মির্জা গোলাম সারোয়ারের গল্প

আবির

 




 
আবির অষ্টম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে সে খুব আদরের । তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন। তাদের স্বপ্নের যেন শেষ নেই। বাবা রহিম স্হানীয় হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক, মা রহিমা গৃহিণী । স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে রহিম সাহেবের সুখের সংসার। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি একজন সমাজসেবক হিসেবে খুবই পরিচিত। বিপদে আপদে সবসময় সবার পাশে দাঁড়ান। বিশেষ করে করোনাকালে কেউ এগিয়ে না এলেও করোনাক্রান্ত রোগিকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া এবং কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার সৎকার তিনিই করে থাকেন। মাঝে মাঝে আবিরও বাবাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। পিতাপুত্রের এধরণের প্রশংসনীর কর্মকাণ্ড এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
একদিন ক্লাশ শেষে বাড়িতে ফিরে রহিম সাহেব খুব অসুস্থ বোধ করেন। রাতে তার জ্বর আসে। একারণে স্কুলে না গিয়ে বাসায় অবস্থান করেন। একসপ্তাহ পার হলেও জ্বর না সেরে বেড়েই চলে। অসুস্থ স্বামীকে সেবা শুশ্রুষা করার সময় রহিমাও স্বামীর সংস্পর্শে থেকে জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের পাশাপাশি তাদের গলাব্যাথা এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এমতাবস্থায় ডাক্তারী পরীক্ষায় রহিম সাহেব ও রহিমার শরীরে করোনা পজিটিভ সনাক্ত হয়। হাসপাতালে সিট না পাওয়ায় তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা করতে থাকেন। কিন্তু সুস্থ না হয়ে তাদের শারিরীক অবস্থা ক্রমশঃ আরও খারাপ হতে থাকে। এ অবস্হায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আবির বাবা-মাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়। একসাথে দু'জনকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গ্রামের লোকজনের কাছে সহায়তা চাইলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে না এসে নানা অজুহাতে এড়িয়ে যায়।

ফলে কাউকে না পেয়ে আবির একাই বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সময় মা'কে বলে, বাবাকে ভর্তি করার পর বাড়িতে ফিরে এসে তোমাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাব। তুমি তৈরি থেকো। খুশি হয়ে রহিমা আবিরকে কাছে টেনে অনেক আদর করেন। তার আদর শেষ হতেই চায়না। মনে হয় তিনি যেন শেষবারের মতো আদর করছেন। অজান্তেই রহিমার দু'চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আবিরকে আদরের পর স্বামীর হাত ধরে অনেকক্ষণ কেঁদে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অস্পষ্ট স্বরে বলেন, আমাকে মাফ করে দিও গো। তোমাকে খেদমত করে সারিয়ে তোলার সুযোগ আর হলোনা। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে এসো। আবিরের হাত ধরে বলেন, বাবার প্রতি সবসময় খেয়াল রাখিস, নিজেও ভালো থাকিস। রহিমা স্বামী ও সন্তানের যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন। কেন জানি তার মনে হয়, এ দেখাই হয়তো বা শেষ দেখা।

আবির বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান, তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন দ্রুত কমে যাচ্ছে। ফুসফুসের অবস্থা খুবই খারাপ। ৮০% ডেমেজ হয়ে গেছে। যে কোনো সময়ে আইসিইউ-তে নিতে হবে। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তার রহিম সাহেবের মুখে অক্সিজেন লাগান। বাবার করুণ অবস্থা দেখে আবিরের মন কেঁদে ওঠে। বাবাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করেনা। এসময় রহিম সাহেব অনেক কষ্টে আবিরের হাত চেপে ধরে বলেন, তুই আর দেরি করিস না বাবা। তাড়াতাড়ি মাকে হাসপাতালে নিয়ে আয়। তার অবস্থা ভালো না। যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি বাঁচবো না। বাবার দুশ্চিন্তা দেখে আবির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার সময় রহিম সাহেব ছেলের হাত ধরে কেঁদে বলেন, বাবা আবির! আমার কিছু হলে মা'কে দেখে রাখিস। কখনও তার অবহেলা করিস না। শত কষ্ট হলেও লেখাপড়া চালিয়ে যাস। তোর জন্য সবসময় আমার দোয়া থাকবে। এসময় তিনি আবিরকে কাছে টেনে চুমু খেয়ে অনেক আদর করেন। তার দু’চোখ পানিতে ভরে যায়। হঠাৎ বাবার এ ধরনের আচরণের কারণ আবিরের বোধগম্য হয়না। বাবা তাকে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য বারবার তাগিদ দিতে থাকেন। ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্সকে বাবার প্রতি খেয়াল রাখার এবং জরুরি প্রয়োজনে তাকে মোবাইল করার অনুরোধ জানিয়ে আবির বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

বাড়িতে পৌঁছার পর আবির দেখে ঘরের দরজা খোলা। বিছানায় মা কোনো কথা না বলে টানটান হয়ে শুয়ে আছেন। আবির ভাবে মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাই জোরে জোরে ডেকে বলে, মাগো! বাবাকে ভর্তি করে এসেছি। এবার তোমাকে নিয়ে যাবো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। এখনই রওয়ানা হতে হবে। বাইরে ইজি বাইক দাঁড় করে রেখেছি। আবির ডাকা সত্বেও রহিমা কোনো উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে থাকেন। দেরি দেখে ইজিবাইকের চালক যাবার জন্য হর্ন বাজিয়ে বারবার তাগাদা দিতে থাকে। এরপরও ঘুম না ভাঙায় আবির চিন্তিত হয়ে মায়ের হাত ধরে ডাকতেই চমকে ওঠে। দেখে মায়ের শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা। আবির ঘাবড়ে গিয়ে মা'কে বারবার ডাকতে থাকে। কিন্তু রহিমা কোনো উত্তর দেন না। আবির অনেক উৎকন্ঠা নিয়ে গ্রামের একজন চিকিৎসকে ডেকে আনে। তিনি পরীক্ষা করে আবিরকে বলেন, তোমার মা করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একথা শুনে আবিরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে লাশ জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে, মাগো! বাবা আর আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে তুমি ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে না ফেরার দেশে। এখন আমি কাকে মা বলে ডাকব? কে আমাকে আদর করবে? মাগো! বাবাকে হাসপাতালে যেয়ে তোমার কথা কী বলব? তোমার মৃত্যুর খবর বাবা যে সইতে পারবেনা। আমি তোমাকে চিকিৎসা করাতে পারলাম না মা। তুমি বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে। আবিরের কান্না আর আহাজারির শব্দ শুনে আশেপাশের লোকজন ছুটে আসে। বাড়িতে পড়ে যায় কান্নার রোল। পরিবেশ ভারী হয়ে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।

এসময় আবিরের মোবাইল ফোন বারবার বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের নার্স উত্তেজিত হয়ে জানায়, রহিম সাহেবের অবস্থা খুবই খারাপ। বারবার আপনাকে দেখতে এবং অসুস্থ স্ত্রীর খবর জানতে চাইছেন। আপনি খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন । একথা শুনে আবির মায়ের লাশ জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে, মাগো! বাবা খুব অসুস্থ। তোমার কথা জানতে চাইছে। তাকে কী করে বলবো যে, তুমি নাই। আমাদের ফেলে চলে গেছো না ফেরার দেশে। বাবা তোমার চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না । এসময় আবার ফোন এলে আবির মায়ের লাশ ফেলে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়। তার মনে বইতে থাকে মা'কে হারানোর অনেক দুঃখ আর বেদনা।

আবির বেদনায় আছন্ন হয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে পৌঁছে দেখে সেখানে সুনসান পরিবেশ। সবাই নিশ্চুপ হয়ে আছেন। প্রত্যেকের চোখেমুখে বেদনার ছাপ। আবির বেডের দিকে তাকিয়ে দেখে বাবাকে চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে। বেডের চারিপাশে ডাক্তার ও নার্সরা তার অপেক্ষায় নীরবে দাঁড়িয়ে। এ অবস্থা দেখে আবিরের বুক এক অজানা আশঙ্কায় থর থর করে কেঁপে ওঠে। কাঁপা গলায় ডাক্তারের কাছে জানতে চায়, তার বাবার কিছু হয়নি তো?

অনেকক্ষণ নীরব থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন, তোমার বাবা আর বেঁচে নেই। কিছুক্ষণ আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুর আগে বারবার তোমাকে দেখতে চাইছিলেন। আফসোস করে বলছিলেন, ছেলের সাথে শেষ দেখা আর হলোনা। সে যেন মায়ের চিকিৎসা ভালোভাবে করায় এবং সারাজীবন তার দেখাশোনা করে। একথা শুনে আবির বাবার লাশ জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে, বাবা! মায়ের মতো তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। মা'কে হাসপাতালে আনার জন্য বাড়িতে গিয়ে দেখি মা আর বেঁচে নেই। আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে। তোমার শোচনীয় অবস্হার কথা শুনে মায়ের লাশ ফেলে রেখে তোমার কাছে ছুটে এসে দেখি তুমিও বেঁচে নেই। আমাকে এতিম করে চির বিদায় নিয়ে চলে গেছো। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচবো বাবা? আমার যে আর কেউ রইলো না। আবির অনবরত কেঁদেই চলে। তার কান্না দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা।

কয়েকঘন্টা পর আবির এ্যাম্বুলেন্সে করে বাবার লাশ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। কারণ বাড়িতে মায়ের লাশ পড়ে আছে। একদিনেই সল্প সময়ের ব্যবধানে তাকে এতিম করে বাবা-মা পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। অধিক শোকে পাথর হয়ে আবির বাবার মুখের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ্যাম্বুলেন্স নীরবে বাড়ির পথে এগিয়ে চলে।



[ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার একজন লেখক ও কলামিস্ট]
 
 



 


 

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা