ইমতিয়ার শামীমের গল্প

 বনের ধারে



ছোট্ট খরগোশছানা বসে ছিল বনের ধারে মহানিম গাছটার নিচে। মনের সুখে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছিল একটা টকটকে লাল গাজর।

বানরটা বসে ছিল সেই গাছটারই উঁচু এক ডালে।

খরগোশছানাকে গাজর খেতে দেখে বাঁদরামি করার ইচ্ছে হলো তার। কোনো শব্দ না করে গাছের ডাল থেকে একেবারে নিচে নেমে এলো সে। চুপচাপ দাঁড়ালো খরগোশটার ঠিক পেছনে গিয়ে। তারপর কানের কাছে মুখটা নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, 'খিয়াও... মু হা হা হা... মু হা হা হা...'



ভড়কে গেল সেই খরগোশছানা। গাজরটা পড়ে গেল হাত থেকে। ভয়ে কেঁপে উঠল তার গলা, 'ক্কে--... আমার সাথে এমন করে কে--...'

বলতে বলতে লাফ দিয়ে খানিকটা সামনে চলে গেল সে। বুক তার ধড়ফড় করছে। তবু অনেক সাহস করে পেছন দিকে ফিরে তাকালো। দেখল, বানরটা গাছের গোড়ায় বসে হেসেই চলেছে।

ভারি রাগ হলো খরগোশছানার। বলল সে, 'এই, আমার সঙ্গে দুষ্টুুমি করলে কেন? আমি না ছোট খরগোশ? ছোটদের সঙ্গে কেউ এইভাবে দুষ্টুমি করে নাকি?'

থতমত খেয়ে থমকে গেল বানর। তারপর যাকে বলে একেবারে বিদ্যার জাহাজ হয়ে গেল। লেজটাকে হাত দিয়ে ধরে পেছন থেকে সামনে নিয়ে এলো। তারপর সেটার মাথাটা দিয়ে তুলির মতো করে আঁচড় দিতে লাগল গালের ওপর। একসময় একটু থেমে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, 'করে না। কিন্তু তাতে কী? আমরা তো বানর। বানররা বাঁদরামি করলে কেউ কিছু মনে করে না।'

কী ভীষণ কথা! বানরের সঙ্গে কি আর কথায় পারা যায়! অতএব খরগোশছানা আর কথা বাড়ালো না। গাজরটা রেখেই দৌড়ে চলে এলো সেখান থেকে।

মনটাই খারাপ হয়ে গেল খরগোশছানার। জলাভূমির পাশে বড় বড় বিন্ন্যা ঝোপের মধ্যে কী সুন্দর বাড়ি তাদের! সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে সে সাতসকালে। মাকে শুধু বলে এসেছে, 'আমার খাবারের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না আজ। আমি নিজেই জোগাড় করে নেব।'

তা গাজর একটা ভালোই জোগাড় করেছিল বটে। কিন্তু এই বানরটার জন্য সেটা তো ভালো করে খাওয়াই হলো না।

অতএব তক্কে তক্কে থাকল সে- দুষ্টু বানরটাকে শায়েস্তা করতে হবে। চমকে দিতে হবে। কেমন বানর ও, ছোটদেরও ভয় দেখায়! বানরটাকে আজ সে দেখেই নেবে। একটু দূরে গিয়ে কেয়া গাছের ঝোপের মধ্যে বসে বসে বানরের কাজকর্ম দেখতে লাগল সে চুপে চুপে।

মহানিম গাছটার কাছেই কলার ঝাড়। দুপুরের দিকে বানরটা সেখান থেকে এক কাঁদি কলা নিয়ে এলো। গাছের ডালে বসে বসে গিলল মনের সুখে।

পেটটা একটু ভরে ওঠায় তন্দ্রাও চলে এলো বানরের। গাছের ডালেই হেলান দিয়ে মুখটা একটু হাঁ করে দু'চোখ সে বুজে ফেলল।

তাই দেখে খরগোশছানাটা তরতরিয়ে গাছের গোড়া বেয়ে উঠে এলো সেই ডালে। লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে থামলো বানরটার ঠিক লেজের কাছে। তারপর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা কামড় বসালো লেজের গোড়ায়।

'
---ও রে মা রে---'

ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে উঠল বানরটা। তারপর চোখ ডলতে ডলতে সোজা হয়ে বসতেই দেখল, তার লেজের কাছে একটা ডালে বসে খিল খিল করে হাসছে খরগোশছানাটা।

কী ঘটেছে সেটা বুঝতে দেরি হলো না বানরের। ভীষণ চটে গেল সে। লালচে মুখটা আরও লালচে হয়ে গেল। রাগে গরগর করে বলেই বসল সে, 'অভদ্র একটা! জানিস না, তোর মা আমাকে ভাই বলে ডাকে? আমি তোর বড় হই না? বড়দের সঙ্গে কেউ এইভাবে ফাজলামো করে?'

মা এই বানরটাকে ভাই বলে ডাকে! একটু ভড়কে গেল খরগোশছানাটা। কিন্তু তা বুঝতে দিলো না বানরকে। বরং উত্তর দিলো চটপটিয়ে, 'তা করে না। কিন্তু তুমি তো মামা! মামার সঙ্গে একটু-আধটু ফাজলামো না করলে কেমন দেখায়? তা ছাড়া বানরের সঙ্গে তো বাঁদরামিই করতে হয়!'

'
বানরের সঙ্গে তো বাঁদরামিই করতে হয়!...' -দাঁত খিঁচিয়ে বলে ওঠে বানর- 'এত সাহস তোর!...'

বলেই সে তাড়া করে খরগোশছানাকে। আর খরগোশছানা তরতরিয়ে উঠে যায় একেবারে গাছের সবচেয়ে উঁচু হালকা-পাতলা ডালটাতে।

বানরটা একটু থেমে পিটপিটিয়ে তাকিয়ে দেখে মহানিমের হালকা-পাতলা ডালটাকে। একটু আগে অতগুলো কলা খেয়েছে, তাই খুব আলসেমি লাগে অত উঁচু ডালে উঠতে। গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে সে। ফাজিল খরগোশছানাকে তো এখান দিয়েই নামতে হবে। তখন ওর লম্বা কান দুটো টেনে সে না হয় আরও লম্বা করে দেবে।

উঁচু ডালের পাতার ফাঁকে বসে খরগোশটাও ভাবে, বানরটা ঘুমিয়ে পড়লেই ওর পাশ দিয়ে চলে যাবে সে সুড়ূৎ করে।

গাছের কাণ্ড আর ডালের মাঝখানে পাতার ফাঁকে শরীরটাকে গুটিয়ে-শুটিয়ে রাখতে রাখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি খরগোশছানাটা।

তারপর হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই তার গা শিরশির করে ওঠে! হায়, হায়, এ তো দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে! চারদিকে এত অন্ধকার! ঝিঁঝিঁ ডাকছে, দূরে ঝোপের মধ্যে জোনাকির দল আলো জ্বেলে বসে আছে! এই ঘন অন্ধকারের মধ্যে সে রাস্তা চিনবে কেমন করে! বাড়িতেই বা ফিরবে কেমন করে?

মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে অনেক! আর চিন্তা করবে না কেন! তার তো সেই দুপুরের আগেই বাড়িতে ফেরার কথা। বেরুনোর সময় তাই তো সে বলেছিল মাকে।

এসব ভাবতে ভাবতে ভ্যা করে কেঁদে ফেলে খরগোশছানাটা।

ওদিকে বানরটা তখন রাতের খাওয়া শেষ করেছে। মাত্র তিন-চারটা গাছ পেরিয়ে বড় যে কড়ই গাছটা আছে, সেখানে তার ভাইবোন থাকে। সেখানে ঘুরতে যাওয়ার জন্য সে চুলকে নিচ্ছিল নিজের মাথাটা। তখনই কান্নার স্বর শুনে কান খাড়া হয়ে যায় তার। জোরে জোরে বলে, 'কে- কে কাঁদে ওখানে?'

বলেই তার মনে পড়ে যায়, আরে, দুপুরে খরগোশছানাটা এই নিমগাছের উঁচু ডালটাতে চড়েছিল না? এহ্‌, একদম ভুলে গেছে সে। নিশ্চয় তারই ভয়ে নামেনি ওটা ওখান থেকে।

ওদিকে বানরের গলার স্বর শুনে খরগোশছানাটা আরও ভয় পেয়ে যায়। নিশ্চয় এবার এই অন্ধকারে বানরটা তাকে কান ধরে ঘুরাবে! ভয়ে আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে সে।

'
আহ্‌, কাঁদছো কেন? কী হয়েছে বলবে তো? না বললে বুঝব কেমন করে? এসো- এসো- নিচে নেমে এসো। বলো তো দেখি, কী হয়েছে!'

'
নিচে নামলে তুমি আমাকে মারবে না তো?'

'
ছ্যা- ্যা- একটা পুঁচকে খরগোশছানা তুই। তোকে কেন মারতে যাব? তোকে মেরে আমি আমার হাতে দুর্গন্ধ লাগাবো নাকি?'

'
কিন্তু আমি যে তোমার সঙ্গে তখন দুষ্টুমি করেছিলাম-'

'
ধুর বোকা। বড়দের সঙ্গে ছোটরা দুষ্টুমি করলে বড়রা তা মনে রাখে নাকি? আয়, আয়। তাড়াতাড়ি নেমে আয়। বল দেখি, কী হয়েছে? মাজুল তোর পিঠে কামড় দিয়েছে?'

আস্তে আস্তে নেমে আসতে আসতে বলে খরগোশছানা, 'না- না- মাজুল কামড়ায়নি। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেছে না? এখন বাড়ি ফিরব কেমন করে? আমার মা চিন্তা করছে না?

'
ধুর- যা- এই নিয়ে চিন্তা করছিস তুই? তোদের বাড়ি ওই জলাভূমিটার পাশে নারকেলগাছের গোড়ার বিন্ন্যা ঝোপের মধ্যে না?'

'
হ্যাঁ- হ্যাঁ- ওইখানেই তো। চেনো তুমি?'

'
চিনব না আবার! তোর মা আমাকে ভাই বলে ডাকে না? সন্ধ্যা নেমেছে তো কী হয়েছে? এইটা কোনো ঘটনা হলো? আয়, আমার ঘাড়ের ওপর চড়ে বস তো দেখি। এখনই তোকে বাড়িতে রেখে আসি।'

বলে বানরটা ঘাড় পেতে খরগোশছানাকে তুলে নেয় কাঁধের ওপরে। তারপর এ ডাল থেকে ও ডাল ধরে, ও ডাল থেকে সে ডাল ধরে এগিয়ে চলে খরগোশদের বাড়ির দিকে।

 


 

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা