবার চলুন আবু সাবরের কথা শোনা যাক। আবু কিরের দোকানে যখন কাস্টমার আসা বন্ধ হয়ে গেল সে তখন প্রায়ই আবু সাবরের দোকানে গিয়ে আড্ডা মারতো। বেচারা তো নাপিতের কাজ করতো। খালি চেয়ার দেখে বসে বসে পত্রপত্রিকা পড়তো, টিভি দেখতো আর আবু সাবরের দোকান ভালো করে খেয়াল করতো। এভাবে দিন কাটছিল তাদের। একদিন এক দাপুটে দুষ্কৃতকারী এলো সেই শহরে। আবু কিরের দোকানে সেই লোকটা কাপড় নিয়ে এলো রঙ করানোর জন্য। আবু কির সবসময়ের মতোই তার স্বভাব অনুযায়ী প্রথমেই তার মজুরি নিয়ে নিলো। তারপর বললো: আগামিকাল এসে তোমার কাপড় নিয়ে যেও।

অপরিচিত সেই দাপুটে লোকটি পরদিন এবং তার পরদিন, তারও পরদিন এলো। বেশ কদিন এভাবে এলো লোকটি কিন্তু আবু কিরকে দোকানে পেলো না। আবু কির যখনই দেখতে পেত লোকটি তার দোকানের দিকে আসছে তখন সে তার দোকান বন্ধ করে আবু সাবরের দোকানে গিয়ে বসে থাকতো মানে লুকাতো। এভাবে বেশ কয়েকদিন যাবার পর কাপড়ের মালিক শক্তিমান লোকটি বুঝতে পারলো যে আবু কির তাকে ধোঁকা দিয়েছে, তার কাপড়টি আর ফেরত দেবে না। লোকটা তাই সোজা চলে গেল শহরের আদালতে। কাজির কাছে আবু কির নামের ওই রঙের কারিগরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। কাজি মানে বিচারক ওই শক্তিমান লোকটির সঙ্গে পাইক-পেয়াদা দিয়ে দিলো যেন আবু কিরকে খুঁজে বের করে।

ওই পেয়াদারা লোকটির সঙ্গে গিয়ে পৌঁছলো আবু কিরের দোকানে। তার দোকান তন্ন তন্ন করে খুজলো। রঙ করতে দেওয়া কাপড় তো দূরের কথা এমন কোনো একটি জিনিসও পেলো না যা ওই কাপড়ের পরিবর্তে নেয়া যায়। অগত্যা পেয়াদারা আবু কিরের দোকানে তালা লাগিয়ে সিলগালা করে দিলো। চাবিটা হাতে নিয়ে আবু কিরের প্রতিবেশিদের বলে দিলো তারা যেন রঙ মিস্ত্রিকে বলে দেয়, দোকানের তালার চাবি পেতে হলে ওই দাপুটে লোকটার কাপড় যেন ফেরত দেয়। আবু কির কিন্তু আবু সাবরের দোকানে বসে সবকিছুই দেখছিল। বললো: কী করবো এখন! দোকানে তো সিলমোহর মেরে দিয়েছে।

আবু সাবর বললো: সব দোষ তো তোরই। মানুষের অর্ডারি কাপড় চোপড় জমা নিয়ে আর ফেরত দিস না।

আবু কির বললো: কাজের যে মন্দা অবস্থা, কী করবো!

আবু সাবর বললো: আমার কাজের অবস্থা কি ভালো নাকি! আমারও তো মন্দা যাচ্ছে।

আবু কির বললো: এক কাজ করি! চলো! আমরা দুজনই নতুন কোনো শহরে চলে যাই! ভাগ্য পরীক্ষা করি। দেখি খোলে কি না!

আবু কিরের কথায় পটে গেল নাপিত আবু সাবর। সুতরাং দুজনেই এই শহর ছেড়ে অন্য কোনো শহরে গিয়ে নতুন করে কাজ কারবার করার জন্য মনস্থির করলো। না না, মনস্থিরই নয় দ্রুত তারা পাড়ি জমালো। একসঙ্গে, নতুন কোনো শহরের উদ্দেশে।

(চলবে)

[সৌজন্যে: পার্সটুডে]

সংকলন ও সম্পাদনা: আদিব রায়হান

Comments

Popular posts from this blog

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা