আতনিন বিন জহির
আইনু কারা?
:
আইনুরা হলো পৃথিবীর এক বিপন্ন জাতিগোষ্ঠী। তারা জাপানের উত্তরাঞ্চলের হোক্কাইডো, কুরিল দ্বীপপুঞ্জ এবং রাশিয়ান সাখালিন ও কামচাটকা ক্রাই এর আদিবাসী। আইনুরা জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন এবং একমাত্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। মূলত জাপান একটি হোমোজেনাস বা সমজাতীয় মানবগোষ্ঠী অধ্যুষিত মানুষের দেশ, সেখানে জাপানিজরা জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ। সে দেশের আইনুদের উৎস, ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম এবং উত্থান-পতনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি।
উৎপত্তি:
আইনুদের উৎপত্তি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট নয়, তবে তারা হাজার হাজার বছর ধরে জাপানে বসবাস করছে। ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা যে তারা সাইবেরিয়া বা কোরিয়া থেকে জাপানী দ্বীপপুঞ্জে আসে। প্রায় ৪০০০০ বছর আগে জাপানে প্রথম পা দেয় এই জনগোষ্ঠীর মানুষ, এরা ছিল শিকারী ও সংগ্রহকারী (Hunter-gatherers), অর্থাৎ, যারা প্রাণী শিকার করে এবং ফল সংগ্রহ করে বেঁচে থাকার জন্য। শিকারি গোষ্ঠীগুলি এখন 'জোমন মানুষ' হিসাবে পরিচিত এবং জাপানের ইতিহাসের জোমন যুগের (14,000-300 BC) সাথে সংযুক্ত।
জোমন যুগে তারা মৃৎশিল্পের একটি বিশেষ শৈলী গড়ে তোলে। তারপরে সপ্তম শতাব্দীতে গড়ে ওঠে চাষ ভিত্তিক 'সৎসুমন' সংস্কৃতি এবং পঞ্চম শতাব্দীর দিকে গড়ে ওঠে মাছ ধরা ভিত্তিক 'ওহোটস্ক সংস্কৃতি'। এই দুটি সংস্কৃতি হোক্কাইডোতে মিলিত হয়ে আইনু সংস্কৃতি গঠন করে। আইনুরা শারীরিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে জাপানিজদের থেকে অনেক আলাদা।
[কয়েকজন আইনু জাতির মানুষ]
ভাষা:
আইনু ভাষা, আইনু বা আইনু ইতাক (Ainu-itak) নামে পরিচিত, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ভাষা যার কোনো পরিচিত ভাষাগত আত্মীয় নেই। (এটাও লক্ষণীয় যে জাপানীজ ভাষা, যা প্রোটো-জাপানীজ ভাষা থেকে এসেছে তাও একটি বিচ্ছিন্ন বা অ-শ্রেণিভুক্ত ভাষা যার পরিচিত ভাষাগত আত্মীয় নেই)। এটি জাপানীজ থেকে আলাদা এবং এই ভাষাটির জটিল রূপবিদ্যা এবং ধ্বনিবিদ্যা রয়েছে। আইনু ভাষা একটি বিপন্ন ভাষা--যেখানে দশ জনেরও কম লোক সে ভাষা ব্যবহার করে এবং এঁদের মধ্যে বেশিরভাগ আইনু ভাষাভাষীরা বয়স্ক, তার কারণ হচ্ছে আইনুদের বেশিরভাগ তরুণ প্রজন্ম জাপানীজ ভাষায় কথা বলে এবং জাপানীজ সমাজে আত্তীকৃত হয়ে যায়। আইনু ভাষার তিনটি উপবিভাগ রয়েছে। সেগুলো হল হোক্কাইডো আইনু, কুরিল আইনু এবং সাখালিন আইনু। দুর্ভাগ্যবশত হোক্কাইডো আইনুই আজকের দিনে টিকে রয়েছে আলাদ একটি ভাষা হিসেবে, কারণ কুরিল আইনু এবং সাখালিন আইনু দমনের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আইনু ভাষার কোনো নিজস্ব লিখিত লিপি নেই বরং তারা আধুনিক সময়ে তাদের ভাষা লিখতে জাপানীজ বর্ণমালার কাতাকানা এবং ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করে। আইনুদের নিজস্ব লোককথা বা সাগা (Saga) ছিল যেটা মৌখিকভাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম প্রবাহিত হয়েছিল এবং এগুলো ইউকার(Yukar) নামে পরিচিত ছিল। একটি ইউকার বলে যে আইনু জাতি কীভাবে সাখালিনের নিভখ (Nivkh People) আদিবাসিদেরকে বাস্তুচ্যুত করেছিল এবং সাখালিনে কিভাবে আরও বিস্তৃত হয়েছিল আইনু জাতি। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীতে, মঙ্গোল সাম্রাজ্য আইনুদের বিরুদ্ধে নিভখ জাতিকে সাহায্য করেছে। এই কারনে আইনুরা যুদ্ধ করেছে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা মঙ্গোলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এই ঘটনাটির জন্য আইনুরা আরও উত্তরে বিস্তৃত হতে পারেনি এবং এই ঘটনার পর আইনুদের সম্প্রসারণ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
[আইনুদের একটা বাড়ি]
ধর্ম :
আইনুদের ধর্ম হল অ্যানিমিস্টিক (Animistic) এবং বহুঈশ্বরবাদী, আইনু ধর্মে প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক ঘটনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আছে। আইনুরা দেবতাদের উপাসনা করে, এই দেবতাগুলো প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং কামুয় (Kamuy) নামে পরিচিত ছিল। যেমন রেপুন কামুয় (Repun Kamuy) হচ্ছে সমুদ্রের দেবতা, তকাপকাপ কামুয় (Tokapcup Kamuy) হচ্ছে সূর্যের দেবতা, কিনা সুত কামুয় (Kina-sut Kamuy) হচ্ছে সাপের দেবতা এবং কিমুন কামুয় (Kim-un Kamuy) হচ্ছে ভালুকের দেবতা। সব ক্ষেত্রেই কামুয় শব্দের অর্থ হচ্ছে দেবতা। আইনু জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ছিল লোমানতে (Lomante)।
লোমানতে একটি আইনু অনুষ্ঠান যেখানে একটি বাদামী ভালুককে বলি দেওয়া হয়। একটি ভালুকের শাবককে দড়ি দিয়ে একটি দণ্ডে বাঁধা হয়। গ্রামের পুরুষরা তখন তীর ছুঁড়ে শাবকটিকে আঘাত করে। বহু তীরের আঘাতে ভাল্লুকটি দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর, একজন গ্রামবাসী ভালুকের কাছে গিয়ে এটিকে মেরে ফেলে। ভাল্লুকের চামড়া ছড়ানোর পর এর মাংস গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এবং ভালুকটির পশম দিয়ে তারা একটি পুতুল তৈরি করে যা তারা পরে পূজা করে।
পতন :
আইনু জাতির পতনের কারণ হিসেবে উপনিবেশ স্থাপন, আত্তীকরণ, বৈষম্য এবং জোরপূর্বক সাংস্কৃতিক দমনসহ বিভিন্ন বিষয়কে জন্য দায়ী করা যেতে পারে। প্রায় ২৩০০ বছর আগে, ইয়ায়োই যুগের (300 BC–300 AD) সময় ইয়ায়োই (Yayoi) মানুষ জাপানি দ্বীপপুঞ্জে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। ইয়ায়োই জনগণ জাপানীজ জাতির পূর্বপুরুষ। ইয়ায়োই জনগণ জাপানী দ্বীপপুঞ্জে বিস্তৃত হতে শুরু করলে, তারা বর্বর উপজাতিদের স্থানচ্যুত করতে শুরু করে জাপানের উত্তরদিকে। এই বর্বররা ছিল আইনু এবং অন্যান্য সম্পর্কিত আদিবাসী জাতিদের পূর্বপুরুষ--যারা এখন বিলুপ্ত।
উদাহরণস্বরূপ, (Emishi) এমিশিরা হোনশু দ্বীপে আদিবাসী একটি পৃথক জাতিগোষ্ঠী ছিল কিন্তু তারা জিনগত এবং সাংস্কৃতিকভাবে আইনু জনগোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল, দুর্ভাগ্যবশত জাপানীজরা তাদের ভূমি জয় করার পর এমিশিরা ধীরে ধীরে আত্তীকৃত হয় এবং একাদশ শতাব্দীর মধ্যে তারা একটি বিলুপ্ত জাতিগোষ্ঠী হয়ে যায়। এমিশি শব্দটি (蝦夷) 'হইল' কাঞ্জি লিপি দিয়ে লেখা যার আক্ষরিক অর্থ "চিংড়ি বর্বর"। তারপর সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর কাছাকাছি, হোক্কাইডো দ্বীপটি জাপানীজদের হাতে এসে পড়ে এবং তারা মেইজি যুগে (Meiji Era) জাপান রাষ্ট্র হিসেবে সম্প্রসারণের সাথে সাথে আইনুকে মূলধারার জাপানীজ সমাজে আত্তীকরণ করার জন্য আত্তীকরণের নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল।
এই নীতিগুলির মধ্যে আইনু ভাষা, সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি আইনুর জমি ও সম্পদের বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নীতি এবং আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ফলে, আইনু জনগণ প্রান্তিকতা, সাংস্কৃতিক পরিচয় হারানো এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। অনেক আইনু সম্প্রদায় দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যায়, বাস্তুচ্যুতি এবং ঐতিহ্যগত জীবিকা যেমন শিকার, মাছ ধরা এবং জমায়েতের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, আইনু জনগণের মধ্যে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষা এবং পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের জন্য ও পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি আন্দোলন হয়েছে। ২০০৮ সালে, জাপানীজ সংসদ আইনু জনগণকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতির আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে, জাপানে আইনুর সংখ্যা ২৫০০০ এর নিচে এবং রাশিয়ায় প্রায় ১০০০ জন।
তথ্যবহুল সমৃদ্ধ নিবন্ধ
ReplyDeleteExcellent! Very informative.
ReplyDelete