নাহার তৃণা'র গল্প
যদি এমন হতো
পিঙ্কির মনটা বেজায় খারাপ। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে আসার পর ওদের চুপচাপ বাড়িটা ওর হইহই’য়ে যেমনটা ভরে ওঠে; আজ সেরকমটা হয় নি। কারণ পিঙ্কির মনটা আজ সত্যিই খারাপ। স্কুল ফেরতা পিঙ্কিকে অনেকবার জিগগেস করেও মামণি উত্তর পান নি কেন ওর মন ভার।
চুপচাপ গোসল সেরেছে। এখন পিঙ্কি পড়ার টেবিলে বসে স্কুলের ঘটনাটা ভাবছে। নওরীন আজ ওরকম ব্যবহার কেন করলো ওর সাথে! কী এমন হতো, বইটা একদিনের জন্য যদি ওকে পড়তে দিতো? পিঙ্কি তো বার বারই বলেছিল বইটা পড়েই ফেরত দিয়ে দেবে। ইশশ! গল্পে তানিশা নামের ছোট্ট মেয়েটার কী হলো, বাকিটা জানার জন্য ওর ভেতরটা কেমন ছটফট করছে।
বইয়ের মলাটটা এত সুন্দর! যে কেউ বইটা পড়বার জন্য পিঙ্কির মতো অস্হির হবে। নওরীন কি পড়েছে বইটা? পড়ে বুঝলে তো ওরকম ব্যবহার করার কথা নয়! প্যাট জিয়েটলো মিলারের লেখা বইটার নাম ‘বী কাইন্ড’। অথচ কেমন নিষ্ঠুরের মতো নওরীন মুখের উপর বলে দিলো বইটা সে কাউকে দিতে রাজী নয়। একদিন তো অনেক দূরের ব্যাপার, পাঁচ মিনিটের জন্যও বইটা হাতছাড়া করতে তার আপত্তি।
পিঙ্কি জানে নওরীনের রাগ আছে তার উপর। অনেকগুলো প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে নওরীন। এদিকে পিঙ্কির কোনো টিউটর নেই। বাড়িতে নিজেই সে পড়াশোনা করে। কোথাও ঠেকে গেলে মামণি কিংবা বাবাইয়ের কাছে যায়। ক্লাসে বরাবর সে ফার্স্ট হয়। নওরীন চেষ্টা করেও পরীক্ষার খাতায় তাকে পেছনে ফেলতে পারে না। এ নিয়ে তার মনের রাগ মাঝে মধ্যেই সে প্রকাশ করে ফেলে। পিঙ্কি অতসব গায়ে মাখে না। বরং ক্লাসে গ্রামার কিংবা অন্য কোনো সাবজেক্টে নওরীন ঠেকে গেলে দেখিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না। ক্লাসের অনেককেই সে সাহায্য করে। সবার সাথে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে ভালোবাসে পিঙ্কি। সে কারণে ক্লাসের সবাই পিঙ্কিকে ভালোবাসে।
নওরীনের তাতেও রাগ। অন্যদের নিজের দলে টানবার জন্য প্রায় প্রতিদিনই সে কিছু না কিছু চমক স্কুল ব্যাগে ভরে নিয়ে আসে। ক্লাসশুদ্ধ মেয়েরা তাতে হইহই করে অংশ নেয়। প্রতিদিন নওরীনের আনা নিত্যনতুন মজাদার টিফিনের লোভে ক্লাসের কিছু ছোঁচা মেয়ে নওরীনের চারপাশে লোভী মাছির মতো ভনভন করে। নওরীনের মুখটা তখন অহঙ্কারে ডগমগ করতে দেখে পিঙ্কি। নওরীনেরা খুব বড়লোক। ইয়াবড় এক গাড়িতে চড়ে সে স্কুলে আসে রোজ। ওসব নিয়ে পিঙ্কির কোনো মাথা ব্যথা নেই। মায়ের যত্ন করে সাজিয়ে দেওয়া সামান্য টিফিন সে সোনামুখ করে খায়। ভালো ভালো খাবারের প্রতি বা অন্যসব জিনিসের প্রতি ওর লোভ হয় না। তাই ক্লাসের অন্যদের মতো চমক দেখার দলে অংশ নিলেও আহ্লাদে গলে না পিঙ্কি। চুলের পাথর বসানো ক্লীপ, ইউনিকর্ণের ঝকমকে স্টিকার বুক। তালাচাবিওয়ালা ডায়রি, ঝকমকে পুথির নেকলেস, ওসব টানে না তাকে। ক্লাসের অনেকেই ওসব দামী দামী জিনিস দেখে আহা উহু করে। মেয়েগুলোর চোখমুখে ‘আহা যদি আমারও অমন থাকতো’ ভাব ফুটে উঠতে দেখে নওরীন যে খুশি হয় সেটা ওর অহঙ্কারে ফেটে পড়া মুখ দেখেই বোঝা যায়। পিঙ্কির কখনও লোভ হয় না ওসবের জন্য। সত্যিই হয় না।
পিঙ্কির লোভের জিনিস অন্য কিছু। একসাথে ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়তে পড়তে নওরীনের যে সে খবর অজানা আছে তা তো নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পিঙ্কির যা পছন্দ নওরীনের আবার সেটা দুচোখের বিষ! খেয়েদেয়ে কাজ নেই চারপাশে এতশত গেমস, সাজুগুজুর জিনিস ফেলে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসে থাকবে। এমনটাই হাবভাব নওরীনের।
নওরীনের ফুপি ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন কিছুদিন আগে। প্রতিবারের মতো এবারও ওর জন্য নানা ধরনের উপহার এনেছেন। তার প্রায় সবটাই সে স্কুলে একেক দিন এনে দেখিয়েছে। আজ যেটা এনেছিল তাতে যে পিঙ্কির লোভ ষোলোয়ানা ঝিকিয়ে উঠবে সে ব্যাপারে নওরীনের খুব জানা ছিল। পিঙ্কিকে আচ্ছা মতো জব্দ করার উপায় পেয়ে ওর খুশিও বেড়ে গিয়েছিল। ফুপি খেলনা, ব্রেসলেট-নেকলেস চুলের ক্লীপ ইত্যাদি নানা উপহারের সাথে প্যাট জিয়েটলো মিলারের লেখা চমৎকার মলাটের একটা বইও এনেছেন ওর জন্য। সেটা আজ ক্লাসে নিয়ে এসেছিল নওরীন।
নওরীনের ফুপি ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন কিছুদিন আগে। প্রতিবারের মতো এবারও ওর জন্য নানা ধরনের উপহার এনেছেন। তার প্রায় সবটাই সে স্কুলে একেক দিন এনে দেখিয়েছে। আজ যেটা এনেছিল তাতে যে পিঙ্কির লোভ ষোলোয়ানা ঝিকিয়ে উঠবে সে ব্যাপারে নওরীনের খুব জানা ছিল। পিঙ্কিকে আচ্ছা মতো জব্দ করার উপায় পেয়ে ওর খুশিও বেড়ে গিয়েছিল। ফুপি খেলনা, ব্রেসলেট-নেকলেস চুলের ক্লীপ ইত্যাদি নানা উপহারের সাথে প্যাট জিয়েটলো মিলারের লেখা চমৎকার মলাটের একটা বইও এনেছেন ওর জন্য। সেটা আজ ক্লাসে নিয়ে এসেছিল নওরীন।
হলুদ ছাতার নীচে দুটো মেয়ের ছবিওয়ালা বইটা ব্যাগ থেকে বের করে নওরীন যখন তানিশা নামের মেয়েটার গল্প বলা শুরু করে; পিঙ্কি সব ভুলে লোভীর মতো বলে বসেছিল-- ভারী সুন্দর তো! বইটা একদিনের জন্য আমায় পড়তে দেবে নওরীন? দু’হাত ধাঁ করে পেছনে নিয়ে বইটা ওর চোখের আড়াল করে নওরীন কেটে কেটে বলেছে- কক্ষনো না! এই বই একদিনের জন্য তো দূরের কথা, পাঁচ মিনিটের জন্যও সে কাউকে দিতে নারাজ।
কী অদ্ভুত! বইটার নাম কি খেয়াল করেনি নওরীন? মন দিয়ে দেখেনি মলাটের ছবিটা? বৃষ্টি থেকে বাঁচাতেই তো ছাতাওয়ালা মেয়েটা যার ছাতা নেই তার মাথা ঢাকতে চাইছে-- ছবি দেখে আর বইয়ের নামটা পড়ে পিঙ্কি যতটা বুঝেছে তাতে অন্যের প্রতি দয়ামায়া দেখানোর গল্প আছে বইটাতে- তেমনটাই মনে হয়েছে পিঙ্কির। দয়ামায়া কী জিনিস সেটা তো না বোঝার কথা না নওরীনের! নিশ্চয়ই বইটা ঠিকভাবে পড়েনি এখনও। কিংবা খুঁটিয়ে নাম-ছবিটা দেখে ভাবনা চিন্তার সময় পায়নি। বেচারিকে প্রাইভেট টিউটরদের কাছে পড়বার জন্য তো চরকির মতো ছুটোছুটিতে থাকতে হয়। নিজের জন্য সময় আর পায় কোথায়! পিঙ্কির মনের ভারটা এসব ভাবতে ভাবতে কেটে যায় এক সময়। হোমওয়ার্ক সেরে গুটিগুটি পায়ে সে মামণির পাশে গিয়ে বসে।
মামণি সুইসুতোয় সুন্দর একটা বইয়ের শেলফ আর তাতে কিছু বইয়ের ছবি কী চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলছে। পিঙ্কির মামণিটা যে কত গুণী! কখনও কখনও মামণিকে ম্যাজিশিয়ান, কখনও সুপারও’ম্যান মনে হয় পিঙ্কির। একহাতে কত দিক যে মামণি সামাল দিতে জানে! ফ্রেমের এই কাজটা পিঙ্কির জন্য তৈরি করছে। গতকালই বলেছে মামণি। কাজটা প্রায় শেষের পথে। মায়ের হাত কী দ্রুত চলে! মুগ্ধ হয়ে দেখে সে।
পিঙ্কিকে কাছে এসে বসতে দেখে মামণি মিষ্টি করে হাসেন। কী রে মা, মন খারাপ ফুড়ুৎ হয়েছে?
কারো উপর মন খারাপ ধরে রাখতে নেই। মনটা হলো ম্যাজিক কার্পেট, ওটাকে সব সময় ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার রাখতে হয়।
কারো উপর মন খারাপ ধরে রাখতে নেই। মনটা হলো ম্যাজিক কার্পেট, ওটাকে সব সময় ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার রাখতে হয়।
ম্যাজিশিয়ানের মতো মা ওর মনের কথা বুঝে নেয় সব সময়। ভারী সুন্দর করে বোঝায়, কোনটা করা উচিত, কোনটা নয়। কত্ত কিছু জানে মা! মনের ভেতর যে প্রশ্নটা পুটুর পুটুর করছিল; এবার সেটা সে তার মা কে জিজ্ঞেস করে।
আচ্ছা মা, দাদুন একটা কথা ছোটকুকে প্রায় বলতো “টাকার কি গাছ আছে। ঝাঁকানি দিলেই ঝরঝরায়ে পড়বো”? মনে আছে?
আচ্ছা মা, দাদুন একটা কথা ছোটকুকে প্রায় বলতো “টাকার কি গাছ আছে। ঝাঁকানি দিলেই ঝরঝরায়ে পড়বো”? মনে আছে?
হা হা হা… খুব আছে। কেন রে টাকার গাছ লাগাবি নাকি?
না, না। টাকার গাছ নয়। লাগালে বইয়ের গাছ লাগবো। গাছ ঝাকালেই ঝরঝর করে যে বই চাও ঝরে পড়বে। সেরকম হলে কেমন মজা হতো বলো?
সত্যি খুব মজার হতো। কিন্তু এ কথা কেন ভাবছে আমার পিঙ্কি সোনা? কোনো বই পড়তে ইচ্ছে করছে বুঝি?
সত্যি খুব মজার হতো। কিন্তু এ কথা কেন ভাবছে আমার পিঙ্কি সোনা? কোনো বই পড়তে ইচ্ছে করছে বুঝি?
মাসের শেষে হুট করে যে যা খুশি আবদার করতে নেই, এটা পিঙ্কি অল্প বয়সেই শিখে গেছে। ম্লান একটু হেসে বলে:
সেটা একটু হয়েছিল। এখন আর নেই। স্বপ্নের গাছে বইটা ধরলে খপ করে পেড়ে নেবো।
কথাটা নিয়ে পিঙ্কি আর ওর মা একচোট খুব হাসাহাসি করে। মামণির হাতের কাজ শেষ হলে ওরা ম্যাপ খুলে রাজধানী খোঁজার খেলাটা নিয়ে বসে। পিঙ্কি এই খেলায় বেজায় দক্ষ। মজা পায় খেলে। মা তো ম্যাজিশিয়ান, ঠিক জানে কী করলে ওর মনটাকে একদম ঝকঝকে তকতকে করে তোলা সম্ভব।
কথাটা নিয়ে পিঙ্কি আর ওর মা একচোট খুব হাসাহাসি করে। মামণির হাতের কাজ শেষ হলে ওরা ম্যাপ খুলে রাজধানী খোঁজার খেলাটা নিয়ে বসে। পিঙ্কি এই খেলায় বেজায় দক্ষ। মজা পায় খেলে। মা তো ম্যাজিশিয়ান, ঠিক জানে কী করলে ওর মনটাকে একদম ঝকঝকে তকতকে করে তোলা সম্ভব।
রাতের খাওয়ার পর পিঙ্কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে। তাদের বাড়ির উঠোনে বইভর্তি একটা গাছ। পাগলা দাশু, কাটুম কুটুম, আবোল-তাবোল, ক্ষীরের পুতুল, টিনটিন, ছোট্টগোল রুটি, বাঙালির হাসির গল্প, অ্যা ফ্রেন্ড ফর হেনরি, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড, হঠাৎ রাজার খামখেয়ালী, বুদ্ধিমতী মাশা, দ্য রেইবো ফিশ, বী অ্যা ফ্রেন্ডের সাথে বেগুনি জামা গায়ের একটা মেয়ের হলুদে ছাতাধরা বই ‘বী কাইন্ড’!! বইটা দেখে খুশিতে আত্মহারা পিঙ্কি হাততালি দিয়ে ওঠে। গাছটার চারপাশ ঘিরে পিঙ্কির বন্ধুরা ‘ওই বইটা আমার চাই’, ‘এটা নেবো’, ‘ওটা দাও’এর হুল্লোড় তুলেছে। হাসিমুখে বন্ধুদের আবদার মেটাতে গাছ থেকে বই ছিঁড়ে ছিঁড়ে পিঙ্কি দুহাতে বন্ধুদের বিলাচ্ছে। সবার চোখে মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। সেই আনন্দ মাখতে মাখতে পিঙ্কি পাশ ফিরে শোয়।
ভারি সুন্দর গল্পটা।
ReplyDelete