নিলয় নন্দীর গল্প


থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে




পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে পুলু একের পর এক ঢিল ছুড়তে থাকে পানিতে। কেন ছোড়ে সে নিজেও জানে না। একটা চ্যাপটা ঢিল পেলে না হয় ব্যাঙ-লাফ খেলা যেত। কিন্তু তেমন কোন ঢিল সে হাতের কাছে খুঁজে পায় নি । কেন যেন ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে সোয়েটারের লম্বা হাতাসহ হাতটা পানিতে ডুবিয়ে দেয়। খুব ঠাণ্ডা লাগুক তার, জ্বর হোক, মরে যাক। তাহলে মা’র ভালো একটা শিক্ষা হবে। মায়েরা সব এমন হয় কেন?কী হয়েছে খোকা? কাঁদছ নাকি?

পুলু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। সেই অদ্ভুত লোকটা তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু ভয় ভয় লাগে তার। এক দৌড়ে কি বাসায় ফিরে যাবে সে? লোকটা গায়ের চাদর ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে আবার হাসে, মন খারাপ? আমি কিন্তু মন ভালো করার ওষুধ জানি।

কী ওষুধ?

বাহ! এই তো কথা ফুটেছে মুখে। লোকটা পাশ থেকে একটা ঢিল কুড়িয়ে নেয়। ব্যাঙ-লাফ খেলছিলে তো? আমি এই খেলা শিখেছিলাম আমার এক চাচার কাছ থেকে। উনি এক ঢিলে দশবার পর্যন্ত জাম্প দিতে পারতেন।

হাতের ইটের টুকরোটা ছুড়ে মারতেই সেটা পুকুরের পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে সামনে ছুটে চলে। পুলু গুনে দেখল মোট ছয়বার লাফ খেয়ে তবেই ঢিলটা পানিতে ডুবল।

এসো, এই ঘাটের পাশে বসি। দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে। লোকটা শান বাঁধানো বেঞ্চের ওপর গিয়ে বসে। দেখ, আকাশের পাখিরা কীভাবে ঘরে ফিরছে। মানুষ কিন্তু চাইলেই এভাবে ঘরে ফিরতে পারে না। তাদের অনেক বাধা।

মানে কী?

লোকটা আবার হাসে। দেখ না, আমি বাসা থেকে বেরিয়েছি সেই মে মাসে। এখন ডিসেম্বর মাস পড়ে গেল। কখন বাসায় ফিরব এখনও জানি না।

বাসায় ফিরতে কী সমস্যা?

লোকটা পুলুর মাথায় হাত রাখে। আব্বাকে না বলে বাসা থেকে বেরিয়েছি। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি ঠিকই কিন্তু মা কি আর আসতে দেয়?

পুলু অবাক হয়ে তাকায়, কোথায় যাচ্ছেন আপনি? বাসায় কেন ফেরেন নি?

দেশ স্বাধীন হলে তবেই ফিরব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মাকে না দেখে আর থাকা যাবে না। তাই এবার বাড়ির পথ ধরেছি। আচ্ছা, তুমি মাকে না দেখে কতদিন থাকতে পারবে, বলো তো?

আপনি মুক্তিযোদ্ধা? পুলু চাপা বিস্ময় নিয়ে হেসে ওঠে।

হ্যাঁ, তুমি এর আগে মুক্তিযোদ্ধা দেখনি? তোমাদের এই গ্রাম থেকেও তো অনেকে যুদ্ধে গেছে বলে জানি। তাদেরকে তুমি আগেও দেখেছ।

তা দেখেছি। মাথা নাড়ে পুলু। তবে তারা এখনও বাড়িতে ফেরে নি। আপনি কি আবারও যুদ্ধে চলে যাবেন?

হ্যাঁ, ফিরতে তো হবেই। তোমার আব্বার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল বছর দুয়েক আগে, ঢাকার একটা লঙ প্লেয়ারের দোকানে। উনি তো কমলা ঝরিয়া, সায়গল, আক্সগুরবালা এঁদের গানের ভক্ত। আমি অবশ্য সবই শুনতাম। অনেক আলোচনা হয়েছিল গান নিয়ে। আজ ফিরবার পথে তোমাদের বাড়ির এই ঠিকানাটা মনে পড়ল। মনে হলো একটু বিশ্রাম নিয়ে যাই। অনেক রেকর্ড তোমার আব্বার সংগ্রহে। কিন্তু কি কান্ড দেখ, প্রাণ খুলে রবীন্দ্রনাথের গানও শুনতে পারবেন না!

লোকটা মাথার ওপর দিকে তাকায়। কি অবাক লাগে জানো খোকা? এত বড় আকাশ মাথার ওপর, কিন্তু সেই আকাশ যেন আমাদের নয়। একটা পরাধীন দেশের কিছুই আপন নয়। যেদিন যুদ্ধ শেষ হবে, সেদিন সব নিজের বলে মনে হবে।

পুলু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এটা আবার কী কথা?

লোকটা পুলুর কাঁধে হাত রাখে। নিজের মা আর মাটির ওপর বিশ্বাস রেখ। আজ নয় কাল যুদ্ধ শেষ হবে। এর পরের যুদ্ধ তোমাদের হাতে।

লোকটা উঠে দাঁড়ায়, মা বকলে মন খারাপ করতে নেই। মা কি কখনো খারাপের জন্য বকে?

চলে যাচ্ছেন? এখনই?

হ্যাঁ, আবার দেখা হবে খোকা। আমি তোমার আব্বার রেকর্ডের গান শুনতেই আবার একদিন আসব। লোকটা পূব পাড়ার রাস্তা ধরে এগোয়। এক সময় মিলিয়ে যায় আধো অন্ধকারে।

পুকুরের ওই পাড়ের লেবু বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকে পুলু। জমে থাকা অন্ধকারে একটু একটু করে জেগে উঠেছে জোনাকি পোকার দল। থোকায় থোকায় আলো জ্বালিয়ে তারা কী সুখের সন্ধান করে, কে জানে? তবু সন্ধ্যার এই অন্ধকারটুকুকে বড় ভালোবেসে ফেলে সে। মনে হয় মায়ের চেয়ে আপন আর কেউ নেই।










No comments:

Post a Comment