মোহিত কামালের গল্প

উপকারের প্রতিদান

 
একা একা ঘাস আর গাছের কচি কচি লতাপাতা খাচ্ছিল জেব্রা । জায়গাটা বেশ খোলামেলা। আশেপাশে ঘন জঙ্গল বলতে যা বোঝায় তা তো নয়-ই, বরং বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে রয়েছে হাঁটুসমান ঘাস আর ঘাস। এখানে বাঘ বা সিংহ আসে না বললেই চলে। তাই জেব্রা ছিল নিশ্চিন্তে, জাবর কাটায় মগ্ন । হঠাৎ ঘাসের ভেতর চলাচল করা কীটপতঙ্গ আর নাম না-জানা পাখিদের মধ্যে একটা শোরগোল শুনতে পেয়ে মাথা তুলে তাকাল ও। 
চোখ-কান সতর্ক হয়ে গেল বিপদের আশঙ্কায়। চট করে তাকাল পেছনে, ডানে-বামেও। সাধারণত বাঘ বা সিংহ পেছন থেকে আক্রমণ করে,কখনো কখনো পাশ থেকেও। খুব বিরল সময়ে সামনে থেকে। পেছনে আর পাশে বিপদের আলামত না-দেখে এবার সামনে তাকিয়ে দেখল হেলেদুলে ক্লান্ত এক সিংহরাজ এগিয়ে আসছে তার দিকে । তার চোখে হিংস্রতা নেই , চলনে-বলনে নেই আক্রমণের আভাস। নিজের ইন্দ্রীয় বলে দিল এ সিংহ ওকে আক্রমণ করবে না। তাই নির্ভয়ে মাথা উঁচিয়েই তাকিয়ে রইল সিংহরাজের দিকে। 

কাছে এসে সিংহ বলল,

 ' আমাকে দেখে ভয় পাওনি দেখে ভালো লাগছে । ' 

' তোমার চোখ আর চলার গতিতে তো তুমি নেই, তোমাদের হিংস্রতার আভাস নেই, সাদামাটা একটা সিংহই মনে হয়েছে তোমাকে । তাই পালাইনি। '

 'ঠিকই ধরে ফেলেছ তুমি। আমি তৃষ্ণাকাতর এক সিংহরাজ। আমার নাম মূ রাজা। এক শক্তিধর সিংহ, ফূ রাজা আমার পরিবারকে আক্রমণ করে আমার রাণীকে দখল করে নিয়েছে। কষ্টের কথা হলো ফূ আমার চার বাচ্চাকে চিবিয়ে চিবিয়ে মেরে ফেলেছে। আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে । ছুটতে ছুটতে আমি এ অচেনা জায়গায় পালিয়ে এসেছি । আমার প্রবল তেষ্টা পেয়েছে । জল পান করতে হবে। কোথায় জলাশয় আছে , জানো? '

মূ রাজার দুঃখের কথা শুনে মন গলে গেল জেব্রার। 

বলল, 'তোমার কষ্টের কথা শুনে আমিও কষ্ট পেলাম। তোমাকে এ সময় অবশ্যই পথ দেখিয়ে খালপাড়ে নিয়ে যাব। চলো।' 

' বাহ। তুমি তো দেখছি অনেক ভালো, জেব্রা ভাই। বন্ধুর মতো বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছ। কখনো সুযোগ পেলে তোমার উপরকার করতে পিছপা হব না। জেনে রাখো। ' 

মূ রাজাকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে খুশি হল জেব্রা । পথ দেখিয়ে তাকে নিয়ে গেল খালপাড়ে। পানি দেখে খুশিতে ডগমগ হয়ে মূ রাজা বলল, 

' তোমার তিশা নাই, ভাই? '

 ' আছে। তেমন বেশি না। তবু চলো, দুই বন্ধু একসঙ্গে জল পান করি।' দুজনেই নেমে গেল খালে।

 ' শোনো, চোখ-কান সতর্ক রাখো। খালে কুমির আছে। যেকোনো মুহূর্তে তোমাকে-আমাকে আক্রমণ করতে পারে। ' 

' ভয় পেয়ো না। আমাকে দেখলে কুমির পালাবে, আক্রমণের সুযোগ পাবে না। ' বলল মূ রাজা।

 রাজার কথা শুনে সাহস পেল জেব্রা । নিশ্চিতে পানি খেয়ে মাথা তুলে তাকাল ডানে। দেখল মূ রাজা তৃপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। অন্যরকম চাউনি!  

' কিছু বলবে, রাজাবন্ধু?' ' হ্যাঁ, বলতে চাই। পানির তিয়াস মেটার পর খিদা নাড়াচাড়া করছে পেটের ভেতর। আমার যে খাবারও খেতে হবে এখন। ' 

' এখানে তোমার খাবার নেই। জঙ্গলেই তো যেতে হবে তোমাকে।'

 ' কে বলছে নেই, আমি তো দেখছি আছে । ' 

' কোথায়?' 

' এই যে তুমি! তোমাকে খেলেই তো খিদা মিটে যাবে। ' বলেই মূ রাজা আক্রমণ করে বসল জেব্রাকে। 

সরল বিশ্বাসে অসতর্ক থাকলেও পেছনের দু' পা দিয়ে আচমকা লাথি ছুড়ে এক লাফে জেব্রা উঠে এলো পানি থেকে। তারপর ছুটতে লাগল উর্ধশ্বাসে। তার মনে হতে লাগল বিশ্বের মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বহুরূপী অদৃশ্য শত্রু, করোনা ভাইরাস । আর ওর পেছনে ছুটে আসছে ভোলপাল্টানো দৃশ্যমান মূ রাজা। ছুটছে, জেব্রা ছুটছে জীবন বাঁচাতে , মানুষ যেমন ছুটছে করোনার আতংকে ।

 

 [১০.১০.২০২০, ধানমন্ডি ঢাকা]

Comments

  1. ভালো লাগলো, করোনার বিষয়টা জোর করে না আনলেই ভালো ছিলো

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা