কীর্তিনাশা নজরুলের গল্প

 পাতকুয়া



 
ঝিম ধরা গ্রাম্য দুপুরে নির্জন এক বাগানে রাসেল একা একা লাকড়ি কুড়াচ্ছে। কাছেই লতা-গুল্মে ভরা এক জায়গায় অতি প্রাচীন এক পরিত্যাক্ত পাতকুয়া। বহুকাল হয়ে গেছে এ কুয়া কেউ ব্যবহার করে না। গ্রামে এখন বাড়িতে বাড়িতে টিউবওয়েল বসে গেছে। তাই পাতকুয়ার খবর এখন আর কে রাখে ?রাসেল গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর লাকড়ি জমাচ্ছে। এমন সময় সেই প্রাচীন পাতকুয়ার ভেতর থেকে কেমন খল-খল, ছড়-ছড়, ঘড়-ঘড় আওয়াজ উঠলো। রাসেল কান খাড়া করে শুনে বোঝার চেষ্টা করলো আওয়াজটা কিসের। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলো না। ওদিকে আওয়াজটা আরো জোরালো হচ্ছে। রাসেল এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আর তাকিয়েই ভয়ে জমে গেল। কুয়ার মুখে একটা বুড়ো মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে। মাথায় তার খানিকটা লম্বা সাদা ভেজা চুল। দু’হাত দিয়ে সে কুয়ার দেয়াল ধরে ঝুলে আছে। মুখে তার কেমন যেন হাসি লেগে আছে। বুড়ো লোকটা গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে – ও মিয়া ভয় পাইলা নাকি ? ভয় পাইয়ো না। আমি দূর দেশে থাকি। এদিকে ঘুরতে আইসা ভুল কইরা কুয়ার মইধ্যে পইড়া গেছি। কাছে আইসা আমারে ধইরা একটু উঠাও দেখি ! রাসেল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে – আপনের চুল এমন সাদা আর লম্বা কেন ?
 
বুড়ো বলে – ওরে ভাই, আমার বয়স হইছে তাই চুল সাদা আর অনেক ‍দিন চুল কাটতে পারি না তাই লম্বা।
রাসেল আবার প্রশ্ন করে – আপনের চক্ষু এমন লাল কেন ?
বুড়ো – অনেক ক্ষণ ধইরা পানিতে পইড়া আছি তো এই জন্য চক্ষু লাল।
রাসেল – আপনের দাঁত এমন কালা কেন ?
বুড়ো – আগে অনেক পান খাইতাম। পান খাইতে খাইতে এই অবস্থা।
রাসেল – আপনের মুখের চামড়া, হাতের চামড়া এমন সাদা সাদা কেন ?
 
বুড়ো এবার বিরক্ত হয় – ওরে ভাইরে ! একটা বুড়া মানুষ কুয়ায় পইড়া গেছে । তোমার মতো জুয়ান পোলা, কোথায় তুমি তারে উঠতে সাহায্য করবা তা না একশো প্রশ্ন করা শুরু করছো।
রাসেল কুয়ার দিকে দু’কদম আগায়। তারপর আবার থমকে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে – কুয়ার নিচ থিকা এতদূর উঠতে পারলেন আর এইটুক উঠতে পারতাছেন না ?
 
বুড়ো আরো বিরক্ত হয়ে বলে – নিচ থিকা তো চার হাত-পাও দিয়া কুয়ার দেওয়ালের ইট বাইয়া উইঠা আসছি। এখন এইটুক তুমি না উঠাইলে তো ওঠার সাধ্য নাই।
 
রাসে আরো দু’কদম এগিয়ে যায়। বুড়ো মানুষটা কুয়ায় পড়ে গেছে তাকে না ওঠালে কেমন হয় বিষয়টা ? কিন্তু কোন এক শঙ্কায় সে আবার থমকে দাঁড়ায়। তাকে থমকে দাঁড়াতে দেখে বুড়ো এবার চরম বিরক্ত হয় – দুরো মিয়া ! তুমি তো দেখি মহা ভিতু। একটা বুড়া মানুষরে সাহায্য করতে এতো ডর তোমার ? চাইর হাত-পায়ে আর কত সময় ঝুইলা থাকা যায় ? তার থিকা যাই আবার পানিতেই ডুইবা থাকি।
রাসেল প্রশ্ন করে – পানিতে ডুইবা থাকি, মানে ?
 
বুড়ো এবার রেগে খেকিয়ে ওঠে – হ, একশ বছর ধইরা কুয়ার পানিতে ডুইবা আছি। আর ডুইবা থাকতে থাকতে অভ্যাস হইয়া গেছে। এখন আর অত খারাপ লাগে না। তয় আইজকা তোমারে দেইখা ভাবছিলাম, তুমি একটু উঠাইয়া দিলে বাইরের দুনিয়াটা ঘুইরা দেখুম। কিন্তু তা তো আর হইবো না তোমার মতো ভিতুর লাইগা।
এবার রাসেল আর দেরী করে না। আতঙ্কে ভূত ভূত বলে চিৎকার করে উল্টো দিকে ঘুরে দৌড় শুরু করে। বুড়ো স্বগোতোক্তি করে বলে – ধুর! মানুষগুলা এতো ভিতু! একটা বুড়া লোকের দুঃখ বোঝে না। কিছুদিন আগে একটা মেয়ে আইসা এইখানে কানতে ছিলো – আমার বাপ নাই, মা নাই, দুনিয়ায় আমার কেউ নাই বইলা। আমি কুয়া থিকা উঁকি দিয়া কইলাম, থাউক কাইন্দো না। আমার লগে কুয়ায় আসো। দুইজন মিলা কুয়ায় ডুইবা অনেক গল্প করবো। ও মা ! সেই মেয়ে ভয়ে কান্দা বন্ধ কইরা দিলো দৌড়। আজকে আবার এই পোলারে কইলাম কুয়া থিকা উঠাইয়া দিতে। সেও দিলো ভয়ে দৌড়। হায় রে ! ভূত হইলেও তো আমি মানুষ ভূত। আমারে বোঝার মতো কেউ কি নাই এই দুনিয়ায় ?!

বুড়ো ভূত লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর কুয়ার মুখ থেকে তার মুখ, দু’হাত অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে পাতকুয়ার অনেক নিচে পানিতে আওয়াজ হয় – ঝপাস !

No comments:

Post a Comment