নাহার তৃণার ফিচার
"নানান রকম চিঠি আসে
নানান রঙের খামে
প্রাপক থাকে ডানদিকে তার
প্রেরক থাকে বামে।"
বাড়িতে এরকম নানা রঙ আর আকারের খামেভরা চিঠিপত্র আসতে দেখো হয়ত তোমরা। হয়ত বলছি কারণ এখন আর ডাকে চিঠিপত্র কেউ তেমন পাঠায় না। গ্রাম থেকে দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা বিদেশে থাকা মামা-চাচা-ফুপি-খালামণিদের লোভনীয় স্ট্যাম্প বসানো চিঠি খুব একটা কী আসে এখন? উহু, আসে না। একথা হলপ করে বলতে পারি, আমাদের ছোটোবেলার মতো ডাকপিওনের ব্যাগে বয়ে এখন আর তোমাদের বাড়ি বাড়ি ওরকম নানান রকমের চিঠিপত্র খুব একটা আসে না। অফিসিয়াল কাজের, বিদ্যুৎ-টেলিফোনের বিল, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র ছাড়া প্রিয়জনদের চিঠি আজকাল আর তেমন আসে না। আসবে কেন বলো দেখি? যোগাযোগের এখন সাত সতেরোটা খোলা জানালা। সেসব জানালা গলে প্রতিদিন তোমরা প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগে থাকার সুযোগ পাচ্ছো। আমাদের সময় এতসব ব্যবস্হা তো ছিলই না। চিঠি ছিল যোগাযোগের একটা মাধ্যম। বিশেষ করে গ্রামের বা দূর দেশের আত্মীয়রা চিঠিতেই যোগাযোগ করতেন। টেলিফোনও তখন মোবাইল হয়ে হাতে হাতে ঘুরে বেড়ানো শুরু করেনি এখনকার মতো এতো জোরেশোরে। অনেকের কাছে চিঠিই ছিল যোগাযোগের ভরসা।
ভাবছো বুঝি চিঠির ইতিহাস কিংবা আগের দিনে চিঠিপত্র বাড়ি বাড়ি কীভাবে বিলি করা হতো সে বিষয়ে বলা শুরু করবো- তাই না? সেরকমটা যদি ভেবে থাকো খুব একটা ভুল কিন্তু ভাবোনি। তবে কি জানো? আজকে তোমাদের চিঠির ইতিহাস বা তার বিলিবন্টনের ইতিহাস নিয়ে কিছু বলবো না। আরেক দিনের জন্য বরং তোলা থাক সেটা কেমন? আজ বরং বাড়ি বাড়ি বিলিবন্টনের অন্য রকম এক গল্প শুনি চলো। এই বিলিবন্টনের সাথেও ডাকপিওন বা পোস্টম্যান, ডাকবিভাগ বা পোস্ট অফিস খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বুঝলে!
পৃথিবী জুড়ে দেশে দেশে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের চল শুরু হওয়ার পর অনেক দেশেই ছোটোখাটো পার্সেল পাঠানোর আর সেগুলো বাড়ি বাড়ি বিলির সহজলোভ্য ব্যবস্হা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়। পার্সেল কি বুঝেছো তো? নিশ্চয়ই বুঝেছো। এখন তোমাদের সবার বাড়িতে এই জিনিসের আসা-যাওয়া। কারো কারো বাড়িতে প্রায় রোজই আসে। বাড়ির বড়রা অনলাইনে নানা রকম জিনিসের অর্ডান দেন, সেগুলো পার্সেল হয়ে তোমাদের ঠিকানায় পৌঁছে যায়। করোনা বা কোভিড-১৯ এর কারণে সবাই ঘরবন্দী হয়ে পড়ায় অনলাইন শপিং আর পার্সেল এখন আমাদের সবার খুব চেনা বিষয়। ঠিক বলেছি না? হ্যাঁ, তো এই পার্সেল ব্যবস্হা শুরুর দিকের গল্প এটা। গল্পটা আমেরিকার। তোমরা নিশ্চয়ই ম্যাপের কোথায় আমেরিকা নামের দেশটা আছে বলতে পারবে? আমি জানি, খুব পারবে।
আমেরিকায় চিঠিপত্র বিলির পাশাপাশি ছোটোখাটো পার্সেল পাঠানো নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হলো। ঠিক হলো চিঠির মতো যে কেউ চাইলেই ওরকম পার্সেল পাঠাতেন পারবেন। পোস্টম্যান ঠিকানা ধরে বাড়ি বাড়ি সেগুলো বিলি করে আসবেন। ভাবনা মতো শুরুও হয়ে গেল পার্সেল পাঠানোর ধুম। আমেরিকার সর্বত্র মানুষজন তাদের আত্মীয় পরিজনদের নানা জিনিস এই পার্সেল ব্যবস্হার মাধ্যমে পাঠানো শুরু করলেন। ভাবছো এতে মজার আছেটা কি? আরে এবারই আসবে সেই মজারু আর চমকপ্রদ কাহিনি।
১৯১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আমেরিকায় পার্সেল পাঠানোর চল শুরু হয়। এই ব্যবস্হার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ আমেরিকাবাসী পণ্য বা জিনিস পাঠানোর সুযোগের ব্যবহার শুরু করেন সানন্দে। আমেরিকান পোস্টাল সার্ভিসের চালুকৃত এই নতুন ব্যবস্হার মাধ্যমে অদ্ভুত সব কাণ্ড কারখানাও ঘটতে থাকে। এই ব্যবস্হার মাধ্যমে কিছু মা-বাবা তাদের সন্তান কাছের আত্মীয়-পরিজনদের কাছে পাঠানোর চিন্তাভাবনা শুরু করেন। মজারু বিষয় হিসেবে পত্র-পত্রিকায় সেগুলো খবর হলেও বাস্তবে কিন্তু সত্যি সত্যি সেরকম ঘটনা ঘটেছিল। ওহাইও'র এক বাবা-মা জেসি ও মাথিল্ডা বিগল তাদের আট মাসের ছেলে জেমস কে তার গ্র্যান্ডমার কাছে পার্সেল করে পাঠান। জেমসের গ্র্যান্ডমা কয়েক মাইল দূরত্বে বাটাভিয়ায় থাকতেন। জেমস কে পাঠানোর ডাকমাশুল লেগেছিল ১৫ সেন্ট। তার ইন্সুরেন্স করা হয়েছিল ৫০ ডলার। বলাই বাহুল্য এমন ঘটনা পত্র-পত্রিকায় রমরমিয়ে ছাপা হয়েছিল। পরের বছর চার বছর বয়সী শার্লট মে পিয়েরস্টর্ফ(Charlotte May Pierstorff ) কে ভায়া ট্রেন মারফত আইডাহোর গ্র্যাঞ্জভিল থেকে ৭৩ মাইল দূরে তার দাদার বাড়িতে পার্সেল করা হয়েছিল। এই ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে শার্লট মে শিশুতোষ বই 'মেইলিং মে' লিখে খ্যাতি কুড়িয়েছেন।
এরকম অদ্ভুত কায়দায় সন্তানদের নিকট আত্মীয়দের কাছে পাঠানোর কারণটা বুঝেছো তো? আসলে যাদের রুজি রোজগার কম ছিল তাদের জন্য এই ব্যবস্হা ছিল আর্শিবাদের মতো। কারণ ট্রেনের টিকিট বা যাতায়ত খরচের চেয়ে পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে বাচ্চাকে আত্মীয়ের বাড়ি পাঠানোর খরচ অনেক কম পড়তো। আর পোস্টম্যানেরা বাচ্চাদের বিলির ক্ষেত্রে ছিলেন অনেক যত্নবান-বিশ্বাসী। হারিয়ে যাওয়ার ভয় প্রায় ছিলই না বলা যায়। সে কারণেই নিশ্চিন্তে মা-বাবা তাদের বাচ্চাকে ওভাবে পার্সেলে করে পাঠাতেন।
মানব শিশু পাঠানোর পাশাপাশি পার্সেল ব্যবস্হায় মৌমাছি, আর ছোট্ট কীটপতঙ্গ পাঠানোর সুবিধা চালু ছিল। মুরগিছানা পার্সেল ব্যবস্হা চালু হয় আরো পরে, ১৯১৮ এর দিকে। ছবির ছোট্ট পুট্টুশটার নাম জেমস। কী আরামসে, আর নির্ভয়ে ডাক পিওনের ব্যাগের ভেতর বসে দিদার বাড়ি যাচ্ছে- দেখেছো? ডাক পিওনের ব্যাগের ভেতরটা বিবিধ জরুরী খবর- মন খারাপের দিস্তা দিয়ে শুধু বোঝাই থাকতো না- এমন আনন্দের হাটও হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যেত আপনজনের বাড়ি। ব্যাপারটা অদ্ভুতুড়ে, কিন্তু কিউটও কম না! এখন বলো গল্পটা মজার কিনা?
Comments
Post a Comment