অনিন্দিতা গোস্বামীর ধারাবাহিক উপন্যাস

        অবাক পৃথিবী 


          

                        

      পর্ব- চার


এতক্ষণ মুখে কোন কথা ছিল না কারো। কিন্তু খবর শেষ হতেই হাউমাউ করে উঠল সকলে,এখন কি হবে?আর কত দূরে ঐ অস্ট্রেলিয়া দেশটা?ঠিক কতক্ষণ পরে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে দেশ দুটোর? একটা ট্রেন এত কিলোমিটার বেগে আসছে আর একটা ট্রেন অত কিলোমিটার বেগে আসছে, ঠিক কতক্ষণ পরে মুখোমুখি দেখা হবে ট্রেন দুটোর !

ওরে বাবা রে এরকম অংক কি কম করেছে রোরো! চৌবাচ্চার এ মুখ দিয়ে জল ঢুকবে ঘন্টায় এতটা তো ও মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অতটা, নে বাবা এরকম অদ্ভুত অংক কষা কেন? এক মুখ বন্ধ না করে চৌবাচ্চায় জল ভরার কি মানে আছে? আছে,মানে আছে,এতদিনে বুঝতে পারছে রোরো। উৎকন্ঠায় ঘন ঘন জল খাচ্ছে তার মা,ভনভনে মশার ঝাঁকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে কমবেশি সকলেই।

ঘুম আসছে না রোরোর।মাঠের ওপরে চিৎ হয়ে শুয়ে সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কী অপূর্ব লাগছে তার এই সাঁতারে ভেসে থাকার মত অনুভূতি। আচ্ছা মরে গেলে মানুষ কোথায় যায়?ক'মাস আগেই মারা গেল তার দিদুন,তারাও কি এখন সবাই মিলে যাচ্ছে দিদুনের কাছে?উফ্ ঠাকুর তার কথা শুনেছে,দিদুন যখন মারা গেল তখন তার কী মন খারাপ করছিল, সে শুধু ঠাকুরকে ডাকছিল হে ঠাকুর তারা যেন সবাই একসঙ্গে মরে,মা বাবা আর সে, নাহলে কাউকে ছেড়ে তো সে থাকতেই পারবে না।তার মা কাদতে কাঁদতে তার গাল টিপে বলেছিল, তা কি হয় বোকা?

রোরো বলেছিল, কেন হবে না?

তার মা অরণ্যা বলেছিল, ধুর আমরা তো অনেক বড়। আমরা আগে বুড়ো হব, আগে মারা যাব।

রোরো বলেছিল, না যাবে না, আমি কম্পিউটারের সাহায্যে তোমাদের ব্রেনটাকে সচল রেখে দেবো,তোমাদের মরতেই দেবো না।দেখো আমি এটা আবিষ্কার করেই ছাড়ব।

বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিল তার মা তাকে,বলেছিল পাগল একটা।

সবাই যে কেনো এত ভয় পাচ্ছে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না রোরো। তার তো বেশ একটা ফেস্টিভ মুড লাগছে। সকালে উঠেই স্কুলে দৌড়াতে হবে না, স্কুল থেকে ফিরে সারাদিন একা একা বাড়িতে থাকতে হবে না, গাদা গাদা হোমওয়ার্ক করতে হবে না। শোনা যাচ্ছে কাল সকালে সবার জন্য নাকি লুচি আলুরদম টিফিনের ব্যবস্থা হয়েছে। ওফ্ দারুন ব্যাপার, ওই বিস্বাদ দুধ কর্নফ্লেক্স খেতে তার জাস্ট কান্না পায়। তাও আবার বলার উপায় নেই,মা তবে বলবে রোরো আজকাল তোমার খাওয়া-দাওয়ার দিকেই বেশি নজর গেছে। ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ। ছাত্র জীবনে পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোন কিছু চিন্তা করতে নেই। বড় হতে গেলে লক্ষ্য স্থির রাখতে হয়। রণদীপ দাদা যে এত বড় ইঞ্জিনিয়ার, এত পড়াশোনা করে, এত খাটাখাটনি করে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে জয়েন্ট এন্ত্রন্স পরীক্ষা দিল, অত বড় প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেল, পাশ করতে না করতেই অত বড় চাকরি। সব বড়, বড় আর বড়! সে-ও তো আজ এই মাঠের উপরে সবার সঙ্গে বসে কপাল চাপড়াচ্ছে, তার কারিগরি জ্ঞান কোনই কাজে লাগাতে পারছে না। দেশের এই চলনটাকে কোনভাবেই আটকাতে পারছেনা ।

ইতিমধ্যেই রোরো কানাঘুষো টের পেয়েছে অনেকে প্ল্যান করেছে সকালে হলেই তারা উত্তর দিকে রওনা দেবে।যদি হিমালয় বা ওই পামির নট এর দিকে যাওয়া যায় তাহলে হয়তো কিছুটা সম্ভাবনা থাকবে বেঁচে যাবার। ওই জায়গাটা তো পৃথিবীর উচ্চতম স্থান। কিন্তু পর্বতারোহণ কি সবার দ্বারা সম্ভব? তাছাড়া ভূমিকম্প হলে তো পাহাড়ি এলাকায়ই ভয় বেশি। আসলে সকলের এখন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। রোরোও জানে সকাল হলেই যে যার মতো ছটফটিয়ে উঠবে। তার মা তাকে কানেকানে বলেছে এসব। তার মা-ও বসে ঢুলছে। একটু আগেই অন্যের ঢোলা দেখে মা বলছিল আসলে কি জানিস রোরো মানুষ যখন বিপদ থেকে বেরোনোর আর রাস্তা খুঁজে পায়না তখন বিপদটাকে সঙ্গে করেই চলতে শিখে যায়। তারপর একসময় ভুলেই যায় তার সামনে যে এত বড় বিপদ আছে বা তার আয়ুও মাত্র কয়েকদিন।এই দেখ না মানুষ গড়ে তো বাঁচে মাত্র ষাট থেকে পঁয়ষট্টি বছর কিন্তু তার জন্যই মানুষ কত কিছু করে। অথচ দেখ মাত্র ষাটটা বছর তো যেমন তেমন করেও কাটিয়ে দেওয়া যেত! আবার দেখ একটা টগবগে ফুটন্ত জিনিসের ওপর বসে আমরা কেমন বোকার স্বর্গ বানাচ্ছি! কত যুদ্ধ,কত হানাহানি,কত পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ, এখন হল তো অহং চূর্ণ। কোন কিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো না রোরো, মানুষ ক্ষমতা পেয়ে নিজেকে ঈশ্বর মনে করেছে। ভেবেছে সে যা খুশি করবে তবু প্রকৃতি তার শোধ তুলবে না। মেরুর বরফ তো সেই কবেই গলতে শুরু করেছে। আজ নয় কাল পৃথিবীটা ধ্বংস হতোই। কিন্তু হঠাৎ করে এমন পাগলা ঘন্টি বেজে উঠবে সেটা হয়তো কেউ ভাবেনি।

রোরো ভাবে আচ্ছা কেউ না কেউ তো ঠিক বেঁচেই যাবে, তারা আবার শুরু থেকে দেখবে সভ্যতার ইতিহাস।কী মজা না তাদের, ইস্ তারাও যদি বাঁচতে পারত! ভাবতে ভাবতে রোরোও কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল মায়ের কোলে।

 ( পরের সংখ্যায় পরের পর্ব)


Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা