বৈশালীর ভ্রমণ কাহিনী
সুন্দরবনে সুন্দর
দুটি দিন
মাঝে মাঝে সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোনো ভালো খবর শুনে মন ভালো হয়ে যায় আর সেই ভালো মনটা সারাদিন থাকে। সেরকমই একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মা বললেন, “একটা ভালো খবর আছে, আমরা সুন্দরবনে যাবো!”
আমি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কবে?”
মা বললেন, “ডিসেম্বরের ছয় তারিখে।“
সুন্দরবনে আমি অনেক ছোট থাকতে গিয়েছি একবার। দুই বছর বয়সে, তাই আমার কিছু মনে নাই। তাই এবার যাওয়াটা আমার কাছে অনেকটা প্রথমবারের মতই। এরকম ক্ষেত্রে দিন পার হতে চায় না, এক দিনকে মনে হয় এক বছর, সেখানে হিসাব করে দেখলাম সুন্দরবনে যাওয়ার আগে আমাকে প্রায় বিশ দিন অপেক্ষা করতে হবে!
অবশেষে অপেক্ষার দিন শেষ হলো। ডিসেম্বরের ছয় তারিখ চলে এসেছে। দুপুরের ট্রেনে খুলনা যাবো, স্টেশনে পৌঁছায়ে অনেক দূর হেঁটে গিয়ে জানতে পারলাম আমাদের বগি ট্রেনের একদম শুরুতেই জোড়া লাগানো হবে। আবার হেঁটে হেঁটে ফিরে আসলাম। দলের অন্যদেরকে দেখতে পেলাম এবার। আমার বয়সী, আমার চেয়ে বড়ো, ছোটো বাচ্চারা আছে, (আমার স্কুলেরই আট জন! কিন্তু তারা কেউই আমার বন্ধু না) আমি সহ বিশজন। একটু ভয়ে ছিলাম যে আমি হয়ত কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারবো না, কিন্তু ওরা সবাই অনেক ভালো, ট্রেনে থাকতেই ওদের সাথে ভাব হয়ে গেল আমার! রাতে খুলনায় পৌঁছালাম। ট্রেন থেকে নেমে অটো, অটো থেকে ঘাটে নেমে নৌকা, নৌকা থেকে জাহাজ!
দ্য ওয়েভ নামের জাহাজটা বিশাল! জাহাজে আমাদের ঘরটা অনেক সুন্দর। একটু ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেলাম জাহাজটা ঘুরে দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ ছেড়ে দিল। অন্ধকার নদীতে আলো পড়া দেখতে যে কী সুন্দর লাগে বলে বোঝানো যাবে না!
জাহাজটা কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের ডিনার খাওয়ার ডাক পড়ল। জাহাজের তিনতলায় ডাইনিং হল আর তার পাশেই সুইমিং পুল। ডিনারের পর আমরা বাচ্চারা একটা ঘরে আড্ডা দিলাম রাত একটা পর্যন্ত। তারপর যে যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম, পরের দিন অনেক ভোরে ওঠা লাগবে।
পরের দিন অনেক সকালে উঠে ঝটপট ব্রেকফাস্ট করে একটা নৌকায় করে কটকা বীচে গেলাম। সমুদ্রে গোসল করার জন্য অনেক উত্তেজনায় ছিলাম কিন্তু গিয়ে দেখি জোয়ারের জন্য পানি জঙ্গলে চলে আসছে, গোসল করা যাবে না, খালি হাঁটু পর্যন্ত ভেজানো যাবে। কী আর করা হাঁটু পানিই সই!
একটা গাছ ভেঙে কাত হয়ে ছিল সেটাতে পা ঝুলিয়ে বসলাম। পায়ের অর্ধেক পানিতে, আর একেকটা ঢেউয়ে এমন টান মনে হচ্ছে ভেসে চলে যাব! অনেক কষ্টে গাছ আঁকড়ে ধরে আটকে আছি। একটু পর এত বড়ো বড়ো ঢেউ আসতে লাগল যে যেখানে একটু আগে আমার হাঁটু পর্যন্ত ভিজে ছিল, সেখানে পিঠও ভিজে গেল! আমি একা নই, আমার বন্ধুদের অনেকেই সেই গাছ ধরে দাঁড়িয়ে। একেকবার বড়ো ঢেউ এসে আমাদের ধাক্কা দিচ্ছে , আমরা ভয়ে আর মজায় চেঁচিয়ে উঠছি আর হা হা হি হি করছি। সত্যি সমুদ্রে গোসল করতে নামতে না পারলেও খুব মজা হয়েছিল সেখানে।
দ্য ওয়েভ নামের জাহাজটা বিশাল! জাহাজে আমাদের ঘরটা অনেক সুন্দর। একটু ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেলাম জাহাজটা ঘুরে দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ ছেড়ে দিল। অন্ধকার নদীতে আলো পড়া দেখতে যে কী সুন্দর লাগে বলে বোঝানো যাবে না!
জাহাজটা কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের ডিনার খাওয়ার ডাক পড়ল। জাহাজের তিনতলায় ডাইনিং হল আর তার পাশেই সুইমিং পুল। ডিনারের পর আমরা বাচ্চারা একটা ঘরে আড্ডা দিলাম রাত একটা পর্যন্ত। তারপর যে যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম, পরের দিন অনেক ভোরে ওঠা লাগবে।
পরের দিন অনেক সকালে উঠে ঝটপট ব্রেকফাস্ট করে একটা নৌকায় করে কটকা বীচে গেলাম। সমুদ্রে গোসল করার জন্য অনেক উত্তেজনায় ছিলাম কিন্তু গিয়ে দেখি জোয়ারের জন্য পানি জঙ্গলে চলে আসছে, গোসল করা যাবে না, খালি হাঁটু পর্যন্ত ভেজানো যাবে। কী আর করা হাঁটু পানিই সই!
একটা গাছ ভেঙে কাত হয়ে ছিল সেটাতে পা ঝুলিয়ে বসলাম। পায়ের অর্ধেক পানিতে, আর একেকটা ঢেউয়ে এমন টান মনে হচ্ছে ভেসে চলে যাব! অনেক কষ্টে গাছ আঁকড়ে ধরে আটকে আছি। একটু পর এত বড়ো বড়ো ঢেউ আসতে লাগল যে যেখানে একটু আগে আমার হাঁটু পর্যন্ত ভিজে ছিল, সেখানে পিঠও ভিজে গেল! আমি একা নই, আমার বন্ধুদের অনেকেই সেই গাছ ধরে দাঁড়িয়ে। একেকবার বড়ো ঢেউ এসে আমাদের ধাক্কা দিচ্ছে , আমরা ভয়ে আর মজায় চেঁচিয়ে উঠছি আর হা হা হি হি করছি। সত্যি সমুদ্রে গোসল করতে নামতে না পারলেও খুব মজা হয়েছিল সেখানে।
বনের ভিতর দিয়ে হাঁটার সময় বানর আর হরিণ দেখেছিলাম! অনেক আজব গাছ দেখেছি- মাটির কাছে এতো পেঁচানো ডাল, কোথা থেকে শুরু সেটা বোঝাই যায় না। আর কিছু বড়ই গাছের মতো গাছ দেখলাম, কেমন অদ্ভুত ছাতার মত লাগছে। নিচের দিকের সব পাতা যেন কোনো মালি সমান করে ছেঁটে দিয়েছে। এই বনের মধ্যে কে আবার গাছে ছাঁটতে গেল? তারপরে জানলাম যে হরিণেরা দল বেঁধে এসে এসব গাছের পাতা খায়। ওদের গলা উঁচিয়ে যতটা নাগাল পায় সব পাতা খেয়ে ফেলে, আর গাছগুলোও তো গোল ঝাঁকড়া ধরনের, তাই এই অবস্থা!
যাই হোক আবার জাহাজে ফিরে আসলাম, জাহাজে ফিরে এসে আমরা সবাই সুইমিংপুলে নেমে পড়লাম। লাঞ্চের পর আমরা কটকা ফরেস্ট অফিসের বনে গেলাম, অফিস না বনই দেখেছি! সেখানে একসাথে অনেকগুলো হরিণ দেখলাম। হরিণগুলোও দূর থেকে আমাদের দেখছিল, মোটেও পালিয়ে যাচ্ছিল না। ও আচ্ছা, ততক্ষণে আমরা কিন্তু একদম মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কের বাইরে। ছবি তোলা ছাড়া ফোনের আর কোনো কাজ নাই।
সন্ধ্যায় আবার সব বাচ্চাকাচ্চারা ডাইনিং-এ টেবিল ঘিরে বসলাম উনো খেলতে। সেই খেলা উনো থেকে কিলার, কিলার থেকে মাফিয়া হয়ে যায়! খেলা চলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার সেই ঘরটাতেই, যেটা আসলে ডাইনিং হলও আবার কনফারেন্স রুমও- সেখানে গান বাজনাও চলতে থাকে। কিন্তু আমরা ছোটোরা তাতে তেমন মনই দেইনি।
এর পরদিন আমরা দুবলার চরে গিয়েছিলাম। ওখানে সমুদ্রে নামা যায়। আমরা চারজন বাচ্চা আর একজন আঙ্কেল। প্রথমে হাঁটুজলে তারপর কোমর তারপর আরেকটু দূরে গিয়ে পুরাই ডুব দিয়েছি। আঙ্কেল আগে আগে গিয়ে দেখছিলেন পানি বেশি কি না, চোরাবালি আছে কি না, আমরা পিছে পিছে যাচ্ছিলাম। সুন্দরবনে যা কিছু করেছি তার মধ্যে আমার কাছে এই দুবলার চরে সমুদ্রে নামাটা সবচেয়ে বেশি মজা লেগেছে! আমরা কয়েকজন বাদে বাকিরা অন্যদিকে শুঁটকি মাছ কিনতে গিয়েছিলেন, প্রায় একঘন্টা পর সবাই ফিরে এলে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। বড়োরাও এবার সমুদ্রে নেমে পড়লেন। তারপর জাহাজে ফিরে যাওয়ার সময় আরেক মজা। এতো ঢেউ হচ্ছিল, নৌকা খুব দুলছিল, নৌকায় সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল (আমি বাদে, হি হি) ।
জাহাজে ফিরে ভেজা কাপড় বদলেই আমরা আবার রওনা দিলাম হিরণ পয়েন্টে। এবার অবশ্য সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে আছে। যাওয়ার সময় কে যেন নদীর পাশের বনের দিকে তাকিয়ে “বাঘ” বলে চেঁচিয়ে উঠল, সাথে সাথে নৌকার সবাই দাঁড়িয়ে গেল বাঘ দেখতে। আমিও দেখলাম। একটা গাছের নিচে শুয়ে মাথাটা উঁচু করে আছে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে নৌকা গেল জাহাজ থেকে আরো যাত্রীদের আনতে। তাঁরা এসে জানালেন তাঁরাও নাকি ঐ বাঘটাকে দেখেছে্ন।
হিরণ পয়েন্টে আমার অত ভালো লাগেনি। অনেকদূর রোদের মধ্যে হাঁটা লাগে। ওখানে বন্য শুয়োর আর গুঁইশাপ দেখেছিলাম। তেমন কিছুই আর দেখার পেলাম না। ফেরার সময় দেখি দূরে সেই বাঘটা তখনো একই ভাবে বসে আছে। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে ওটা বাঘ না, কোনো গাছের ভাঙা অংশ। মনটা একটু খারাপই হলো।
সেইদিন বিকালে একটা ক্যানেলে গিয়েছিলাম আমরা নৌকায়, তখন অনেক হরিণ দেখেছি। এক জায়গায় আমার মনে হলো যে আমি একটা বাঘকে হেঁটে যেতে দেখলাম গাছের আড়াল দিয়ে। মোটা মোটা হলুদ পা। যদিও সেটা আর কেউ দেখেনি।
সন্ধ্যায় আমরা সব বাচ্চারা জাহাজের পিছে সুইমিং পুলের পাশে বসে মাফিয়া খেলতে লাগলাম, সেই খেলা চলল ডিনার পর্যন্ত। তারপর একটা ঘরে আমরা পনের-ষোল জন বাচ্চা গল্প করতে লাগলাম। বিশ্বাস করা কঠিন কিন্তু আমরা প্রায় ভোর পর্যন্ত গল্প করেছি। যখনই যার মা ডাকতে আসেন সবাই চেঁচিয়ে বলি, না না আমরা জেগে থাকব। আমাদের ইচ্ছা ছিল সূর্যোদয় দেখে ঘুমাতে যাওয়া। কিন্তু সাড়ে পাঁচটার দিকে সবার ঘুম পেতে লাগল। তখন ঠিক করা হলো, একটুক্ষণ ঘুমানো হবে তারপর সূর্যোদয় দেখব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে গেল, তেরোজন একটা ছোট বিছানায় ঘুমাচ্ছে। বিশ্বাস করা যায়! আমি আর দুইজন শুধু জেগে ছিলাম।
একটু পর সূর্যের আলো ফুটলো। সবাই আস্তে আস্তে উঠে গেল ঘুম থেকে। জাহাজের সামনের ডেকে গিয়ে বসলাম। কী যে সুন্দর! কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো অবস্থা আমার আর নাই। ঘুমে আমাকে রীতিমতো ভূতের মতো দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ দেখে আমি চলে গেলাম নিজেদের ঘরে ঘুমানোর জন্যে। তখন সাতটা বাজে।
নয়টার দিকে মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল, তখন আমরা ঘাট দেখতে পাচ্ছি। সত্যি বলতে আমার মনে হচ্ছিল জাহাজে থেকে যাই। আমার বন্ধুদের সাথে। আমরা বিশজন বাচ্চা থাকলেও তেরো-চৌদ্দ জন সব সময় একসাথে থাকতাম। মনে হচ্ছিল ওদের সাথে এরকম জাহাজেই দিন কাটুক। ভাবছিলাম যে ওদের সাথে আবার কবে দেখা হবে?
তবে সব মিলিয়ে সুন্দরবনের সৌন্দর্যের জন্য, আমার নতুন বন্ধুদের জন্য, নদী-সমুদ্রের ঢেউয়ের জন্য- সুন্দরবন ভ্রমণটা আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞতা ছিল।
(একটা কথা না বললেই নয়- আমাদের ছোটোদের বন্ধুত্ব আর যোগাযোগ কিন্তু দারুণভাবেই আছে। আমাদের বাবা-মায়েদের সাহায্যে এ পর্যন্ত আমরা সবাই কয়েকবারই একসাথে হয়েছি, খুব মজা করে আড্ডা দিয়েছি, খেলেছি। আমাদের বন্ধুত্ব সারাজীবন থাকবে।)
Comments
Post a Comment