অনিন্দিতা গোস্বামী'র ধারাবাহিক উপন্যাস: অবাক পৃথিবী




অবাক পৃথিবী

পর্ব পাঁচ


জ্যাকলিন বাবার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, আর কতক্ষণ আমরা এভাবে আকাশে ঘুরপাক খাবো বাবা? আমার শরীর খারাপ করছে।

প্রেসিডেন্ট তার মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,আর বেশিক্ষণ না মা একটু ধৈর্য্য ধর,আমি বুঝতে পারছি যে তোদের শরীর খারাপ লাগছে কিন্তু আমার ও তো এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, তবে হ্যাঁ তোদের আর বেশিক্ষণ এভাবে কষ্ট দেবো না,অবশেষে একটা স্যুটেবল জা'গা খুঁজে পেয়েছি ল্যান্ডিং করার।

ইউ আর সো সুইট,বলে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে টক করে বাবার গালে একটা চুমু খেলো জ্যাকলিন।

বায়ুমন্ডলের স্তর ভেদ করে লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের প্লেনটা নামতে লাগলো নীচে।জ্যাকলিনের ভাই ছোট্ট জেরী মায়ের কোলের ওপরে ফের একবার বমি করলো জল,জল।প্রায় দুদিন ধরে ছোট্ট একটা উড়োজাহাজে ওরা চারজন শুধু পাক খাচ্ছে আর পাক খাচ্ছে। যদিও প্লেনটা বিশেষ উপায়ে তৈরি, যাতে তেল ট্যাংকিটা বিশাল বড় তথাপি জ্বালানি প্রায় ফুরিয়ে এলো।এখন তার নিজের দেশের পরিস্থিতি যা তাতে জ্বালানি ভরতে দেশের মাটিতে নামা আর নিরাপদ নয়।যেকোনো সময় জনগণের বিক্ষোভের মুখে পড়তে পারেন তারা, এ কথা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন প্রেসিডেন্ট আর অন্য দেশে নামার তো প্রশ্নই ওঠে না,সারা জীবন বন্দী হয়েই কাটাতে হবে তাকে। জ্যাকলিন সব বোঝে,বড় হয়েছে এখন জ্যাকলিন। বাবা যখন তার মাকে এসব কথা বলছিল সে সব বুঝতে পারছিল,তাই এতক্ষণ তার এত শরীর খারাপ লাগলেও সে সহ্য করেছে, বাবাকে কিছু বলেনি।

ঘঁ ঘঁ করতে করতে তাদের উড়োজাহাজ মাটিতে নামল৷ তাদের এই প্লেনটা বিশেষ উপায়ে হেলিকপ্টারের মতো করে তৈরি যাতে যেখানে খুশি নামতে পারে।উপর থেকে জানলা দিয়ে জ্যাকলিন কিছুই বুঝতে পারছিল না,সব কেমন সাদা ধোঁয়ার মতো। তাই প্লেনটা মাটিতে নামতেই সিটবেল্ট খুলে জ্যাকলিন ছুট্টে গেল দরজার কাছে।দরজা খুলতেই একটা তীক্ষ্ণ ঠান্ডা বাতাস যেন সূচের মতো বিঁধে গেল তার চোখে মুখে।দেখল একটা লোক আর দুটো ছোট ছোট বাচ্চা একটা মই ঘাড়ে করে ছুটে আসছে তাদের প্লেনের কাছে।তার মানে সিড়ি টিরি নেই।এই মই দিয়ে এখন নামতে হবে তাদের।তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে তার মা বাবা আর ভাই।তার তো খুব মজাই লাগছে।কিন্তু তার মা কি পারবে এটা দিয়ে নীচে নামতে! এই সরু সিঙ্গল স্টেয়ারটাকে যে মই বলে এটা তো সে মোটেও জানত না কিন্তু একবার এক ইন্ডিয়ান ফেয়ারি টেলস থেকে সে জেনেছে।জ্যাকলিন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,মা কাম অন,আমি আগে নামছি তুমি আমাকে ফলো করো। খুব ধীরে ধীরে সাবধানে তারা চারজন নামল সিড়ি দিয়ে। নামতেই জ্যাকলিন দেখল যেদিকে দুচোখ যায় শুধু সাদা আর সাদা,ধু ধু মরুভূমি। বরফ তার কাছে নতুন কিছু নয়,বছরের বহু সময় তাদের রাস্তা ঘাটেও বরফে মোড়া থাকে কিন্তু এমন জনহীন প্রান্তর!যতদূর চোখ যায় একটা গাছপালা ঝোপঝাড় ও যেন নজরে পড়ছে না।জেরী তো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো ঠান্ডায়।তার মা জেরীকে টেনে নিল পেটের কাছটাতে।ছোট ছোট লোকদুটো বাও করে তাদের বাবাকে কি যেন বলল,বাবা ধীরে ধীরে পা ফেলে ফেলে ফলো করতে শুরু করলো ওদেরকে।সঙ্গে সঙ্গে চলল ওরাও। একটা পাথরের আড়ালে যেতেই চোখে পড়লো বেশ কয়েকটা সার সার উল্টানো গামলার মতো বরফের ঘর,ইগলু! বিষ্ময়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে নেচে উঠলো জ্যাকলিন। জ্যাকলিনের দেখাদেখি জেরীও লাফাতে লাগলো জ্যাকলিনের জামা ধরে।লোকদুটো তাদের বাবার কানে কানে কি যেন বলল।লোকদুটো বেশ বেঁটে, তাদের বাবা এই লম্বা,ছিপছিপে, মাথায় ছোট ছোট চুল,বাবাও ব্ল্যাক তবে তা মায়ের মতো অতটা ব্ল্যাক না,বাবাকে খুব হ্যান্ডসাম লাগে৷ জ্যাকলিনের। বাবাকে অনেকটা নীচু হয়ে শুনতে হলো লোকগুলোর কথা।তারপর তার বাবা তাদেরকে বলল শোন বাচ্চারা আমাদের সবাইকে এখন ঐ ইগলুর ভেতরে ঢুকতে হবে না,হলে একটু পরেই বরফের চাদরে ঢেকে ফেলবে আমাদের।

এই কথা শুনে ওরা দুই ভাইবোন আনন্দে জড়িয়ে ধরল বাবাকে।কিন্তু জ্যাকলিন দেখল এই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে পিঙ্গল হয়ে গেল তার মায়ের মুখ। তার মা বলে উঠল অসম্ভব, এর মধ্যে আমরা ঢুকব কি করে? এ যে ঢোকার মুখটা সরু গলির মতো, ওদের ছোট ছোট শরীর, ওরা ঢুকতে পারে। ফের লোকদুটো ওদের বাবার কানে কানে কি যেন বলল,বাবা বলল,ওরা বলছে আমাদেরকে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে জুলিয়া, তাহলে নাকি ঠিক ঢুকে যাবো।

জ্যাকলিন দেখছিল তার বাবার মুখটা যথার্তই কাঁচুমাচু। তার মা বলল,মানে!আমি হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকবো ওর ভেতরে! নো ওয়ে,আমি এখানে দাঁড়িয়ে থেকে বরফের তলায় চাপা পড়ে মরতে চাই,আমাকে ছেড়ে দাও,তোমরা সবাই ঢুকে পর ভেতরে।

তার বাবা তার মায়ের রাগ ভাঙানোর জন্যে হাত দিয়ে মাকে বুকের কাছে ন্দটেনে নিলো তারপর অনুনয়ের সুরে বলল,জেদ করো না লক্ষ্মীটি,এখন জেদ করার সময় নয়,এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় খোলা ছিল না সামনে।

মায়ের ভয় দেখে খুব হাসি পাচ্ছিল জ্যাকলিনের,পেটের ভেতর থেকে গুড়গুড় করে তার হাসি উঠছিল কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করছিল না, মায়ের তবে খারাপ লাগবে,কিন্তু সামান্য হামাগুড়ি দিতে এতো ভয়! সে তো তার ভায়ের সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে কত খেলে বেড়াত ছোট বেলায়।যাক গে শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তার মা কে রাজি করিয়েছে তার বাবা।ঠিক হয়েছে লোকগুলোর পিছু পিছু প্রথমে ঢুকবে তার বাবা তারপর ভাই তারপর সে তারপর মা।জ্যাকলিন বলল না বাবা মাম্মা যখন ভয় পাচ্ছে মাম্মাকে সব শেষে রাখা ঠিক হবে না। সব শেষে ঢুকব আমি।

জ্যাকলিনের কথায় আসস্থ্য হয়ে মেয়ের পিঠে হাত দিলেন প্রেসিডেন্ট।

গলি না বলে বড়সড় বরফের পাইপ বলাই বোধহয় ঠিক।তার মধ্যে প্রথমে লোকগুলোর পিছু পিছু হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলেন প্রেসিডেন্ট তারপর জেরী।জ্যাকলিন দেখল তার মা তখনও দাঁড়িয়ে আছে গোঁজ হয়ে।সে বলল,কামঅন মাম্মা ঢুকে পড় তাড়াতাড়ি, তুমি না ঢুকলে আমিও ঢুকতে পারছি না ভেতরে। আই আম ফিলিং ভেরি কোল্ড।

মেয়ের মুখের দিকে একবার করুণ ভাবে তাকিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের ফার্স্ট লেডি হয়তো বা সারা বিশ্বের ও প্রথম মহিলা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলেন ইগলুর ভেতরে। বড় করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঢুকে গেল জ্যাকলিনও।

ক্রমশ..

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা