অনিন্দিতা গোস্বামী'র ধারাবাহিক উপন্যাস
অবাক পৃথিবী
(গতসংখ্যার পর)
পর্ব - তিন
মলি রায় ওরফে চকলেট দিদা টুকটুক করে মঞ্চের পাশ দিয়ে হেঁটে নিজের জায়গায় ফিরছিলেন। খপ করে মলি দিদার দুহাত চেপে ধরলেন জ্যোতি জেঠু, বললেন চলে গেলে তো চলবে না,এখনো অনেক বাচ্চা বলছে ওদের অনেক প্রশ্ন আছে।যে কোনো বক্তৃতার শেষেই তো প্রশ্ন উত্তর পর্ব হয়,চলুন আমরা বরং দুজনেই গিয়ে মঞ্চে দাঁড়াই,যে যার মতো উত্তর দিই। প্রথমটায় খুব রাগ হচ্ছিল আপনার ওপর কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম নিজের দুর্বলতাটা স্বীকার করে নেবার মধ্যে একটা আনন্দ আছে।মলি দিদা বললেন কিন্তু ওরা তো এখন গান গাইছে।জ্যোতি জেঠু বললেন, তা গাক না,ওদের গান শেষ হলেই না হয় উঠব বরং।
গান শেষ হতেই মলি দিদা আর জ্যোতি জেঠু হাত ধরাধরি করে উঠলেন মঞ্চে। রোরো প্রথমেই হাত তুলে বলল, কোশ্চেন।
জ্যোতি জেঠু বললে, বল, বল।
রোরো বলল, আমরা কোন দিকে মুভ করছি আগে সেটা বল।
জ্যোতি মৌলিক খানিক ইতস্তত করে বললেন, সেটা তো এখান থেকে ঠিক ঠাহর করা যাবে না।
রণদীপ দা বলল, এক মিনিট।বলে নিজের গলা থেকে চেনটা খুলে হাতে নিল। রণদীপদার গলার চেইনে সব সময় একটা লকেট ঝোলে। সেটা আসলে একটা কম্পাস। রণদীপদা মজা করে বলে ওকে ওটা কলম্বাস দিয়েছে। কম্পাস দেখে রণদীপদা বলল, মনে হচ্ছে আমরা দক্ষিণ দিকে নামছি।
জ্যোতি জেঠু তাড়াতাড়ি বলল, তার মানে তো নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে। কি তাইতো মাসিমা?
পুতুলের মত ঘাড় নাড়লো মলিদিদা, হ্যাঁ তাইতো। তবে তো সকাল হতেই মাথার ওপর চড়চড় করে উঠবে রোদ। মলি দিদা চিন্তিত মুখে বললেন, হুঁ, বৃষ্টিও তো শুরু হবে ঘন ঘন। বিশেষ করে ফোর ও ক্লক রেন।বিকেলবেলা তো অবশ্যই বৃষ্টি হবে। ও জ্যোতি রাতটা তো না হয় যেমন তেমন করে কাটলো, কাল কি হবে? মাথার ওপরে তো একটা ছাউনি না হলেই নয়।
এই আলোচনা শুনে দৌডাদৌড়ি শুরু করে দিল ব্যানার্জি জেঠু,বিনয় কাকু।রোরোর বাবাও যোগ দিল সেই ব্যস্ততাতে।কিন্তু মাথার ওপর ছাউনি দেওয়া নিয়ে লাগল চরম মত বিরোধ।রোরোর বাবা তো বারবার সবাইকে বোঝাতে লাগলো আরে ব্যানার্জিদা বোঝার চেষ্টা করুন ছাউনিই যদি দেওয়া হবে তবে আমাদের বাড়ি ঘরগুলো কি দোষ করল?না না বিরাট ছাউনি যদি মাথার ওপর ভেঙে পড়ে ভাবতে পারছেন বাচ্চাগুলোর কি অবস্থা হবে।বুঝলাম ত্রিপল,তা ঐ অত বড় ত্রিপলের ওজনই কি কম? তাছাড়া বাঁধবেন কিসে?খুঁটিগুলো,ওগুলোর ওজন একবার ভেবে দেখেছেন? তাছাড়া এখন অতটা খোঁড়াখুঁড়ি ও কি ঠিক হব? মাটির নিচে কোথায় কি হচ্ছে তার ঠিক আছে!গোবিন্দদা দাদু ফের মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আরে বাবা অন্তর্জলী যাত্রার সময় আবার রোদ আর বৃষ্টি ! থামতো মশাই তোমরা। গোবিন্দ নস্করের ধমকানিতে সবাই খানিক থমকাল।মাথার ওপর ছাউনি দেবার পরিকল্পনাটাও তখনকার মতো বন্ধ রইল।
রাত অনেক হলো।অনেকেই মাঠের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। রোরো তার ছোট্ট রেডিও টা বার করে কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলো কথা। কত সময় কত অজানা সেন্টার ধরা পড়ে এই রেডিওটাতে। কাং কুং চাং চুং কত রকমের ভাষা। একবর্ণও বুঝতে পারেনা রোরো।তবু তার ভালো লাগে, মনে হয় কোন সুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দ তরঙ্গ। ইশ,যদি তেমন কোন একটা শব্দ শোনা যেত, প্রাণের দায়ে আজ হয়তো সেই সব ভাষাও বুঝে যেত রোরো।ভাবতে ভাবতেই রোরোর কানের কাছে গমগম করে উঠল যন্ত্রটা,রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা।রোরো নিঃশব্দে উঠে গিয়ে রেডিওটা ধরল মাইকের সামনে।
হ্যাঁ আপনেরা ঠিকই অনুমান করছেন, আমরা ক্রমশ দক্ষিণ দিকে আগায়া চলছি।তবে শুধু আমরা না সমগ্র ইউরেশিয়া মহাদেশডাই ভ্যাইসা চলছে দক্ষিণ দিকে।আরো অন্যান্য মহাদেশেও একই ভাসমানতা অনুভূত হইতাছে। তবে আমাগো এহুনি ভয়ের কুনো কারণ নাই,আমাগো মহাদেশের সঞ্চরণের গতিবেগ খুবই কম।কিন্তু ভয়ের কারণ হইল হেইডা যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশডা ভাইসা আইতাছে উত্তর দিহে এবং হেই মহাদেশের আগয়ে আসার গতিডা অনেক বেশি।কতডা বেশি তা এহনো হিসাব করতে পারেন নাই আমাগো বিজ্ঞানীগণ।তবে কইষা ফেলাইবেন। মাফ করবেন এমন উত্তেজনার মুহূর্তে আমার মুখ দিয়া দ্যেশের ভাষা বারায়া পড়তাছে।শুদ্ধ ভাষা আর দ্যেশের ভাষা মিলায়ে ফেলতাসি।তবে হ একখান কথা,আমাগো ভাষাডা হইল বাঙাল ভাষা আর ওগো ঐ ঘটি গো ভাষাডা হইল শুদ্ধ বাংলা ভাষা, হেইডা কে কইল?মরণকালেও মনের আনন্দে নিজের ভাষা কইতে পারুম না কেন কইতে পারেন?
হ যে কথাডা কইতাছিলাম, আমাগো স্টেশন অধিকর্তা আমার হেই বাচালাতায় বিরক্ত হইতাছেন। কইতাছেন বর্তমান পরিস্থিতির কথা কইতে। হ আর মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা তার পরেই হয়তো আমাগো সাধের পৃথিবীডা ধ্বংস হয়া যাইবো। বর্তমান পরিস্থিতিডা হইল গিয়া সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী মহাদেশীয় পাতগুলার শুরু হয়াছে সঞ্চরণ। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ দ্রুত আগায়ে আসতাছে ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে। অনুমান করা হইতাছে যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মাথার দিকে কান উঁচা কড়াইয়ের মতো অংশডা হয়তো আইসা জুইড়া যাব ভারতীয় উপমহাদেশের এক্কেবারে দক্ষিণে ত্রিভুজের মতো কন্যাকুমারী অন্তরীপের কাজডায়।মাফ করবেন হেই হেইপার বাংলা হইপার বাংলার ভাষা আমি মেলায়ে ফেলতাছি।সে যাক মরণের কাল উপস্থিত, তার আবার এইদ্যেশ আর অই দ্যেশ,বর্ডারের এইপার আর অইপার। এখন আমাগো মধ্যে উপস্থিত আছেন ইন্ডিয়া থিকা বিশ্ব পরিবেশ ও জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক হক।তাকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলতে অনুরোধ করতাছি। এই পরিস্থিতিতে তো আপনি দ্যেশে ফিরতে পারবেন না।কি মনে হইতাছে আপনার? কি হইব এহন আমাগো?
গলা খাকড়ি দিয়ে অধ্যাপক বলতে শুরু করলেন, এখন মুশকিল হল অন্য জায়গায়, যখন অস্ট্রেলিয়া এসে জুড়বে ভারতের সঙ্গে তখন ভারতীয় উপমহাদেশের সমগ্র দক্ষিণ উপকূলীয় অংশে এক প্রবল সংঘর্ষের সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে। ফলে যে তীব্র ভূমিকম্প ঘটবার সম্ভাবনা তাতে হয়তো সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোই গভীর বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। শেষরক্ষা আর হয়তো হবেনা, আমাদের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে। তবে আমরা আর কবেই বা বেঁচেছিলাম, অভাব-অনটন, দারিদ্র,যুদ্ধ। এমন বেঁচে থাকার চেয়ে হয়তো মরে যাওয়াই শ্রেয় মনে হচ্ছে আল্লার।কিন্তু যারা ক্ষমতার আস্ফালন করত, প্রথম বিশ্বের মহান মহান দেশ, তারা? সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের সীমান্তবর্তী দেশগুলো এখন ভয়ে কাঁপছে, গোটা আটলান্টিক মহাসাগরের ঢেউ ভয়াল দৈত্যের মতো এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। ঐ অতবড় ঢেউগুলোর ধাক্কায় হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সমগ্র ইউরোপ। এইমাত্র আমি খবর পেলাম সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে সমস্ত লোকজন পালিয়ে আসতে চাইছেন মধ্য এশিয়ার অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত দেশগুলোতে। কিন্তু ঐ সমস্ত দেশগুলো উদ্বাস্তু সমস্যা জর্জরিত হবার আশঙ্কায় ইতিমধ্যেই সীমানা প্রাচীরের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে।
রেডিও জকি বলে উঠলেন,হ্যাঁ স্যার আমরাও খবর পাইতাছি কোন কোন দ্যেশ তো ইতিমধ্যেই তাদের বর্ডার এলাকা সিল কইরা দিছে। তবে এহন প্রাণের দায়ে দুর্গম সাইবেরিয়া কিংবা ঊষর কালাহারির মতো জায়গায় যাইতেও আপত্তি করতাছে না কেউ।
হ্যাঁ এবার আসি ইংল্যান্ড প্রসঙ্গে। আবার বলতে শুরু করলেন অধ্যাপক। এক সময় সমগ্র বিশ্বের রাজা দেশ ছিল ইংল্যান্ড। শাসন ও শোষণে ছিল সিদ্ধহস্ত। উত্তাল আটলান্টিকের ঢেউয়ে সে দেশ যে শুধু ভেসে গেছে তাই নয় সমগ্র আমেরিকা মহাদেশ যেহেতু পশ্চিম দিকে পাড়ি জমিয়েছে সেহেতু আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝ বরাবর তৈরি হচ্ছে ভয়াল ফাটল। ইংল্যান্ড দেশটা তাই যেকোনো সময় অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে ভেসে উঠবে আর সম্ভাবনাই থাকবে না। তবে তারা রাজার দেশ বুদ্ধি রাখে আমাদের থেকে বেশি। এই বিপদ আঁচ করে তারা আগেভাগেই বেশিরভাগ মানুষ মধ্য ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ইউরোপ-আমেরিকার অধিক অর্থবান কিছু মানুষ তো আবার কোনো দেশে থাকারই রিস্ক নেন নি। তারা তাদের নিজস্ব উড়োজাহাজে চেপে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছেন।আমেরিকা ও কানাডার থেকেও বহু উড়োজাহাজ মধ্যএশিয়ার দিকে পাড়ি দিচ্ছিল।কিন্তু রাশিয়া দেশটা কলকাঠি নেড়ে সেই উড়োজাহাজ গুলোকে আর মাটিতে নামতে দেয় নি।ওগুলোও আকাশে শুধু চক্কর খাচ্ছে। আকাশেও ট্র্যাফিক জ্যাম দেখা দিচ্ছে। অবশ্য ওগুলোর পেটে যতক্ষণ তেল আছে ততক্ষণই ওগুলো আকাশে পাক খাবে তারপর সব ঝুপঝুপ করে পড়বে নিচে।
অনেক ধন্যবাদ স্যার আমাগো সঙ্গে এতোটা সময় কাটানোর জন্য।হ,একডা খুব জরুরি কথা জানাই শ্রোতাবন্ধুদের, জাপান দ্যেশডাকেই আর খুঁইজ্যা পাওয়া যাইতাছে না।অনুমান করা হইতাছে তা প্রশান্ত মহাসাগরে তলাইয়া গেছে।আমেরিকা সহ গোটা দুনিয়ার বহু বিশিষ্ট মানুষই অবশ্য একথা মানতে নারাজ।তারা কইতাছেন হইতাই পারে না।জাপান নিশ্চয়ই আগাম বিপদের পূর্বাভাস পায়া অন্য কোথাও কোন স্পেস স্টেশন নির্মাণ কইরা গোটা দেশডারে গুটায়ে নিয়া হেইখানে চইলা গেছে।এবং সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ তারা বন্ধ কইরা রাখছেন। তাই কুনো র্যাডারেই তার কিছু ধরা পড়তাছে না।তবে আমরা খোঁজ করবার চেষ্টা চালাইতাছি।এ ব্যাপারে আমেরিকা আমাগো সহায়তা করতাছে।আমরা খবর পাইলেই আপনাগো জানাইবো।এখন কিছুক্ষণের জন্য আমরা ধারাবিবরণী বন্ধ রাখতাছি।এহন শোনেন সেতার বাদন,রাগ 'শ্রী'। হ,যাইবার আগে একডা কথা কয়া যাই।ছোটবেলায় গুরুচণ্ডালী ভাষায় লিখলে আমাগো পরীক্ষার নম্বর কাটা যাইত। একডু লক্ষ্য কইরা দেহেন হেইখানেও সেই জাতপাত। গুরু আর চন্ডাল কেন পাশাপাশি থাকতে পারবো না,কন? আসলে ভাষার কুনো দোষ নাই।যে কথাডা যেইভাবে কইতে ইচ্ছা করে হেইডা হেইভাবে কইবার স্বাধীনতা থাহা উচিৎ। ভাষা হইল ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যম।আর কিছু তো না।চলেন না আমরা সমগ্র বিশ্বে একডাই ভাষা চালু করি,এসপারান্তো। যদি কোনোক্রমে এ যাত্রায় বাইচা যাই,এই মহাদেশীয় চলন যদি হটাৎ কইরা থাইম্যা যায়,তবে নতুন পৃথিবীতে হেইডাই হইবে আমাগো প্রথম কর্তব্য। কিছু মানষে যা চেষ্টা কইরাও এতকাল সফল ভাবেতা প্রচার কইরা উঠতে পারেন নাই আমরা নাহয় তাদের পাশে গিয়া দাঁইড়াব।আজ এই পর্যন্তই।এহন শুরু হইতাছে সেতার বাদন, রাগ 'শ্রী'।
জ্যোতি জেঠু বললে, বল, বল।
রোরো বলল, আমরা কোন দিকে মুভ করছি আগে সেটা বল।
জ্যোতি মৌলিক খানিক ইতস্তত করে বললেন, সেটা তো এখান থেকে ঠিক ঠাহর করা যাবে না।
রণদীপ দা বলল, এক মিনিট।বলে নিজের গলা থেকে চেনটা খুলে হাতে নিল। রণদীপদার গলার চেইনে সব সময় একটা লকেট ঝোলে। সেটা আসলে একটা কম্পাস। রণদীপদা মজা করে বলে ওকে ওটা কলম্বাস দিয়েছে। কম্পাস দেখে রণদীপদা বলল, মনে হচ্ছে আমরা দক্ষিণ দিকে নামছি।
জ্যোতি জেঠু তাড়াতাড়ি বলল, তার মানে তো নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে। কি তাইতো মাসিমা?
পুতুলের মত ঘাড় নাড়লো মলিদিদা, হ্যাঁ তাইতো। তবে তো সকাল হতেই মাথার ওপর চড়চড় করে উঠবে রোদ। মলি দিদা চিন্তিত মুখে বললেন, হুঁ, বৃষ্টিও তো শুরু হবে ঘন ঘন। বিশেষ করে ফোর ও ক্লক রেন।বিকেলবেলা তো অবশ্যই বৃষ্টি হবে। ও জ্যোতি রাতটা তো না হয় যেমন তেমন করে কাটলো, কাল কি হবে? মাথার ওপরে তো একটা ছাউনি না হলেই নয়।
এই আলোচনা শুনে দৌডাদৌড়ি শুরু করে দিল ব্যানার্জি জেঠু,বিনয় কাকু।রোরোর বাবাও যোগ দিল সেই ব্যস্ততাতে।কিন্তু মাথার ওপর ছাউনি দেওয়া নিয়ে লাগল চরম মত বিরোধ।রোরোর বাবা তো বারবার সবাইকে বোঝাতে লাগলো আরে ব্যানার্জিদা বোঝার চেষ্টা করুন ছাউনিই যদি দেওয়া হবে তবে আমাদের বাড়ি ঘরগুলো কি দোষ করল?না না বিরাট ছাউনি যদি মাথার ওপর ভেঙে পড়ে ভাবতে পারছেন বাচ্চাগুলোর কি অবস্থা হবে।বুঝলাম ত্রিপল,তা ঐ অত বড় ত্রিপলের ওজনই কি কম? তাছাড়া বাঁধবেন কিসে?খুঁটিগুলো,ওগুলোর ওজন একবার ভেবে দেখেছেন? তাছাড়া এখন অতটা খোঁড়াখুঁড়ি ও কি ঠিক হব? মাটির নিচে কোথায় কি হচ্ছে তার ঠিক আছে!গোবিন্দদা দাদু ফের মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আরে বাবা অন্তর্জলী যাত্রার সময় আবার রোদ আর বৃষ্টি ! থামতো মশাই তোমরা। গোবিন্দ নস্করের ধমকানিতে সবাই খানিক থমকাল।মাথার ওপর ছাউনি দেবার পরিকল্পনাটাও তখনকার মতো বন্ধ রইল।
রাত অনেক হলো।অনেকেই মাঠের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। রোরো তার ছোট্ট রেডিও টা বার করে কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলো কথা। কত সময় কত অজানা সেন্টার ধরা পড়ে এই রেডিওটাতে। কাং কুং চাং চুং কত রকমের ভাষা। একবর্ণও বুঝতে পারেনা রোরো।তবু তার ভালো লাগে, মনে হয় কোন সুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দ তরঙ্গ। ইশ,যদি তেমন কোন একটা শব্দ শোনা যেত, প্রাণের দায়ে আজ হয়তো সেই সব ভাষাও বুঝে যেত রোরো।ভাবতে ভাবতেই রোরোর কানের কাছে গমগম করে উঠল যন্ত্রটা,রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা।রোরো নিঃশব্দে উঠে গিয়ে রেডিওটা ধরল মাইকের সামনে।
হ্যাঁ আপনেরা ঠিকই অনুমান করছেন, আমরা ক্রমশ দক্ষিণ দিকে আগায়া চলছি।তবে শুধু আমরা না সমগ্র ইউরেশিয়া মহাদেশডাই ভ্যাইসা চলছে দক্ষিণ দিকে।আরো অন্যান্য মহাদেশেও একই ভাসমানতা অনুভূত হইতাছে। তবে আমাগো এহুনি ভয়ের কুনো কারণ নাই,আমাগো মহাদেশের সঞ্চরণের গতিবেগ খুবই কম।কিন্তু ভয়ের কারণ হইল হেইডা যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশডা ভাইসা আইতাছে উত্তর দিহে এবং হেই মহাদেশের আগয়ে আসার গতিডা অনেক বেশি।কতডা বেশি তা এহনো হিসাব করতে পারেন নাই আমাগো বিজ্ঞানীগণ।তবে কইষা ফেলাইবেন। মাফ করবেন এমন উত্তেজনার মুহূর্তে আমার মুখ দিয়া দ্যেশের ভাষা বারায়া পড়তাছে।শুদ্ধ ভাষা আর দ্যেশের ভাষা মিলায়ে ফেলতাসি।তবে হ একখান কথা,আমাগো ভাষাডা হইল বাঙাল ভাষা আর ওগো ঐ ঘটি গো ভাষাডা হইল শুদ্ধ বাংলা ভাষা, হেইডা কে কইল?মরণকালেও মনের আনন্দে নিজের ভাষা কইতে পারুম না কেন কইতে পারেন?
হ যে কথাডা কইতাছিলাম, আমাগো স্টেশন অধিকর্তা আমার হেই বাচালাতায় বিরক্ত হইতাছেন। কইতাছেন বর্তমান পরিস্থিতির কথা কইতে। হ আর মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা তার পরেই হয়তো আমাগো সাধের পৃথিবীডা ধ্বংস হয়া যাইবো। বর্তমান পরিস্থিতিডা হইল গিয়া সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী মহাদেশীয় পাতগুলার শুরু হয়াছে সঞ্চরণ। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ দ্রুত আগায়ে আসতাছে ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে। অনুমান করা হইতাছে যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মাথার দিকে কান উঁচা কড়াইয়ের মতো অংশডা হয়তো আইসা জুইড়া যাব ভারতীয় উপমহাদেশের এক্কেবারে দক্ষিণে ত্রিভুজের মতো কন্যাকুমারী অন্তরীপের কাজডায়।মাফ করবেন হেই হেইপার বাংলা হইপার বাংলার ভাষা আমি মেলায়ে ফেলতাছি।সে যাক মরণের কাল উপস্থিত, তার আবার এইদ্যেশ আর অই দ্যেশ,বর্ডারের এইপার আর অইপার। এখন আমাগো মধ্যে উপস্থিত আছেন ইন্ডিয়া থিকা বিশ্ব পরিবেশ ও জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক হক।তাকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলতে অনুরোধ করতাছি। এই পরিস্থিতিতে তো আপনি দ্যেশে ফিরতে পারবেন না।কি মনে হইতাছে আপনার? কি হইব এহন আমাগো?
গলা খাকড়ি দিয়ে অধ্যাপক বলতে শুরু করলেন, এখন মুশকিল হল অন্য জায়গায়, যখন অস্ট্রেলিয়া এসে জুড়বে ভারতের সঙ্গে তখন ভারতীয় উপমহাদেশের সমগ্র দক্ষিণ উপকূলীয় অংশে এক প্রবল সংঘর্ষের সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে। ফলে যে তীব্র ভূমিকম্প ঘটবার সম্ভাবনা তাতে হয়তো সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোই গভীর বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। শেষরক্ষা আর হয়তো হবেনা, আমাদের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে। তবে আমরা আর কবেই বা বেঁচেছিলাম, অভাব-অনটন, দারিদ্র,যুদ্ধ। এমন বেঁচে থাকার চেয়ে হয়তো মরে যাওয়াই শ্রেয় মনে হচ্ছে আল্লার।কিন্তু যারা ক্ষমতার আস্ফালন করত, প্রথম বিশ্বের মহান মহান দেশ, তারা? সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের সীমান্তবর্তী দেশগুলো এখন ভয়ে কাঁপছে, গোটা আটলান্টিক মহাসাগরের ঢেউ ভয়াল দৈত্যের মতো এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। ঐ অতবড় ঢেউগুলোর ধাক্কায় হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সমগ্র ইউরোপ। এইমাত্র আমি খবর পেলাম সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে সমস্ত লোকজন পালিয়ে আসতে চাইছেন মধ্য এশিয়ার অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত দেশগুলোতে। কিন্তু ঐ সমস্ত দেশগুলো উদ্বাস্তু সমস্যা জর্জরিত হবার আশঙ্কায় ইতিমধ্যেই সীমানা প্রাচীরের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে।
রেডিও জকি বলে উঠলেন,হ্যাঁ স্যার আমরাও খবর পাইতাছি কোন কোন দ্যেশ তো ইতিমধ্যেই তাদের বর্ডার এলাকা সিল কইরা দিছে। তবে এহন প্রাণের দায়ে দুর্গম সাইবেরিয়া কিংবা ঊষর কালাহারির মতো জায়গায় যাইতেও আপত্তি করতাছে না কেউ।
হ্যাঁ এবার আসি ইংল্যান্ড প্রসঙ্গে। আবার বলতে শুরু করলেন অধ্যাপক। এক সময় সমগ্র বিশ্বের রাজা দেশ ছিল ইংল্যান্ড। শাসন ও শোষণে ছিল সিদ্ধহস্ত। উত্তাল আটলান্টিকের ঢেউয়ে সে দেশ যে শুধু ভেসে গেছে তাই নয় সমগ্র আমেরিকা মহাদেশ যেহেতু পশ্চিম দিকে পাড়ি জমিয়েছে সেহেতু আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝ বরাবর তৈরি হচ্ছে ভয়াল ফাটল। ইংল্যান্ড দেশটা তাই যেকোনো সময় অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে ভেসে উঠবে আর সম্ভাবনাই থাকবে না। তবে তারা রাজার দেশ বুদ্ধি রাখে আমাদের থেকে বেশি। এই বিপদ আঁচ করে তারা আগেভাগেই বেশিরভাগ মানুষ মধ্য ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ইউরোপ-আমেরিকার অধিক অর্থবান কিছু মানুষ তো আবার কোনো দেশে থাকারই রিস্ক নেন নি। তারা তাদের নিজস্ব উড়োজাহাজে চেপে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছেন।আমেরিকা ও কানাডার থেকেও বহু উড়োজাহাজ মধ্যএশিয়ার দিকে পাড়ি দিচ্ছিল।কিন্তু রাশিয়া দেশটা কলকাঠি নেড়ে সেই উড়োজাহাজ গুলোকে আর মাটিতে নামতে দেয় নি।ওগুলোও আকাশে শুধু চক্কর খাচ্ছে। আকাশেও ট্র্যাফিক জ্যাম দেখা দিচ্ছে। অবশ্য ওগুলোর পেটে যতক্ষণ তেল আছে ততক্ষণই ওগুলো আকাশে পাক খাবে তারপর সব ঝুপঝুপ করে পড়বে নিচে।
অনেক ধন্যবাদ স্যার আমাগো সঙ্গে এতোটা সময় কাটানোর জন্য।হ,একডা খুব জরুরি কথা জানাই শ্রোতাবন্ধুদের, জাপান দ্যেশডাকেই আর খুঁইজ্যা পাওয়া যাইতাছে না।অনুমান করা হইতাছে তা প্রশান্ত মহাসাগরে তলাইয়া গেছে।আমেরিকা সহ গোটা দুনিয়ার বহু বিশিষ্ট মানুষই অবশ্য একথা মানতে নারাজ।তারা কইতাছেন হইতাই পারে না।জাপান নিশ্চয়ই আগাম বিপদের পূর্বাভাস পায়া অন্য কোথাও কোন স্পেস স্টেশন নির্মাণ কইরা গোটা দেশডারে গুটায়ে নিয়া হেইখানে চইলা গেছে।এবং সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ তারা বন্ধ কইরা রাখছেন। তাই কুনো র্যাডারেই তার কিছু ধরা পড়তাছে না।তবে আমরা খোঁজ করবার চেষ্টা চালাইতাছি।এ ব্যাপারে আমেরিকা আমাগো সহায়তা করতাছে।আমরা খবর পাইলেই আপনাগো জানাইবো।এখন কিছুক্ষণের জন্য আমরা ধারাবিবরণী বন্ধ রাখতাছি।এহন শোনেন সেতার বাদন,রাগ 'শ্রী'। হ,যাইবার আগে একডা কথা কয়া যাই।ছোটবেলায় গুরুচণ্ডালী ভাষায় লিখলে আমাগো পরীক্ষার নম্বর কাটা যাইত। একডু লক্ষ্য কইরা দেহেন হেইখানেও সেই জাতপাত। গুরু আর চন্ডাল কেন পাশাপাশি থাকতে পারবো না,কন? আসলে ভাষার কুনো দোষ নাই।যে কথাডা যেইভাবে কইতে ইচ্ছা করে হেইডা হেইভাবে কইবার স্বাধীনতা থাহা উচিৎ। ভাষা হইল ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যম।আর কিছু তো না।চলেন না আমরা সমগ্র বিশ্বে একডাই ভাষা চালু করি,এসপারান্তো। যদি কোনোক্রমে এ যাত্রায় বাইচা যাই,এই মহাদেশীয় চলন যদি হটাৎ কইরা থাইম্যা যায়,তবে নতুন পৃথিবীতে হেইডাই হইবে আমাগো প্রথম কর্তব্য। কিছু মানষে যা চেষ্টা কইরাও এতকাল সফল ভাবেতা প্রচার কইরা উঠতে পারেন নাই আমরা নাহয় তাদের পাশে গিয়া দাঁইড়াব।আজ এই পর্যন্তই।এহন শুরু হইতাছে সেতার বাদন, রাগ 'শ্রী'।
(চলবে)
Comments
Post a Comment