ময়ূরী মিত্রের গল্প

মা নৌকোয় খুকু মাঝি 









নৌকায় দুলতাম ৷ জল বাজাত বাজনা --ছলাৎ ছলাৎ ৷ বর্ষাজলে ভরা আমাদের বেলগাছিয়া বাড়ির সেই গলিপথ ৷ আমায় কোলে নিয়ে সে জল পারাপার করছেন মা - পাছে স্কুলের জুতো মোজা না ভিজে যায় ৷

নদী দেখা তখনো হয়নি আমার ৷ দেখা হয়নি একটি পূর্ণ --অহর্নিশি বয়ে যাওয়া জলরাশি ৷ জলযানের চলাচল ৷ তাই বর্ষার জল নামলেই ভাড়াবাড়ির ঐ গলিটাই হয়ে যেত আমার নদী ৷ হয়ে যেত চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতেই ৷

ধরুন - বেলাবেলি আকাশ মন করেছে জল ঝড়াবে ৷ আর আমি চোখ বুজে ঘাপটি মেরে আছি কখন আমার চলার রাস্তাটি হয়ে উঠবে নদী ৷ আমি বলতাম গলিনদী ৷ আমার বয়সী খুকুরা রাস্তায় জল জমলে কাগজের খেলনা ভাসাত ৷ আর আমি মায়ের কোলে চড়ে জলরাস্তা পার হতে হতে মাকেই ভাবতাম নৌকা ৷

সেসময় মায়ের কোলে চড়ার স্টাইলটাই বদলে যেত আমার ৷ দু’পা ছড়িয়ে দিতাম মায়ের মাংস পেটের দুপাশে ৷ আর লালরঙা পিঠে সমানে চাটিয়ে যেতাম দুহাতের তেলো দিয়ে ৷ আমার হাত বৈঠা আর আমার দাঁড় টানা ৷ যদি পড়ে যাই ---- পিঠে লাগা সত্ত্বেও মা হজম করতেন আমার মারকাটারি দাঁড় টানা ৷ গলি যত শেষ হতো, শুকনো পথ যত কাছে আসত, মায়ের পিঠে দাঁড়ের পিটুনি বাড়ত ৷ বাড়তে বাড়তে চরমে উঠত ৷ বোধহয় নদী ফুরিয়ে আসার রাগে ৷

একদিন ৷ একদিনের কথা বেশ মনে আছে আমার ৷ প্রবল বরষা ৷ গলিনদীটি আমার লম্বা হয়ে হয়ে বড়ো রাস্তা ছাড়িয়েছে ৷ কোলে নিয়ে আর আমায় টানতে পারছিলেন না মা ৷ পিটি পরীক্ষা বলে কোল থেকে নামতেও পারছিলাম না ৷ নামলেই পিটির স্পেশাল জুতো ভিজে যাবে যে ৷ আমাকে বওয়া থেকে নিস্তার আর জুটছিল না মার ৷ ফোলা শরীর গুচ্ছের ঘাম ছড়াচ্ছিল ৷ হাঁফ ধরছিল মায়ের - ব্যথা জাগছিল আমার ৷ কোলে বসেই হাত বাড়িয়ে গলিপথের ধারে দেয়াল ফেটে বাড়তে থাকা গাছ ডাল,কখনো বা একটুকরো বেগুনি ফুল গুঁজে দিতে লাগলাম মায়ের মাথায় ৷ বর্ষার জল পেয়ে ভাড়াবাড়ির দেয়ালের খাঁজে ভাঁজে কত না পাতা লতা ডাগর হয়ে উঠেছিল সেদিন ৷ সাজাতে সাজাতে মায়ের কালো চুল ঢেকে যাচ্ছিল সবুজে ৷ আর সেই অগুনতি সবুজে কী বাহারই না খুলেছিল মার ইষদ পাতলা চুলে ৷

সেদিন মায়ের পিঠে দাঁড় টানা বন্ধ রেখেছিল খুকু মাঝি ৷ মাঝি সেদিন কেবল সাজিয়ে চলেছিল তার নৌকাটিকে ৷ খুকুমাঝি আর তার মা-নৌকা ! ওরে এ যে আমার মননৌকো।

সবুজে চুলবুল ! নধরকান্তি !







মেয়েটা খলিফা ৷ খলিফা আমার ছাত্রী ৷ সে মানসিকভাবে একটু অসুস্থ ৷ দারুণ পরিপাটি সেজে --নিয়মিত নড়বড়ে হাতেই ইস্ত্রি চালিয়ে নিপুণ ভাঁজে সৈন্যনীল স্কার্টটি পরে স্কুলে আসে খলিফা ৷ খাতা ভর্তি ঠিক আর ভুলের বাংলা হরফ সাজিয়ে এমন এক মেজাজি হাসি হেসে খাতাটি সে এগিয়ে দেয় --মনে হয় বাংলা ভাষাটার এমনই "বেভুল" হওয়ার কথা ছিল এবং আমাদের মতো দারুণ মূর্খের মাঝে বাংলা ভাষার এই নিজস্ব ধারাটা নিজের মতো করে বয়ে চলেছে খলিফা ৷ ভুল করে যখন কানমোলা খেল তখনো তার মুখের চালিয়াতি ভাব আপনি মুছে ফেলুন দেখি ! পারবেনই না ৷---" গাছে সবজি উঠেছে " বা " মাঠে বিড়াল ফোটে " --এসব লিখেও আমাদের খলিফা বিচলিত নয় ৷ বরং রাজসিক ----৷ তার চোখ তখন বলছে --এটাই তো হবে তাই না আন্টি ! এতদিন কী ভাবে তোমরা ভুলে থাকতে পারো আন্টি --" মাঠে বিড়াল ফোটা কিংবা আকাশে রোদ ওড়া ?

মিঠে ভুলের গুল সাজিয়ে আমার মন হরণ করেছে এই ছাত্রী ৷ তাই তার নাম দিয়েছি খলিফা ৷ কত লিখেছি খলিফার গল্প ৷ কিন্তু প্রতিবারই নতুন ভূমিকার দাবীদার খলিফা ৷ তার প্রতিদিনকার বাংলা নতুন --নতুন বাংলায় সেও নতুন -- আগের দিনের থেকে ভিন্ন ৷ কোনোদিন তার লেখনীতে বাক্যরচনা হয় --বৃষ্টি পট করে খসল তো পরের দিন সেই বৃষ্টিই হাসল ৷ অর্থাৎ খলিফা বাক্যরচনা করল --বৃষ্টি হাসল আন্টির কানে ৷ বলল ---আন্টি তুমি দুটো শব্দ দিয়েছিলে বাক্যরচনায় ৷ আমি একটা বাক্যে দুটো শব্দ বসিয়েছি --বৃষ্টি ও হাসল ৷ তুমি খুশী তো আন্টি ? এক দুকামরার ক্লাসঘরে বসে বৃষ্টির সাথে চাষীর খুশি তুই কী দেখতে পাস খলিফা ! বল না আমাদের !!

খলিফা --আমার খিলি পান ৷ যত চিবোই তত রসে ভরে আমার জিভ তালু ঠোঁট ভরে যায়।৷ খলিফার সাথে শব্দ খুঁজি --খুঁজে পাই -আমার মনখারাপ কদম হয়ে যায়৷ আজ খুব বিষাদ ভটভট করছিল আমার মধ্যে ৷ বললাম --খলিফা আমি যদি মরি ? খলিফা খাতায় লিখেছিল ৷ শরীর ঝাঁকিয়ে বলল --না ৷ হয়ত তার শরীরটা আপনা হতেই ঝেঁকে গেল ৷ বর্ষা শেষে গাছের ডাল নাড়লে যেমন জল পড়ে অমনটাই কি ঝাঁকি খেলে খলিফা ৷ সব শব্দ ভুলে সে বলে উঠল --আন্টি মানে মা ৷ তুমি মরবে না কিছুতেই ৷ আমি একা হয়ে যাব ৷ তার থেকে নতুন ও পাকা পাকা শব্দ বের করার আশায় বললাম --আমি মা তাহলে বড়দি ( স্কুলের হেড দিদিমণি ) কে ? ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল --কাকিমা ৷ আমি বললাম --বাহ আমি মা আর বড়দি তোকে এত ভালোবাসেন উনি কাকিমা ? খিলি পান আজ তোর শব্দ এত কম পড়ে কেন রে ?

আকুল গলায় খলিফা বলে ---কাকিমাতেও তো মা শব্দ আছে আন্টি ৷ দেখো আন্টি --কাকিমা মাসিমা জেঠিমা সব শব্দে কেমন মা ঘুরছে ৷ ঘরময় ঘুরে ঘুরে শব্দগুলো আবৃত্তি করে খলিফা আর নিজের উচ্চারিত মা ধ্বনি শোনে ৷ আমরা অবাক তাকিয়ে আর ভ্রূক্ষেপ না করে চরকি কাটছে খলিফা ৷ এই --এই খলিফা বারবার মা মা আর্তনাদ করে তুই কি নিশ্চিত হতে চাইছিস ?

হ্যাঁ রে আমার খিলি পান --সব শব্দে মা ৷ শব্দটাকে টক্কাস করে মুখে পোর -- যাতে কখনো সে না পালায় ৷ মাঝে মাঝে রব দিস রে ৷ সে রব শুনে ধরণী বলবে -- এইও ! খলিফা এসেছে তার মা নিয়ে --- রক্ত এবার তুমি জীবনপাখি হও ৷










Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা