লুনা রাহনুমার গল্প

বন্ধু কুটুম




আনিকার মন ভালো নেই। সারাদিন স্কুলে অনেক ধকল গিয়েছে। একটার পর একটা ক্লাস। খেলার সময় থাকে অনেক অল্প। তার উপর আজকেই একসাথে তিনটি ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে। ইংরেজি আর ভূগোলে পাশ করলেও অংকে ডাব্বা মেরেছে। ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠার সময় স্কুলের হেড আপা বারবার করে বলেছে, “ফোরে উঠে যাচ্ছ কিন্তু তুমি, এখন তোমাকে লেখাপড়ায় আরো অনেক মনোযোগ দিতে হবে।“

মা ও বাবার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আনিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল সে মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। কিন্তু ক্লাস ফোরে উঠেও দেখা যাচ্ছে লেখাপড়ায় বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। বান্ধবীদের সাথে পুতুল দিয়ে খেলতে যতটা ভালো লাগে, পড়তে বসলে ঠিক তার উল্টোটা লাগে। বরং জানালার গ্রিল ধরে বাইরে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া ওর বয়সী ছেলে মেয়েদেরকে দেখতেই বেশি ভালো লাগে আনিকার। ওদের কতো মজা। স্কুলে যেতে হয় না। সময় মতো ঘুমাতে যেতে হয় না। অথচ আনিকাকে ছুটতে হয় ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে। একদম ভাল্লাগে না তার।

আনিকা ভেবেছিলো স্কুল থেকে ফিরে মাকে অংকের রেজাল্টের কথাটি জানাবে, গোপনে। ভাইয়া যদি জানে আনিকা অংকে মাত্র ২১ পেয়েছে, তাহলে আর রক্ষা নাই। ফেলটু ফেলটু করে মাথা খারাপ করে দেবে আনিকার। কিন্তু আরেকটা ঘটনা হয়েছে আজ। স্কুল থেকে বাসায় এসে দেখলো ওদের গ্রাম থেকে একজন মহিলা এসেছে বেড়াতে। মা বলেছে মহিলাটি আনিকার কেমন যেন খালা হয়। তাকে ডাকতে হবে বেলীখালা বলে। মহিলাকে ও আগে কখনো দেখেনি। পুরোনো একটা শাড়ি পরা। মায়ের সাথে শুধু কথা বলে। বাবার গলা শুনলেই ঘরের ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। বেলীখালার কান্ডকারখানা দেখে আনিকার খুব হাসি পায়। এতো বোকা হয় মানুষ? ড্রয়িংরুমে টিভিটা অন করতে জানে না। ফ্যানের স্পীডটাও বাড়াতে বা কমাতে ভয় পায় নিজের হাতে।

বাড়িতে মেহমান আসায় মা ব্যস্ত হয়ে আছে আজ। আনিকার স্কুল ব্যাগ খুলতে ভুলে গেছে আর পরীক্ষার রেজাল্টটিও দেখেনি। মনে মনে একটু খুশি হলো আনিকা। যাক গোপন কথাটি গোপন থাকবে আরেকটি দিন।

রাতে বেলীখালা ঘুমাতে এলো আনিকার খাটে। গোসল করে মায়ের একটা শাড়ি পড়েছে। আনিকার কাছে মনে হলো আজ রাতে সে তার মায়ের সাথেই ঘুমুচ্ছে। যাক বাবা, অংকের নাম্বার খারাপ হওয়ায় যতটা মন খারাপ হয়েছিল, এখন আর তেমন খারাপ লাগছে না। অনেক রাত পর্যন্ত দুইজন গুটুরগুটুর করে গল্প করা যাবে।

"আনিকা, তোমার স্কুলে বন্ধু আছে?"

"হুম। অনেকগুলো।"

"সবচেয়ে ভালো বন্ধু কে?"

"রেশমা। আমার ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী। ওর স্কুল ব্যাগটা আমাদের সবার চেয়ে সুন্দর।"

"আর সবচেয়ে খারাপ কে?"

"রিপন। একদম পছন্দ করি না আমি ওকে। খুব দুষ্টামি করে।"

"তুমি দুষ্টামি করো না?"

এবার আনিকা মুচকি হাসে। বলে, "আমিও দুষ্টামি করতে চাই, কিন্তু ভয় লাগে। টিচার বকা দেয় যদি।"

বেলীখালা আনিকার মাথায় আঙুলের বিলি কাটে আর বলে, "বাচ্চা-মানুষ দুষ্টামি করবে না তো কি বুড়োর দল দুষ্টামি করবে না-কি? তার জন্য বাচ্চাদেরকে বকতে আছে? তোমার যত ইচ্ছা করে তুমি দুষ্টামি করবা। বুঝেছো?"

খুশিতে মন ভরে যায় আনিকার। মনে হয় বেলীখালা ওদের স্কুলের টিচার হলে কতো ভালো হতো। কথাটি মনে হতেই ভয়ানক দৃশ্যটি আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, আনিকাকে ঘিরে ওর ভাইয়া দৌড়াচ্ছে আর মুখ ভেংচিয়ে ছড়া কাটছে:

ফেলটু মাথা ঘিলু নাই /

ফেলটু তোর পাশ নাই……..



আনিকার নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া দেখে বেলীখালা প্রশ্ন করেন, "কী হলো আনিকা? ঘুম পাচ্ছে?"

"না।"

"তাহলে? ভয় লাগছে?"

"হুম।"

"ভুতের ভয় পাও না-কি তুমি?"

আনিকা ফিসফিস করে অংকে ফেল করার কথাটি বলে ফেললো বেলীখালাকে। এমন চমৎকার হাসিখুশি একজন মানুষের কাছে সব কথা বলা যায় অনায়াসে।

কিন্তু বেলীখালা যেন আনিকার অংকভীতিকে পাত্তাই দিলো না। বললো, "ও এই কথা? আগে বলবা না! এইটা কোন বিষয় হইলো? আমার কাছে এর সমাধান আছে। আমি তোমারে অংক করা শিখিয়ে দিচ্ছি এখনই।"

আনিকার মনে হলো বেলীখালা নিজে লেখাপড়া করে নাই। স্কুলের অংকের জটিলতা সম্পর্কে তার কোন ধারণা নাই বলেই সে এমন বোকার মতো একটা কথা বলতে পারলো।

ঝিম মারা ঝাপসা আলোর অন্ধকারে বেলীখালা খাটের উপর উঠে বসলো। এরপর কীসব যেন হাবিজাবি বলতে লাগলো আর আনিকার মাথায় নিজের দুই হাতের দশটি আঙ্গুল চালাতে লাগলেন আলতোভাবে। আনিকা একবার বলে উঠলো, "কী করছো এইসব?"

ভুতুড়ে একটি কণ্ঠ গমগম করে বলে উঠলো, "কথা বলো না। চুপ করে শুয়ে থাকো খালি।"

বেশ অনেকক্ষণ পর আনিকার যখন ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো তখন বেলীখালা ঝপ করে পাশের বালিশে শুয়ে পড়লো। আনিকার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “আমার জিনেরা তোমার মাথার ভেতর ঢিলা তারগুলো সব জোড়া দিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে যখন অংক করতে বসবা, তখন মনে রাখবা তোমার মাথায় কোন ঢিলা তার নাই। তুমি এখন সব রকমের অংকই করতে পারবা। তোমার ক্লাসের রেশমা যেমন অংকে ৯০ পায় এখন থেকে তুমি পাবা ৯৫।“

বেলীখালার কথাগুলো মাথার ভেতর ধোঁয়ার মতো কুন্ডলি পাকিয়ে ঘুরছে তো ঘুরছেই। একসময় ঘুমের দেশে তলিয়ে গিয়ে আনিকা স্বপ্ন দেখলো, সে স্কুলে ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাসের সব বাচ্চাদেরকে কঠিন কঠিন অংক বুঝিয়ে দিচ্ছে পানির মতো সহজ করে।

পরদিন ছিল শুক্রবার। আনিকার ঘুম ভাঙতে দেরি হলো। স্কুল বন্ধ বলে কেউ ওকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেনি। সকালে নাস্তা করার সময় আনিকা শুনলো অনেক ভোরেই গ্রামে চলে গিয়েছে বেলীখালা। আনিকার মনটা খারাপ হয়ে হয়ে গেলো। আরো কতো গল্প ছিল বেলীখালাকে বলার!

নাস্তার পর প্রতি শুক্রবারের মতোই বাবার সাথে পড়ার টেবিলে বসেছে আনিকা। স্কুল ব্যাগ থেকে অংকের বইটি বের করে বাবাকে দেয়ার আগে নিজে চোখ বুলালো একবার। আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, সবগুলো অংকের উত্তর তার চোখে ভাসছে। কাগজে কলমে না লিখেই সে বলে দিতে পারছে সব অংকের উত্তর। কী আশ্চর্যের কথা! হতভম্ব মুখে আনিকা বলেই ফেললো, “বেলীখালার জিনেরা আমার মাথার ঢিলা তারগুলো সত্যি সত্যিই জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে দেখছি!”


Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা