মারজানা সাবিহা শুচির ভ্রমণ কাহিনী
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। রাজ্যের আসল উত্তরসূরি মগগালানাকে বঞ্চিত করে সিংহাসন দখল করে রাজা হলেন তারই ভাই কাশ্যপ, পরাজিত ভাই পালিয়ে গেলেন রাজ্য ছেড়ে। রাজা তো হলেন কাশ্যপ, মনে শান্তি নেই মোটে। এই বুঝি ভাই ফিরে এলো প্রতিশোধ নিতে, এই বুঝি সাধের প্রাণটা যায় যুদ্ধে! রাজা কাশ্যপ রাজধানী অনুরাধাপুরে থাকতে পারলেন না ভয়ে। চলে এলেন সিগিরিয়ায়, ৬৬০ফুট উঁচু সিগিরিয়া রকের উপরে গড়ে তুললেন রাজপ্রসাদ। এর আগে নানা সময়ে এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রম ছিল।
চারপাশে মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তীর্ণ বনভূমি, তার মাঝে সিগিরিয়া রককে ঘিরে গড়ে উঠলো নতুন রাজধানী । পাহাড়ের নিচে বিশাল চত্বরে রইলো সৈন্যব্যারাক, মিত্র-অপাত্যের থাকার বাড়িঘর, বাগান, পুকুর। পাহাড়ের বিভিন্ন ধাপে নানা রকম ঘর তৈরি করা হলো, এমন কি থাকলো প্রাকৃতিক সুইমিংপুল, ফুলের বাগান এবং দেব মন্দিরও। একদম চূড়ায় অনেকখানি সমতল জায়গা ছিল, সেখানে হলো রাজার খাসমহল। কী যে কাণ্ড রাজাদের!
এতো করেও অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। ভাইয়ের সৈন্যদলের হাতেই শেষপর্যন্ত প্রাণ যায় রাজা কাশ্যপের। রাজা হয়ে মগগালানা রাজধানী সরিয়ে নেয় অন্য জায়গায়। সিগিরিয়া রক ফিরে যায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হাতে।
সেই সিগিরিয়া রকের উপর উঠবো আমরা, মানে আমার মেয়ে বৈশালী, ওর বাবা আর আমি- আমরা তিনজন। কিন্তু এর সামনে পৌঁছে আমরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
ওরেব্বাস! এতো বিশাল, এতো উঁচু! পাহাড়ের গায়ে কোথাও চিকন চিকন লোহার সিঁড়ি বসানো হয়েছে, কোথাও বা সেই রাজার আমলের পাথর কেটে ধাপে ধাপে বানানো সিঁড়ি কিংবা লাল ইটের প্রাচীন সিঁড়ি । দূর থেকে এসব সিঁড়ি বেয়ে চলা মানুষগুলোকে পেঙ্গুইনের চেয়েও ছোট ছোট দেখাচ্ছিল। ভয়ে ভয়ে বললাম, না উঠলে হয়না? কিন্তু বৈশালী তো উঠবেই উঠবে, কাজেই এগোলাম সামনে।
মূল পাহাড়টাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন গোটাটাই এক বিরাট কালো পাথর। চারপাশে এখানে ওখানে আরো অনেক বিশাল বিশাল পাথর। পাহাড়কে ঘিরে পুরো চত্ত্বরে যে অনেক ঘরবাড়ি ছিলো তা নানা আকারের ভগ্নাবশেষ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একসময় এখানে রাজার সেনাসামন্তরা ঘুরে বেড়াত, এখন জমিদারী আয়েসে ঘুরছে বানরের দল। প্রচুর বানর। বাচ্চা থেকে বুড়ো, সব বয়সের। কয়েকটা মা বানর দেখলাম যাদের পেটের সাথে বাচ্চা ঝুলে আছে, কারো বা পিঠে বাচ্চা। একটা ছোট্ট বাচ্চা টুকটুক করে তাকালো আমাদের দিকে। বৈশালী বললো, কী কিউট! আমি একটা বানরের বাচ্চা পুষবো মা!
বানর যে কী জিনিস বুঝলাম আরো পরে!
শুরু করলাম সিঁড়ি বাওয়া। যে সব সিঁড়ির পাশে চওড়া পাঁচিল আছে, সেখানে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু যেখানে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নতুন করে রেলিং দেওয়া চিকন লোহা বা স্টিলের সিঁড়ি বসানো হয়েছে, আমার তো সেগুলোকে ভয়ংকর লাগছিলো।
ধাপে ধাপে বিভিন্ন কক্ষের ধ্বংশাবশেষের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি। একটু উঠতেই বেশ ফাঁকা একটা জায়গা, বসার মতো পাথর আছে অনেক। সেখানে দেখি এক বিদেশিনীর মাথায় পানি ঢালছে আর হাওয়া করছে তার সঙগীরা। ততক্ষণে আমরাও বুঝেছি সিঁড়ি বাওয়া কী কষ্ট আর আবহাওয়াটা কত্ত গরম! এমনকি , উপরে নানা জায়গায় যে পানির ট্যাংক বসানো, দেখলাম মাঝে মাঝেই একটা-দুটো বানর এসে ট্যাপের মাথা ঘুরিয়ে নলে মুখ লাগিয়ে আরামসে পানি পান করছে, গরমে অতিষ্ট হয়েই নিশ্চয়ই! আমি তো একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম, পানির ব্যবস্থা কি বানরকূলের জন্যেই, না দরকারে আমরাও একটু নিতে পারবো!
অনেক পর্যটক। ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সেই কঠিন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখলাম দুই শেতাঙ্গ বাবাকে। আর একটি পাঁচ-ছয় বছরের ইউরোপিয়ান বাচ্চাকে দেখলাম কান্না জুড়েছে, সে কিছুতেই সিঁড়ি দিয়ে উঠবেনা, সে কোলে উঠতে চায়। কিন্তু তার বাবা–মা বোধহয় তাকে সাহসী বানাবার ট্রেনিং দিচ্ছে, টানতে টানতে হাঁটিয়েই নিয়ে গেলো।
অনেকটা ওঠার পর, পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় একটা গুহা আছে। সেখানে সেই রাজা কাশ্যপের সময়কালের ছোট্ট একটি গুহামন্দির, যার গায়ে বেশ কিছু গুহাচিত্রও আঁকা আছে। একেবারে খাড়া পেঁচানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। এই অংশটুকু আমি সত্যি একেবারে চোখ বুঁজে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি ধরে উঠেছি। আমাদের মধ্যে বৈশালীকেই মনে হচ্ছে সবচেয়ে চনমনে। গুহামন্দির দর্শন করে ঠিক তেমনই আরেকটা পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলাম। পাত বসিয়ে চিকন পথ করে দেওয়া হয়েছে এক জায়গায়। মাথার উপর ঝুলে আছে ভীতিকর বিশাল পাথরখণ্ড। বুঝছিলাম না এতো চিকচিক শব্দ আসছে কোথা থেকে। বৈশালী হঠাৎ বলে, মা উপরে দেখো। তাকিয়ে দেখি শতশত বাদুর, তার অনেকগুলোই অনবরত নড়ে বেড়াচ্ছে। জায়গাটা তাড়াতাড়ি পার হয়ে আরেকটু উঠতেই দেখি বেশ বড় একটা খোলা চত্বর।
রাজপ্রাসাদের মূল প্রবেশ পথ এখান থেকেই শুরু, এই প্রবেশদ্বারকে বলা হয় লায়ন’স প’জ- সিংহেরথাবা। সিঁড়ির দুইপাশে সিংহের বিশাল দুইথাবা। এই থাবার জন্য সিগিরিয়া রকের আরেক নাম লারন রক। মাঝ দিয়ে উঠে গেলাম। এর পরের অংশটা খুবই ভীতিকর। লম্বা লোহার সিঁড়ি, একপাশে পাহাড় আরেক পাশে রেলিং, কোনো ভাবে পা ফসকে পড়লেই নিচের কঠিন পাথরে আছড়ে পড়ে প্রাণটাই যাবে! তা-ও উঠলাম কোনো রকমে।
নামার সময় হলো বিপত্তি। নামছি, হঠাৎ দুই-তিনটি বানর আমার পাশেই রেলিং-এর উপর থেমে গেল। তাকিয়ে আছে তারা আমার হাতের দিকে। আর মাঝে মাঝে আমাকে দাঁত খিঁচিয়ে হুমকি দিচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বলছে, যা আছে ভালোয় ভালোয় দিয়ে দে! এমন ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়েছি, নড়তেও পারছিনা। সিঁড়ি তো খুব চওড়া না, আমার দেড় হাতের মধ্যেই একটা বানর। একটু নড়লেই সে লাফিয়ে পড়ার ভাব করছে। চাইছে কী সে? আমার হাতে আছে পানির বোতল, মোবাইল আর পলিথিনের ভেতর বিস্কুটের প্যাকেট। বৈশালী আর তার বাবা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল, তারাও ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দুর্দশা দেখে ভয় পেয়ে গেল। ঠিক সামনের বানরটাকে হুশ হুশ করে ভয় দেখাতেই সেও উলটো খিঁচমিচ করে মুখ বেঁকিয়ে আমাকে ভয় দেখাল।
সিগিরিয়া রকে উঠতে ভয় করছিল যেমন, তেমনি খুব মজাও পেয়েছি আমরা। ইচ্ছা করে আবার যাই। ছোট্ট বন্ধুরা তোমরাও সুযোগ পেলে অভিযানে যেও সেখানে, নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। আর ইন্টারনেটে জায়গাটার অনেক ছবি আছে, দেখতে পারো।
বেশ রোমাঞ্চকর
ReplyDeleteভালো লাগলো
ReplyDelete