অনিন্দিতা গোস্বামীর ধারাবাহিক উপন্যাস
অবাক পৃথিবী
প্রথম পর্ব
কার্পেটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ম্যাপ পয়েন্টিং করছিল রোরো আর লেখার টেবিলে বসে লিখছিল তার মা। হঠাৎ মেঝেটা যেন কেমন সরসর করে উঠলো, চমকে তাকালো রোরো, মা!
ঘাড় ঘুরিয়ে অরণ্যা দেখল ছেলের দিকে। রোরোর চোখে তখন ভয়, উত্তেজনা আর খুশি মাখামাখি। অরণ্যাও হাসলো ছেলের চোখে চোখ ফেলে, বলল, হ্যাঁ রোরো ভূমিকম্প! দেখ গ্লাসের জলটা এখনো কেমন কাঁপছে।
রোরো বলল,এসো এসো মা,এখানে এসে বসো,দেখো কেমন উড়ন্ত গালিচার মতো লাগছে। ছেলের ডাকে টেবিল থেকে নেমে এলো অনু তারপর দুজনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল মেঝের ওপর। ওমা এতো দারুণ ব্যাপার, মনে হচ্ছে তারা যেন শূন্যে ভাসছে,উড়তে উড়তে চলেছে ডানাওয়ালা গরুড়ের মত। মুহূর্তকাল, তারপরেই ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল অনু,বলল, এতক্ষণ ভূমিকম্প এক্ষুনি বারান্দায় গিয়ে শাঁখ বাজাতে হবে। তারপরেই নেমে পড়তে হবে রাস্তায়। রোরো যাওতো ঠাকুর ঘর থেকে শাঁখটা নিয়ে এসো।
রোরো দৌড়ে গিয়ে ঠাকুর ঘর থেকে শাঁখ নিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু গাল ফুলিয়ে সেটা বাজাতে লাগলো পুঁ পুঁ করে।
নানা দিক থেকে শাঁখ বাজছে। যেন সন্ধারতি শুরু হয়েছে অষ্টমী পুজোর। খুব দ্রুত হাতে কাজ গুছোচ্ছিল অনু। গ্যাসের সিলিন্ডার ভালো করে এঁটে দিল। ছেলেকে বলল রোবো বই খাতাগুলো ব্যাগের মধ্যে ভরে নাও আর বাবাকে ফোন করে বল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। তোমার বাবা কি রাস্তায় বসে থেকেও কিছু টের পাচ্ছে না! মায়ের তুমি বলা দেখেই ঘটনার গুরুত্ব আন্দাজ করতে পারছে রোরো। মা যখন কোনো কারণে উত্তেজিত থাকে তখন সবাইকেই তুমি বলে। তবে এর মধ্যে ফিক ফিক করে দুবার হাসিও পেল তার। এত ব্যস্ততার মধ্যেও মা কিন্তু রোরোর বই খাতা গুছিয়ে নেওয়ার কথা ভোলে নি।তারা গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের লোক, তেমন ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা তার আগে কখনো হয়নি। এমনকি তার মায়েরও না।মায়ের তেমন কোন গল্প থাকলে সে নিশ্চয়ই জানত। কারণ মা তাকে সব কথা বলে। তাই প্রাথমিকভাবে তার আর মায়ের দুজনেরই বেশ একটু আনন্দ হয়েছিল। কেমন একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সবকিছু কেমন ডিগডিগ করে কেঁপে উঠলো। কিন্তু তারপর এতক্ষণ ধরে যখন সেই কম্পন আর থামছে না মা ভয় পেতে আরম্ভ করল।ভয় মানে ভীষণ ভয়। টং করে তাক থেকে মায়ের মাথার ওপর পড়ল চায়ের কৌটো। রোরো কিন্তু এখনো তেমন একটা ভয় পাচ্ছে না। সে বাবাকে ফোন করতেই পল্লববাবু অবাক হয়ে বললেন, ওমা তাই নাকি! আমরা তো খোলা আকাশের নীচে চেয়ার পেতে বসে গল্প করছি, কই তেমন তো কিছু মালুম হচ্ছে না, তবে হ্যাঁ হ্যাঁ তুই বলার পড়ে সত্যিই তো মনে হচ্ছে কেমন যেন একটা নড়া নড়া কাঁপা কাঁপা ব্যাপার। আসলে এখানে জোর আড্ডা জমে ছিল তো টের পাই নি। বুঝতেই পারছিস উইকেন্ড বলে কথা।দাঁড়া,দাঁড়া ফিরছি, তোর মা কে টেনশন করতে বারণ কর।
ফোন রেখে রোরো টিভির সুইচ অন করলো। হ্যাঁ টিভিতে ব্রেকিং নিউজ,এই মাত্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে সারা ভারতে। রিখটার স্কেলে তার পরিমাপ করা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে কম্পন খুব মৃদু এখনই ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু এই ভূমিকম্পের বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘক্ষন ধরে চলছে এই কম্পন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন এরকম অভিজ্ঞতা অতীতে কখনও ভারতবর্ষে হয়নি, এমনকি সারা বিশ্বেও আর হয়েছে কিনা সন্দেহ। এটাই এবারের ভূমিকম্পের ব্যতিক্রমী চরিত্র। তবে আরও একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছে তা হল এত দীর্ঘ অঞ্চল ব্যাপী কম্পনের এই বিস্তৃতি।
চ্যানেলে চ্যানেলে শুরু হয়েছে বিশেষজ্ঞ ধরে আনার প্রতিযোগিতা। উদ্বিগ্ন জনতা জিজ্ঞাসা করছে কতক্ষণে থামবে এই কম্পন? বিশেষজ্ঞরা কিছুই বলে উঠতে পারছেন না, মাথা দুলোচ্ছেন, বিজ্ঞান ছেড়ে তারা এখন ফিলোজফি আওড়াচ্ছেন। বোধের অতিরিক্ত ও কিছু থাকে মানব জীবনে, বিজ্ঞানের দ্বারা তার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।
পৌরসভা থেকে রিক্সা করে চোঙা মাইক ফুঁকে পাড়ায় পাড়ায় গলিতে গলিতে বলে বেড়াচ্ছে বহুতল বাড়িগুলো ফাঁকা করে দেবার জন্য। রোরোর মা অরণ্যা চোখ মুছতে মুছতে ড্রেস বদল করছে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো রোরোর বাবা, আঃ,তুমি আবার এরমধ্যে সাজগোজ শুরু করলে নাকি! তাড়াতাড়ি বেরোও না, ওই দেখো সবাই বেরিয়ে গিয়েছে রাস্তায়। অরণ্যাও পালটা চেঁচিয়ে উঠলো আরে ঘরের পোশাক-আশাক পরে রাস্তায় বেরোনো যায় নাকি?
পল্লব জবাব দিল, তা তুমি এখন লিপস্টিক কাজল এসবও লাগাবে নাকি?
যদি লাগাই তোমার অসুবিধা আছে? ফোঁস করে উঠল অরণ্যা।তারপর নাক টানতে টানতে বলল,নিজে তো ক্লাবে বসে বসে গল্প করছিলে! আমি কীভাবে যে সব দরকারি জিনিসপত্রগুলো ব্যাগ আর সুটকেসে ভরেছি!নাও এগুলোকে আগে টেনে টেনে নিচে নামাও। এখনো দোতালায় আটকে থাকা বিপদজনক হয়ে উঠছে। আঁতকে উঠল পল্লব, এ্যাঁ! এতগুলো ব্যাগ এখন আমাকে নামাতে হবে?
অরণ্যা বলল, তবে কি করবে? সব নষ্ট করবে?আমার সাজানো সংসার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকবে? আমি প্রাণ থাকতে তা পারবো না।
এবার যেন কেমন কেমন একটু ভয় করছে রোরোর। সে তো জিওগ্রাফি প্রজেক্টে আর্থকুয়েক করেছে,বাড়িঘর সব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে,আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাত হচ্ছে, বিরাট ঢেউয়ের সুনামি রাক্ষসের মতো তেড়ে আসছে খেতে। রোরো বেরতে বেরতে টুক করে পড়ার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল তার ছোট্ট এফ এম রেডিও টা।
তাদের বাড়ির সামনে সাত নম্বরের মস্ত ফুটবল খেলার মাঠ।সেই মাঠের এককোণে বাচ্চাদের খেলার জন্য দুটো দোনলা আর একটা ঢেঁকি মানে সি'স আর অন্য কোণে একটা মস্ত মঞ্চ। পাড়ার সমস্ত অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রজয়ন্তী থেকে স্বাধীনতা দিবস সবটাই ওখানে হয়। তির তির করে দুষ্টু আনন্দটা বুকের ভেতর কাঁপছে রোরোর। ঐ মাঠের মধ্যে জড়ো হয়েছে পাড়ার সব লোকজন। হৈ হৈ কান্ড।কেমন একটা উৎসব উৎসব ব্যাপার। কই তাদের বাড়ি ঘর তো এখনো ভেঙে পড়ছে না।সকলে বলা বলি করছে যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে সব। 'পারে' এই ভয়েই যেন সবাই কাঁটা হয়ে আছে।
বড়রা কেমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে।এ কম্পন কখন থামবে কেউ বলতে পারছে না।টেলিকাস্টিং বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সারা শহরের এমন কি সারা দেশের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সময় বিদ্যুৎ থেকে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ধীরে ধীরে অনেকেই মাঠের উপর বাবু হয়ে বসে পড়েছে। রোরোও কিছুক্ষণ মায়ের পাশে বসল চুপটি করে।মনে হচ্ছে যেন কলার ভেলায় করে জলের ওপর ভেসে চলেছে তারা। দোলনা গুলো একা একাই দুলে চলেছে। দু একটা বাচ্চা সুযোগ পেলেই দোলনায় দুলে নিচ্ছে খানিক। কাউকে আর তাদের দোল দিতে হচ্ছে না। তবে বড়রা রিক্স নিচ্ছে না, ছুটে গিয়ে তাদের নামিয়ে আনছে দোলনা থেকে।
এবার রোরোর বেশ খিদে পাচ্ছে । সে ফিস ফিস করে মায়ের কানে কানে বলল সে কথা। অনুও মুখ নিচু করে রোরোর কানে কানে বলল, শোনো খাবার আমি কিছু গুছিয়ে এনেছি কিন্তু এত লোকের মধ্যে একা একা খাই কী করে আমরা? আবার এও তো ঠিক যদি এখন সবাইকে ভাগ করে দিয়ে দিই সব খাবার আর এই অবস্থা যদি চলতেই থাকে তবে তোর জন্য আমাকে খাবার তো অন্তত বাঁচাতেই হবে। তাই একটু ধৈর্য ধর। দেখ এরা কি করে। বলছে তো পুরসভা থেকে সবার জন্য খাবার ব্যবস্থা করবে। তা নয় তো হল কিন্তু এতক্ষণ ধরে অন্ধকারে বসে বসে ঘুম পাচ্ছে তার। আর ভালো লাগছে না। তার ওপরে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা। সবাই চটাস চাটুস করে মারতে মারতে এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো যে মনে হতে লাগলো কোনো অনুষ্ঠানের জন্য বুঝিবা ক্ল্যাপিং হচ্ছে। খানিকক্ষণ মশা মারার পর মায়ের কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল রোরো।
দারুণ লাগছে। মাঠের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রোরো মায়ের কোলে মাথা রেখে। যদিও পা লম্বা করতে পারছে না ভিড়ের জন্য কিন্তু তবু। ঘন কালো আকাশের গায়ে ফুটে রয়েছে অসংখ্য তারা। তারাগুলো সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। এতদিনে রোরো বুঝতে পারছে পৃথিবীটা সত্যিই ঘুরছে। আচ্ছা হঠাৎ করে কি পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগটা বেড়ে গেল? কেমন একটা অন্যরকম দিন আজ তাই না? একবার দুর্গাপুজোর সময় অঙ্কন প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী নির্ধারণ নিয়ে বাবার সঙ্গে ব্যানার্জি জেঠুর কী মনোমালিন্য! সেই থেকে দুই বাড়ির মধ্যে প্রায় কথাই বন্ধ। আর আজ ওই ব্যানার্জি জেঠু আর বাবা মিলে হাত ধরাধরি করে ছুটে বেড়াচ্ছে বাচ্চাদের জন্য খাবার জোগাড় করতে। রিংকি পিসি আর তানিয়া দিদি বসে ছিল তাদের মাথার কাছে। ওদের ফিসফিস করে বলা কথাগুলোও কানে যাচ্ছিল রোরোর। রিঙ্কি পিসি তানিয়া দিদি কে বলছিল দেখ তানিয়া মনামী সুযোগ বুঝে কেমন পুজোর ড্রেসটা পরেই চলে এসেছে! শুধু নিজেকে দেখানো, শো অফ। তানিয়া খুক খুক করে দুবার হেসে বলল আরে রণদীপদা বিদেশ থেকে ফিরেছে না, ঐ দেখ না নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে কেমন ওদের কাছে ঘুরঘুর করছে সেই থেকে। কিন্তু দেখ এইভাবে এখানে বসে বসে কতক্ষণ কাটবে? কোনো মানে হয় এইসবের? কিছুই তো হচ্ছে না। শুধু কেমন যেন মাটিটা সরসর করে গাড়ির মতো চলছে। আমরা তো বাড়ি ফিরে গেলেই পারি। এটা নিশ্চয়ই ভূমিকম্প নয় অন্য কিছু, ইস গানের ভেলায় অনুষ্ঠানটার আজ গ্র্যান্ড ফিনালে ছিল। মিস হয়ে গেল। রকি বলে ছেলেটা কী গাইছে রে, হেব্বি। রিঙ্কি বল, আর দেখতেও কী ফাটাফাটি বল?
খবর আছে, খবর আছে, রোরো দেখলো শৌণকদার চিৎকারে সব যে যার গল্প ছেড়ে সেই দিকে মন দিল। শৌণক সেই থেকে একটা ছোট্ট রেডিও কানে চেপে এদিক-ওদিক করছে।প্রথমদিকে সকলেই প্রায় ঘনঘন শৌণককে খবর জিজ্ঞাসা করছিলো। কিন্তু শৌণক ঠিকমতো কোন খবরই দিয়ে উঠতে পারছিল না। শুধু ক্রমাগত বলে যাচ্ছিল এক মিনিট। এক মিনিট টা কখন ঘন্টায় গড়িয়ে গেল। সকলেই বিরক্ত হয়ে খবর পাওয়ার আশা ছেড়ে দিল।বরং সকলেই উল্টে শৌণকের পিছনে লাগতে লাগল, কি শৌণক টাওয়ার পেলি? বিশুদা বলল এবার থেকে শৌণকের নাম হলো টাওয়ার কাটা।
বড় করে শ্বাস ছেড়ে গোবিন্দ দাদু বলল, এখন থেকে! হুঁ! আর থেকে! এখুনি তো সবার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়ে যাবে। পৃথিবী তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বালখিল্যের দল এখনও যে কী করে তোমাদের হাসি পায়! শৌণক দা বলল, দাদু ভয় কী, সকলে একসঙ্গে মরব এ-ও তো এক মজার। ঘাট নাড়তে নাড়তে গোবিন্দ দাদু বলল, মরার কাল আসেনি তো তাই মরাটাকে মজার বলে বোধ হচ্ছে । অবোধ, অবোধ। বলতে বলতে কাশির ধমকে খকখক করতে করতে উবু হয়ে বসে পড়লেন তিনি। সকলে জল টল খাইয়ে তাকে সুস্থ করল।
মঞ্চের ওপর থেকে এবার খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠলো শৌণক। পেয়েছি সত্যি টাওয়ার পেয়েছি, রণদা ছোট্ট একটা স্পিকারের সঙ্গে আমার এফএম রেডিও জুড়ে দিচ্ছে, সকলে সর্বশেষ খবর শুনুন। সুরেলা কণ্ঠ কিনকিন করে উঠলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরাই সর্বশেষ সংবাদ দাতা। এখুনি বন্ধ করে দিতে হবে আমাদের রেডিও স্টেশন। তবু প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমরা আপনাদের সর্বশেষ খবর জানাচ্ছি। না না এখন আমরা কোন বিজ্ঞাপন বিরতি নেব না। ধৈর্য ধরে আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন।
পাশ থেকে উসখুস করে উঠলো মা, উফ ভ্যানতারা কষতেই গেল মেয়েগুলো, অসহ্য, আসল খবর বল না। রোরো তো ধরমর উঠে বসেছে অনেকক্ষণ, সে মায়ের মুখে এমন ধরনের কথাবার্তা শুনে খানিক অবাক হয়ে গেলো। তার মা একজন অধ্যাপিকা শুধু নন, তিনি একজন রুচিশীল সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ এমনটাই জানে রোরো।বই মায়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী। রেডিওর ঘোষিকা বলছেন সর্বশেষ খবরে জানা গেছে যে এই ধরনের চলনের সন্ধান শুধু ভারতে না আরও অন্যান্য দেশে মহাদেশেও অনূভূত হচ্ছে।হ্যাঁ চলন।কম্পন নয়,বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন একে ওঁরা কম্পন বলতে রাজি নন। এটা চলন।এই চলন অস্বাভাবিক কিছু নয়, সবসময়ই এই চলন ঘটছে,বছরে এক থেকে ছয় সেন্টিমিটার বেগে আমাদের মহাদেশীয় পাতগুলো এগিয়ে চলেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে তো এই চলন বছরের দশ থেকে বারো সেন্টিমিটার পর্যন্ত কিন্তু এত বিপুল অংশে আমরা এই সামান্য বেগ অনুভব করতে পারিনা। যেভাবে অনুভব করতে পারি না পৃথিবী ঘুরছে। কিন্তু কোন কারণবশত হয়তো পাতগুলির এই চলন বেগ বেড়ে গেছে আর তাই তা আমাদের অনুভবের মাত্রা ছুঁয়েছে। এই অনুভবের মাত্রার সূচকও নির্ধারণ করতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সকলেই ব্যাপারটায় এত ভয় পাচ্ছেন যে কেউ আর নিজেদের কাজে মনঃসংযোগ করতে পারছেন না। অথচ দেখুন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের জন্য আমরা তুলে আনছি টাটকা খবর।বন্ধু ভয় পাবেন না, যেকোন রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে আমাদের সরকার প্রস্তুত। এই রবিন দা এবার আমাকে ছাড়ো, অন্য কোন আর জে কে ডাকো। আমার বুড়ো মা বাপ তো চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল। ওদিক থেকে একটা ভারী পুরুষ কন্ঠ শোনা গেল, আরে কাট কাট তোমার সব কথা শ্রোতারা শুনতে পাচ্ছেন। কিন কিনে গলা হঠাৎ মোটা হয়ে গেল,রাখুন তো আপনাদের শ্রোতাদের কথা,কেউ আর বাঁচেই থাকবো না তার আবার সেন্টারের সুনাম আর বদনাম। সবাই ঝাঁপ ফেলে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে আর আপনি এক আমাকে পেয়েছেন না? বলতে বলতেই কুঁ কুঁ করতে লাগল রেডিওটা। দৌড়ে এলো শৌনক, আবার কেটে গেছে রেডিওটা,দেখি আবার ধরতে পারি কিনা। ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একটা চেঁচিয়ে উঠলো আর তুমি ধরতে পেরেছ! সবাই পালিয়েছে তোমাকে খবর দেয়ার জন্য আর কি কেউ বসে আছে ওখানে? গোবিন্দ নস্কর ঘাড় নাড়তে নাড়তে উঠলেন মঞ্চে। বললেন, শোনো সবাই, শেষের দিন তবে আগত। সবাই যখন একসঙ্গে মরব মরবার আগে একটু প্রার্থনা করে নিলে হত না! যার যেমন ইচ্ছা, এই ধরো গীতা পাঠ কিংবা আজান দেওয়া।
পাড়ার কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা সব হৈ হৈ করে উঠলো, কী যা তা বলছেন দাদু,মরব কেন?কেউ কি বলেছে যে আমরা মরবো?ভাসছেন যখন ভাসুন না, ভাবুন না নোয়ার নৌকার মতো আমরা একটা নৌকায় উঠে বসে আছি সবাই। তরুণ তুর্কি দলের কথায় আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল সক্কলে।
রোরো দেখল মঞ্চের ওপর উঠে পাড়ার কাকু জ্যেঠুরা চারদিক থেকে বড় বড় টর্চ জ্বেলে শুকনো খাবার,এই কেক,বিস্কুট, মিষ্টি, পাউরুটি ভাগ করে দিচ্ছেন সবাইকে। রোরোর বাবা পল্লব মৈত্রও গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন সেই টিমে।দুধের প্যাকেটগুলো দাঁতে কেটে কাঁচা দুধই চুমুক দিয়ে খাচ্ছিল সকলে। দুধ ব্যবসায়ী গদাধর বক্সি বিনা পয়সায় সমস্ত দুধের প্যাকেট গুলো বিলিয়ে দিচ্ছেন সকলকে। দুনিয়ার যত কুকুর গরু সবাই এসে ভিড় করেছে মাঠের চারপাশ। কিন্তু ওরা বিরক্ত করছে না কাউকে। শুধু পাউরুটি বিস্কুট এর গন্ধ পেয়ে ঘনঘন ল্যাজ নাড়ছে কুকুরগুলো আর গরু গুলো থেকে থেকে হাম্বা হাম্বা বলে কিছু একটা জানান দিতে চাইছে। আহা অবলা জীব! বলে বিমলা মাসি ফোঁৎ ফোঁৎ করে দু'বার কেঁদে নিল। বিমল মাসির বাড়িতে ছিল ছয় খানা কুকুর। তারা সবাই এখন রাস্তায়। ইশ এত দামি বিদেশি কুকুর ষ্ট্রীট ডগদের সঙ্গে মিশে তাদের জাত ধর্ম সবই গেল।
আসলে কে যে কখন হাসছে আর কে যে কখন কাঁদছে তা বোঝা যাচ্ছে না। এতক্ষণ তবু একরকম ছিল, এক একটা মাঠে এক এক পাড়ার লোক জড়ো হয়েছিল। কিন্তু এবার দেখা গেল চর এলাকা থেকে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে উঠে আসছে সব লোকজন। গঙ্গার জল নাকি উথালি পাথালি করছে। এই মরেছে, পাড়ার সমস্ত মেয়ে বৌরা গুটিয়ে সংকুচিত হয়ে গেল নিমেষে। এরমধ্যে কোথায় থাকবে ওরা? কিন্তু রোরোর বাবারা বললেন, বিপদের দিনে কাউকে দূরে ঠেলা যায় না। মাঠের একদিকে ওদের জন্য কিছুটা জায়গা ফাঁকা করে দিতে হবে সবাইকে। হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো, যেন অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রোরোর মায়েরা।
জল কাঁপছে তবে কি সুনামি শুরু হলো? ভিড়ের মধ্যে কেউ একটা একথা বলতেই একটা ভয় ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। রোরোর মা অরণ্যা বলল,সে তো স্বাভাবিক, এতো হবারই ছিল। মহাদেশ কাঁপছে তবে মহাসাগরে তল কাঁপবে না? আর সেখানে কাঁপন হলেই তো ফুলে উঠবে জল। একথা বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠল চ্যাটার্জি দিদা। ওর ছেলে যে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, জাহাজ নিয়ে গেছে সাগর পাড়ি দিতে। আহারে, রোরোকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল রোরোর মা-ও।
(চলবে...)
চমৎকার
ReplyDeleteশুরুটা দারুণ -খুব ইন্টারেস্টিং...পরের পর্বের অপেক্ষায়
ReplyDeleteশুরুটা দারুণ �� পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
ReplyDelete