মণিষা দাশগুপ্তের গল্প: কুঁড়ি থেকে ফুল


 
কুঁড়ি থেকে ফুল

 

স্যার এই সনদপত্র গুলো সত্যায়িত করে দেবেন? 

চোখ তুলে তাকাবার সময় নে ই। ছেলেটির বিনীত অনুরোধে তার দেওয়া কাগজগুলোতে চোখ বুলাতে বাধ্য হলাম।সনদপত্রে র আসল কপি চেয়ে ছেলেটির মুখের দিকে তাকাতেই তার শান্ত অথচ উজ্জ্বল চোখ দুটোতে মন আমার কাকে যেন খুঁজে বেড়াতে থাকে। 

 

তখন সবে মাত্র কলেজে পড়ি। পড়াশোনার খরচ যেহেতু নিজেকেই চালাতে হয়, তাই প্রাইভেট ছাত্র পড়িয়ে অর্থের জোগাড় করি। আমার বন্ধুর সহযোগিতায়, আরেক বন্ধুর আত্মীয়ের বাসায় আমার একটি টিউশনি জুটে যায়। যাকে অক্ষর
শেখানোর দায়িত্ব আমি নিলাম সে কেমন! তার বিবরণ দিতে গেলে অনেক সময় প্রয়োজন। শুধু সংক্ষেপে বলি তাকে ঈশ্বর শুধু লোজটা দেননি। 

প্রথম সাক্ষাতে সে আমার আপাদমস্তক খুঁটে খুঁটে দেখে নিল। আমি যখন তার নাম জানতে চাইলাম, সে তাদের বসবাস রত কারো নামই বাদ দিল না।শুধু মায়ের নাম বলল না। মায়ের নাম বলতে নেই। তাই সে মায়ের নাম বলবে না। তার নাম অভিক। বাবা সরকারী কর্মকর্তা। মা কলেজে বড়দের পড়ায় তাই তাকে পড়াতে পারবে না। একারণে তার জন্য টিচার রাখা হয়। কিন্তু তারা কি জানি কেন মাঝ পথেই টিউশনি ছেড়ে চলে যায়। 

ওর কথা শুনে আমি একটু হাসলাম। তার আগে একটু ভাব করতে চাইছি লাম। উল্টো ও-ই আমার সাথে ভাব করতে শুরু করার রাস্তা খুঁজে নেয়। আমি যখন বললাম চল আজ থেকে ঠিক করি কোনদিন কি পড়ব। সে আমার কথা না শোনার ভান করে আমাকে জিজ্ঞেস করে ,আপনি ব্রুসলির ফাইট দেখেছেন? টারজান দেখেন স্যার? সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান টিভিতে দেখেন? রবিবার সকালে টিভিতে "জোনাকিরা আলো' দেয় আপনি দেখেন স্যার?

 অভির পড়াশোনা শুরু হল। একদিন সবে মাত্র পড়াতে শুরু করেছি। দেখি বড্ড উসখুস করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আবার কি হল তোমার? করুণভাবে বলল, বাথরুমে যাব। ভাবলাম আটকালে আবার কোন কাণ্ড ঘটায় , তার চেয়ে বরং ছেড়েই দেই। আমি ছেড়ে দিলাম। সেই দিন আর তার টিকিটিরও দেখা আর মিলেনি । 

একদিন আমি ঘরে ঢুকেছি মাত্র। শুনতে পেলাম অভি তার মাকে বলছে , মা তোমার ঐ ছোকরা টিচারটা বেশ স্মার্ট। অভিকের মা জানতে চাইলেন, তুই স্মার্টের কি বুঝিস? মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে নিজের কথাই বলে যায়,যাই বলো না মা, ছোকরাটা ভালোই। মারামারিতে যোগ দেয়নি। এমন করে বলছে , সে যেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক।

বয়স আর কত হবে ! মাত্র ছয়। স্পষ্ট কথা বলে। হালকা পাতলা গড়ন। ভাসা ভাসা চোখ। ঠোঁট দুটো লাল। মাথা ভর্তি
ঝাকড়া চুল। বড্ড মায়াবী চেহারা। কিন্তু তার দস্যিপনায় সবাই অতিষ্ঠ। পণ করে বসে আছে পড়াশোনা করবে না।
আমাকে বিদায় করার সব রকম ফন্দি ফিকির করেও যখন দেখল কোনো লাভ নেই। তখন আমাকে বলল, আপনার বুদ্ধিশুদ্ধি আছে স্যার। 

প্রায় সে বসার চেয়ারে কিছুনা কিছু মেখে রাখে। একদিন চেয়ারে আঠা মেখে রাখে।সেই চেয়ারে বসে আমি অভিকে
পড়াচ্ছি।আর সে ঐ দিন খুব মনোযোগী পড়ায় না ছবি আঁকতে। টুকটাক কথা বলে যাবার সময় তো মহা ঝামেলা বাধে। একটা মাত্র প্যান্ট তাও গেল ছিঁড়ে। অবশেষে অভির মা আমাকে প্যান্টের ব্যবস্থা করে দেবার পর বাসায় ফিরি। 

অতিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মাস শেষে মাইনের মোহে নিয়মিত তাকে পড়াই। কিন্তু ওর অভিভাবক যখন দেখলেন বিগত ছয় মাসে তাদের ছেলে কিছুই শেখেনি, তখন আমায় ডেকে বললেন, তুমি ছেড়ে দাও বাপু। ওকে তুমি একটিও অক্ষর শেখাতে পারবে না। তোমার দ্বারা সম্ভব নয়। তাতে আমার খুব অপমান বোধ হয়।অভির বাবা যখন বলেন, অযথা সময় নষ্ট করে কি লাভ। মরমে মরে গেলেও নিত্যান্ত নিজের প্রয়োজন তাই আর দুই মাস চেয়ে নিলাম।অভি কে পড়ানোর প্রাত্যহিক রুটিন বদলে ফেলি। এতে অভি বেশ অসন্তুষ্ট। তবওু বলে ,স্যার টিভিতে নতুন একটা সিরিজ এসেছে, 'নাইট রাইডার'।
আমি প্রশ্ন করি, তুমি দেখো? দেখি স্যার। কিন্তু শেষ করতে পারি না। কখন যে ঘুমের বুড়ি এসে আমার চোখের উপর বসে পড়ে , আমি টেরই পাই না। তাই নাকি ! হ্যাঁ স্যার। 

একদিন অভির মা আমাকে খালি চা দেয়। সাথে সাথেই বলে, মা স্যারকে খালি চা দিলে কেন? বাবা তো কত ঘুষ মিষ্টি এনেছে। অভির মায়ের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তিনি প্রায় পালিয়ে বাঁচেন। মা চলে গেলে অভি বলে ,বুঝলেন না স্যার, আপনাকে ভালো মন্দ খেতে দিলে আমিও তো ভাগ পাব। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই আমাকে নানা রকম বিব্রতকর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়।কেমন করে যেন জানতে পারে টেস্ট পরীক্ষায় আমি ইংরেজিতে ফেল করেছি। একদিন A B C D লিখানোর সময় বলে বসল, আপনার দ্বারা আমাকে ইংরেজি শেখানো সম্ভব নয়। আমি জানতে চাইলাম, কেন?

অভি বলল , আপনি নিজেই তো ইংরেজিতে কাঁচা। শুনেছি টেস্টে ইংলিশে ডাব্বা মেরেছেন। অভির মা বাবা কাছেই ছিলেন। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবার অবস্থা। মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি ।পরের দিন বায়না ধরে সে টেবিলে বসে পড়বে না।আমার কোলে বসে পড়বে। অগত্যা আমি তাকে কোলে নিয়ে বসি। পেন্সিল মুখে গুঁজে আমার কোলে চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ অনুভব করি গরম কিছু আমার প্যান্টের ভিতরে শির শির করে নেমে যাচ্ছে। আমি কিছু বোঝার আগেই হিসুটা আটকাতে পারলাম না বলে অভি কোল থেকে নেমে দিল দৌড়।

এইভাবেই চেয়ে নেওয়া দইু মাসের মধ্যে একমাস চলে গেল। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম মাস কাবারে মাইনের টাকার লোভ ছেড়ে দেওয়াই ভালো। এই ছেলের পড়ালেখা হবে না।আমারও ফাইনাল এগিয়ে আসছে।আমার বন্ধুকে বললাম, তুই এমন ছাত্র দিলি রে ভাই, আমি যা শিখেছি তাও ভুলে গেছ। ও আমায় বলে, নিজের অক্ষমতা ঢাকতে আমাকে দোষ দিস কেন? 

আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নেই আজই বলব,কাল থেকে আর পড়াতে আসব না। বাসার গেট খুলে ভেতরে
ঢুকতেই কানে আসে অভির কথা। সে তার বড় ভাইকে বলছে ,জানিস দাদা, স্যার এখন আর টারজান,ব্রুসলি শুনতে চায়না। বলতো কার গল্প বলা যায়? অনীক বলে ,দাদুকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস। অভি ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, নারে দাদা ঘুমের গল্প বলা যাবে না। তাহলে স্যার টেবিলেই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যাবে।তাহলে বায়োনিক ওম্যানের গল্প বলিস। আমায় চোখে পড়তেই চুপ হয়ে যায়। অভি আমায় দেখা মাত্র বিজ্ঞের মত একটা হাসি দিল। 

পড়াতে বসে টেবিলের বই গুলো সব সরিয়ে দিলাম। অভি তো অবাক। অভি কে বললাম, আজ থেকে আর পড়বো না।গল্প করব। রবি নহুডকে চেনো? রবিনহুড নামটা শুনে হাবার মত আমার দিকে তাকিয়ে বলল, নাম শুনিনি। তারপর জিজ্ঞেস করল ,রবিনহুড কে স্যার? বলবনা।অভি ভেংচি কেটে এমন ভাব দেখাল, না বললে যেন তার কিচ্ছু আসে যায় না। আমি বললাম,আগামীকাল থেকে আমি আর আসব না। তাহলে রবিনহুডের কি হবে !? 

নতুন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ দেখে আমি বললাম, তুমি পড়তে লিখতে চাও না, রবিনহুডকে দিয়ে তোমার কি হবে ? এমন
সময় অভির মা এসে মাসের মাইনে আমার হাতে দিতে যাবেন তখনই অভি ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে নিল। বলল,টাকা দাওনা মা, তাহলে কাল থেকে স্যার আর আসবে না। মা বললেন, তাহলে তো তোমার উপকারই হবে। রবিনহুড চলে যাবে যে। অভির মা বললেন, টাকাটা স্যারের হাতে দাও। স্যার কোথাও যাবেন না। অভি আমার হাতে টাকা দিয়ে বলল,বলুন না স্যার, কে রবিনহুড?

শর্ত হল আমি বলব,আগে পড়তে হবে। অভির শর্ত আগে বলতে হবে। নাছোড়বান্দা অভিকের কাছে হার মেনে বলতে শুরু করি রবিনহুডের গল্প।ও বেশ মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমি ও এমন জায়গায় শেষ করি, সে পরবর্তী অংশের আশায় অক্ষর চিনতে ও লিখতে শুরু করে।গল্প বলা টনিকের মতো কাজ হল। লেখা পড়ার প্রমাণ বাসায় ঢুকে দেযালে চোখ পড়লেই সকলে বুঝতে পারে অভি লিখতে ও পড়তে পারে। অভির বাবা মা অবাক। সাত মাসে যা হল না, তা সাত দিনে কি করে সম্ভব হল! বললাম রবিনহুড অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।

দেয়াল থেকে খাতায় লেখার অভ্যাস করতে খুব একটা সময় লাগেনি। রবিনহুড থেকে রূপকথায়। রূপকথা থেকে উড়োজাহাজ আবিষ্কারের গল্প।একেকদিন এক একটা নতুন গল্প। তারপর একদিন বললাম, তুমি লেখাপড়া শিখলে নতুন নতুন বই নিজে পড়ে জেনে নিতে পারবে। গল্প শোনার আগ্রহের সাথে পড়ার আগ্রহও বেড়ে যায়। দ্রুত গতিতে অভি অক্ষর চিনতে ও লিখতে শিখে যায়। ওর অভিভাবকও আমার উপর খুশি।

এই ভাবেই অভিক ও আমার মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। অজানাকে জানার আগ্রহে ছয় বছরের মানব শিশুটি প্রচণ্ড কৌতুহল নিয়ে প্রতিদিন আমার সামনে এক ঘন্টা কাটাত, সেই শিশুটির প্রতিভায় মুগ্ধ আমিও মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যাই। অল্প সময়ে খুব ভালো শিখে ফেলে অভিক। আমারও এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ, রেজাল্টের অপেক্ষায় দিন গুনছি। অন্যদিকে অভিকে প্রতিদিন পড়াতেও যাই। হঠাৎ একদিন অভি বলে বাবা মা বদলী হয়ে গেছে। ওরা চলে যাবে। সে আমার কাছে থাকবে। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। যখন আমি রবিনহুড এর শেষ দৃ্শ্য বলছিলাম, অভির চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল।

আমি কোলে তুলে নিয়ে বলি, রবিনহুড কখনো কাঁদে না।

তারপর কত বছর পার হয়ে গেল হিসেব কষে দেখা হয়নি। টিউশনি আর পড়াশোনা দুই নিয়েই আমার দিন চলে যায়। অভি চলে যাবার পর কিছুদিন মনটা বেশ খারাপ ছিল। 

একসময় নতুন ছাত্রের ভিড়ে অভিকও মিশে যায়। আমিও মাস্টার্স শেষ করি । বি সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন আগে এই সরকারী কলেজের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেছি মাত্র।

ওর সনদপত্র গুলো হাতে নিয়ে ভাবছি এই কি সেই শিশু! যার পড়াশোনার প্রতি অনীহা ছিল। সে আজ শান্ত সৌম্য মূর্তির মতো আমার সামনে দাঁড়ি য়ে আছে! ওর বোধহয় আমার কথা মনেও নেই। ছেলেটি বলল, কি দেখছেন স্যার? ছেলেটির ডাকে বাস্তবে ফিরে আসি। সনদ গুলো সিগনেচার করে তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, বার বছর আগের রবিনহুডকে দেখছি খুঁজে পাই কি না! 

অভিকও ছোট্ট একটু দুষ্টুমির হাসি দিয়ে জানিয়ে গেল তার কিছু কিছু স্মৃতি মনে আছে।

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা