তিব্বতের সর্পরাণী
এই গল্প অনেক অনেক বছর আগের। গল্পের জন্ম তিব্বত নামের ছোট্ট এক দেশে। ইতিহাস বই পড়ে তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই জেনেছো, তিব্বত দেশটা কোথায়? অতি পুরনো সভ্যতার ধারক ভারত আর চীন, এই দুটি দেশের মধ্যবর্তী স্হানে তিব্বত নামের দেশ বা তিব্বতি সভ্যতার বিকাশ ঘটে। তিব্বতের পূর্বদিকের পাহাড়গুলো তিব্বত আর চীনের মধ্যে সীমান্ত হিসেবে অবস্হিত। অন্যদিকে পৃথিবী বিখ্যাত উঁচু পাহাড় হিমালয় ভারত ও নেপালের রাজ্যগুলো থেকে তিব্বতকে আলাদা করে রেখেছে। পাহাড় ঘেরা দুর্গম তিব্বত এলাকায় চাইলেই হুটহাট কারো পক্ষে ঢুকে পড়া সম্ভব ছিল না। প্রাকৃতিক আর রাজনৈতিক নানা বাধা নিধেষ ছিল। আর কে না জানে যত বেশি বাধা, তত বেশি তাকে ডিঙানোর নেশায় মানুষ মরিয়া হয়। বৌদ্ধধর্মের যাবতীয় জ্ঞান সঞ্চয়ের আশায় অনেক বৌদ্ধপণ্ডিত দুর্গম পথের যন্ত্রণা সহ্য করে তিব্বতে গিয়েছিলেন। গোটা ভারত জুড়ে যখন বৃটিশদের রাজত্ব চলেছে তখন বৃটিশরাও গোপনে অনেককেই তিব্বতে পাঠায় সেই রাজ্যের সভ্যতা, বৌদ্ধধর্ম, ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। আমাদের এই গল্প, তারও অনেক আগের।
যে সময়কার গল্প, সে সময় তিব্বতের এক দুর্গম এলাকায় মিষ্টি পানির এক ঝরনা ছিল। ভাবছো, ঝরনা পাহাড়ি এলাকায় তো থাকতেই পারে। এ আর এমনকী বড়ো ব্যাপার? উহু, তিব্বতের ওই পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় মিষ্টি পানির ঝরনার দেখা পাওয়া খুব সহজ ছিল না। তাই ওই পথে চলাচলকারীদের জন্য আর স্হানীয় গোরু ছাগল চারাতো যারা, তাদের জন্য ঝরনাটা খুব কাজের ছিল। মন ভরে মিষ্টি পানি পান করে তারা তাদের ক্লান্তি ভুলে বিশ্রাম নিয়ে আবার যে যার কাজে মন দিতো। পথিক আবার পথ চলা শুরু করতো। রাখাল তার গোরু ছাগলের দেখভালে ফিরতো।
কিন্তু একদিন মিষ্টি পানির ঝরনা থেকে পানি পান করতে গিয়ে ওই পথে বেয়ে যাত্রা করা পথচারী পানি পান না করেই প্রাণ ভয়ে দৌড়ে পালালো। গোরু-ছাগলের পাল চরিয়ে ক্লান্ত রাখাল যেই ঝরনার কাছে গিয়ে আতঙ্কে পিছিয়ে এলো। ঘটনা কী? এত ভয় পেলো কেন তারা সবাই? ভয় না পেয়ে উপায় কী। ঝারনার ঠিক মুখে ইয়া ফণা তুলে এক সাপকে বসে থাকতে দেখে কার না আতঙ্ক হয়! ক্লান্তি ভুলে মন ভরে মিষ্টি পানি পান করার আশা ত্যাগ করে তাই যে যেদিকে পারলো পালিয়ে বাঁচলো। ভুলেও তারা আর মিষ্টি পানির লোভে ঝরনাটার কাছে ঘেঁষতো না।
সাপটা যেনতেন সাপ ছিল না। সে ছিল এক বিষধর সর্পরাণী। শরীরভরা তার শুধু বিষই ছিল না। তার মন ভর্তি ছিল হিংসে। অন্যের সাথে ভাগাভাগিতে যে অনেক আনন্দ, সেটা সর্পরাণী একদমই বিশ্বাস করতো না। একাই সবকিছু সাবাড়ে তার যত আনন্দ। ওকে দেখে ঝরনা ছেড়ে লোকজনকে ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখলে তার আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যেত। শুধু লোকজন না অন্যান্য পশুপাখিকেও সে ঝরনার ত্রিসীমানায় ঘেঁঘতে দিতো না। সারাক্ষণ ফণা তুলে পাহারায় থাকতো। একদিন সক্কাল সক্কাল সর্পরাণী দূর গাঁয়ে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে নেমতন্ন খেতে গেল। যেতে আসতে দু-তিন দিনের ধাক্কা। মিষ্টি পানির ঝরনায় কুলোপনা চক্কর তুলে সর্পরাণী পাহারায় বসে নেই, কথাটা বাতাসে রটে গেল। অনেকেই সুযোগটা কাজে লাগালো। ওই পথ ধরে তখন এক ধনী ব্যাবসায়ী তার গোরুর পাল নিয়ে যাচ্ছিল। পথের ক্লান্তি ভুলতে সে পানির খোঁজ করতে করতে মিষ্টি পানির ঝরনার কাছে এসে পৌঁছাল।
বহুদিন ধরে ব্যাবসায়ী নানা জায়গায় গোরু-গাধা বেচাবিক্রি করে। এমন সুমিষ্ট পানি সে এর আগে কখনও পান করেনি। পাথে পিপাসা লাগলে পান করবে তাই সে চামড়ার তৈরি ভিস্তিতে ঝরনার পানি ভরতি করে নিলো। মন ভরে পানি পান করে খানিক বিশ্রাম নেবার জন্য সে ছায়ায় গিয়ে বসলো। বেখেয়ালে লোকটা ঝরনার মুখটা পাথর দিয়ে যেভাবে বন্ধ করা ছিল সেভাবে বন্ধ করতে ভুলে গেল। তার বিশ্রামের সুযোগে সঙ্গের গোরু-গাধার দল ঝরনায় মুখ ডুবিয়ে চোঁ চোঁ করে পেটভরে ঝরনার প্রায় সবটা পানি খেয়ে ফেললো। যেটুকু পানি অবশিষ্ট ছিল তা পা দিয়ে দলে একেবারে নোংরা করে দিলো। বিশ্রাম শেষে ঝরনার হাল দেখে ব্যাপারটা অন্যেরা জানার আগেই সেখান থেকে দ্রুত চলে গেল।
নেমতন্ন থেকে ফিরে এসে সর্পরাণী ঝরনার হাল দেখে ক্ষেপে আগুন হয়ে গেল। রাগে গজগজ করতে করতে সে সমুদ্রের দিকে তাক করে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলো। সর্পরাণীর মন্ত্রের জোরে সমুদ্রের সমস্ত পানি ঝরনার দিকে ছুটে আসতে শুরু করলো। অতবড় একটা সমুদ্রের সমস্ত পানি ঝরনায় এসে পড়লে যে গোটা তিব্বত তলিয়ে যাবে তাতে সন্দেহ ছিল। তোমরা তো জানোই প্রাকৃতিক যে কোনো বিপদের গন্ধ জীবজন্তু আগেভাগে পায়। আশেপাশে যত গোরু-ছাগল-গাধা ইত্যাদি ছিল; গাছে গাছে যত পাখপাখালি ছিল, তারা সবাই বিপদের গন্ধ পেয়ে ছুটোছুটি শুরু করলো। রাখালেরা পশুর পাল রেখে গ্রামের দিকে ছুটে গেল খবর দিতে। চারিদিকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য সাজ সাজ রব পড়ে গেল।
ওই মিষ্টি ঝরনার পাশে পাথুরে পাহাড়ের এক গুহায় বাস করতো এক শঙ্খ চিল। নিজের মনে সে বাস করতো সেই গুহায়। হিংসুটে সর্পরাণী অন্যদের মতো শঙ্খচিলকেও দুচক্ষে দেখতে পারতো না। ওকে পাখা মেলে আকাশে চক্কর দিতে দেখলেও ফোঁস করে ফণা তুলতো। পারলে নিচে বসেই বুঝি চিলকে ছোবল দেয় আর কী। সর্পরাণীর স্বামী কিন্তু সাপ নয় মোটেও, তিনি জলজ্যান্ত একজন মানুষ ছিলেন। তাও আবার যে সে মানুষ না, একজন আচার্য। খুব জ্ঞানী লোক ছিলেন সেই আচার্য। তার নাম ছিল ফা-দাম-পাই সাঙ্গে। শঙ্খচিলটার সাথে আচার্যের ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। তার খবর চালাচালিতে প্রায় সাহায্য করতো শঙ্খচিল। তিনি চিরকুটে নানা খবরাখবর লিখে চিলের মুখে গুঁজে দিতেন। সেটা সে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতো।
সর্পরাণীর মন্ত্রে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ঝরনার দিকে ছুটে আসতে দেখে শঙ্খচিল চুপচাপ বসে থাকতে পারলো না। সে আরো অনেক পাখপাখালি জড়ো করে তাদের সবার আগেআগে আচার্যকে খবরটা দেবার জন্য উড়ে চললো। আচার্যের কাছে গিয়ে সর্পরাণীর মন্ত্র পড়ার কারণে ধেয়ে আসা বিপদের কথা খুলে বললো। পক্ষীবাহিনীর কাছ থেকে বিপদের খবর শুনে আচার্য ঝরনার কাছাকাছি ছুটে গেলেন। সেখানে পৌঁছানোর পথে প্রাণ বাঁচাতে ছুটোছুটি করতে থাকা লোকজনকে শান্ত থাকতে বলেন। কয়েকজনকে নিয়ে সেখানে পৌঁছে তিনি দ্রুত কয়েকটা নালা কেটে তেড়ে আসা পানির স্রোতকে নানাদিকে বয়ে যাওয়ার পথ করে দিলেন।
উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম দিক ধরে পানির স্রোত আপন বেগে বয়ে গেল। আর তার ফলে তিব্বত তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলো। আচার্যের কেটে দেওয়া নালার পূর্বদিকের এক ধারা থেকে সৃষ্টি হলো একটা নদী। যে নদী আজও তিরতির করে বয়ে চলেছে। নদীটার নাম অরুণ। যার বর্তমান বাড়ি নেপাল। ওহ্ ভালো কথা, সর্পরাণীর কী হলো সেটা নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে তোমাদের? তিব্বতের এত বড় ক্ষতি করার জন্য আচার্য সর্পরাণীর উপর ভীষণ রেগে যান। সর্পরাণীকে প্রাণে না মেরে যে কোনো একটা নালার স্রোত ধরে তিনি তাকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন। সর্পরাণীটা সেই স্রোতের কোনো একটা ধারা ধরে সেই যে হারিয়ে গেল কেউ আর তার খবর জানে না।
Comments
Post a Comment