মারজানা সাবিহা শুচির গল্প

  মায়ের কাছে





খাবার টেবিলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তিন চাকার সাইকেলটা চালাচ্ছে তিয়া। সামনের কাল্পনিক পথচারীদের হুশিয়ার করে চেঁচিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে- “সরে যাও সরে যাও! আসছে আমার পাগলা ঘোড়া!” হঠাৎ বাইরে যাওয়ার দরজাটার গায়ে নখের আঁচড়ের শব্দ পেয়ে সাইকেল ফেলে ছুটে গেল সে হন্তদন্ত হয়ে।

 

দরজার পাশে যে ছোট টুলটা রাখা আছে, ওই যে যেটার উপরে বসে বাবা অফিস থেকে ফিরে জুতা খোলেন-তাড়াতাড়ি সেটা টেনে ওপরে উঠে চোখ রাখল পিপহোলে। টুল টানার শব্দেই মনে হয় ওপাশের ক্ষুদে মানুষটা দরজা থেকে সরে গিয়েছে। একটুখানি দেখা গেল তার ঝুঁটি বাঁধা চুলগুলো। অমনি রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল তিয়া, “ঐ ময়না পাজিটা এসেছে! এ্যই তুমি আবার এসেছ কেন আমাদের বাসায়?”

মা টেবিলের সামনে বসে কী যেন করছিলেন, তিয়ার চিৎকার শুনে বিরক্ত চোখে তাকালেন। আর হুড়মুড় করে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল ওদের গৃহপরিচারিকা আসমা খালা, শাড়ির আঁচলটা পেঁচাচ্ছে আঙ্গুলে। মা বিরক্ত মুখে তাকে বললেন, “আবার নিয়ে এসেছ তোমার মেয়েকে? জানোই তো তিয়া রাগ করে!” আসমা খালা কুণ্ঠিত স্বরে বলল, “আমি আনি নাই। একলা চলে আইছে।“ আসমা খালাদের বস্তিটা কাছেই, ওরা জানে। ময়না আগেও কয়েকবার চলে এসেছে এইভাবে।

সকালে একবার ছাদে গিয়েছিল সে দাদীর সাথে, তারপর জুতাটা বাইরেই খুলে রেখেছে, খেয়াল হতেই তিয়া চেঁচিয়ে বলতে থাকে, “এ্যই খবরদার তুমি আমার জুতায় হাত দিবা না। যাও তুমি চলে যাও...”

আসমা খালা তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে বলে, “ময়না, একলা আইছো কেন!” খালা জানে, দরজা খুলতে গেলেই চেঁচাবে তিয়া; সেই চেষ্টা করে না তাই। দরজার ওপাশ থেকে মৃদু গলা শোনা যায়, “মা তুমি কখন আসবা?”

“এই তো আর একটু, যাও ময়না নিচে দারোয়ান চাচার কাছে যাইয়া বসো”।

পিপহোল দিয়ে ভালো করে দেখে নেয় তিয়া, যাক্‌ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল পাজিটা। প্রায় ওরই বয়েসী ময়না মেয়েটাকে সে কিছুতেই বাসায় আসতে দিতে চায় না। কাজের সময় কেন তার মা-কে দেখতে হবে? আর আসমা খালার সাথে তাদের বাসায় এসে কয়েকবারই মেয়েটা ওর খেলনায় হাত দিয়েছিল, সেটা মোটেও তিয়ার পছন্দ না। সে তার ক্লাশ টুয়ের বন্ধুদেরই খেলনা ধরতে দেয় না! আর এই মেয়েটাকে দেবে! খেলনা দেয় না বলে ওর সাথে তেমন কেউ খেলতেও আসে না। তাতে ওর বয়েই গেছে! সে একা একাই অনেক খেলতে পারে। এখন অবশ্য করোনার জন্য এমনিতেও কেউ আসে না। তিয়া এবার টুল থেকে নেমে আবার সাইকেল চালাতে শুরু করল।

কয়েকদিন পরের কথা, মায়ের ঘরের দরজাটা বন্ধ। দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তিয়া নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে দরজার গায়ে। ওর দাদি দেখতে পেয়েই বেজার হয়ে ডাকতে লাগলেন, “আহা আবার আসছো তুমি এইখানে, যাও যাও, ঘরে যাও।“

দাদীর গলা শুনেই মা-ও বোধহয় টের পান, মায়ের ডাক শোনা যায়-“তিয়া আম্মু! এখানে কেন?”

তিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “মা আর কয়দিন? তুমি কবে বের হবা?”

মা ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, “এই তো আর কয়দিন সোনা। যাও তুমি দাদির কাছে যাও!”

তিয়া ঘরে যায় না। চেয়ার টেনে ডাইনিং টেবিলে চিবুক ঠেকিয়ে বসে থাকে, এখান থেকে মায়ের ঘরের দরজাটা দেখা যায়। দরজার ওইপাশেই মা! এত কাছে! অথচ আজ কতদিন হয়ে গেল সে মায়ের কাছে যেতে পারেনি একবারও। মায়ের যে করোনা হয়েছে! মা একা একা ওই ঘরটায় থাকে। মাঝে মাঝে মা-কে খাবার দেওয়ার সময় দরজা খোলা হয়, সে দূর থেকে মা-কে দেখে। মায়ের মুখের মাস্কের জন্যে তাও ঠিকমতো দেখতে পারে না। আর মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা বলে। কিন্তু মায়ের গলায় ব্যথা, কথাও বলতে পারে না খুব বেশি। বাসাটা এখন কেমন নির্জন, শুনশান! মায়ের করোনা হয়েছে বলে আসমা খালাকেও বাবা নিষেধ করে দিয়েছে আসতে। একা বসে থাকতে থাকতে তিয়ার কেমন ভয় ভয় লাগে। মা ভালো হয়ে যাবে তো! কবে সে জড়িয়ে ধরতে পারবে মা-কে! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে।

………………………………………

মা ! মা ! মা!!-আজ যে তিয়া কী খুশি! ঘরময় সে ছুটে বেড়াচ্ছে আর মাঝে মাঝে অকারণেই মা-কে চেঁচিয়ে ডাকছে। কখনও গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরছে মায়ের গলা। চৌদ্দো দিন পার হয়েছে, করোনা টেস্টে গতকাল নেগেটিভ এসেছে মায়ের। আজ আসমা খালাও কাজে এসেছে। মা বোধহয় পোলাও রাঁধতে বলেছে, মায়ের ধারণা তিয়া অনেকদিন ঠিকমতো খায়নি । রান্নার সুগন্ধে ঘর ভরে গিয়েছে। মা আবার ল্যাপটপে গানও ছেড়েছে। দাদি খুশিমুখে সোফাতে বসে একটা বই পড়ছেন। সব মিলিয়ে এমন একটা আনন্দ আনন্দ ভাব বাড়িটার মধ্যে, তিয়ার উল্লাসে শুধু ছুটে বেড়াতেই ইচ্ছা করছে।

হঠাৎ বাইরের দরজার গায়ে আঁচড়ের শব্দে সে থেমে যায়। ছুটে গিয়ে টুলটায় উঠে পিপহোলে চোখ রাখে, হুম ওই তো দেখা যাচ্ছে উস্কোখুস্কো চুলে ভরা ছোটখাটো মাথাটা! ঠিক চলে এসেছে আসমা খালার পিছে পিছে। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও তিয়া থেমে যায়। বোঝা যাচ্ছে ময়না দরজা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে। টুলের শব্দ টের পায়নি বোধহয়; নখ দিয়ে আঁচড় কেটেই চলেছে মাথা নিচু করে। তিয়া তাকিয়েই থাকে, হঠাৎ যেন নিজেকেই দেখতে পায় সে দরজার ওপাশে। সেও মাথাটা নিচু করে নেমে আসে টুল থেকে। মা-কে ডেকে একটু লজ্জা লজ্জা গলায় বলে, মা, দরজাটা খুলে দাও না! ময়না আসুক, ওর মায়ের কাছে! 


 

 

 

 

 

 

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                    

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা