মাইনুল এইচ সিরাজীর গল্প
সুতাকাটা পরি
নয়না ক্লাস সিক্সে পড়ে। বয়স এগারো। এই বয়সেও তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয় সেটা না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু প্রতিরাতে মশারি টাঙিয়ে দেওয়ার কাজটা সত্যিই বিরক্তিকর।
নয়নাকে খাইয়ে দেন মা, মশারি টাঙিয়ে দেন বাবা। মা বিরক্ত হন না, বাবা বিরক্ত হন। বাবা বিরক্ত হওয়ার কারণ আছে। প্রতিবার মশারি টাঙাতে গেলে দেখা যায়, মশারির এক কোনার সুতা কাটা। বাবা মেজাজ খারাপ করে সুতা খুঁজে বেড়ান। প্রয়োজনের সময় ওইসব সুতাটুতা পাওয়া যায় না। সুতা পাওয়া গেলে কাঁচি পাওয়া যায় না। বাবা একদিন দাঁত দিয়ে সুতা কাটতে গিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলেছেন। প্রতিদিন মশারি টাঙাতে গিয়ে বাবা নয়নাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘এই যে প্রতিদিন নতুন করে সুতা লাগিয়ে মশারি টাঙানো এটা কী রকম বিরক্তিকর, তুমি জানো?’
নয়না বলে, ‘জানি।’
‘তাহলে এই সুতা কে কাটে, বলো?’
‘পরিতে কাটে।’
‘পরিতে কাটে?’
‘না হলে কে কাটে? আমি তো কাটি না।’
বাবা সত্যিই চিন্তিত হলেন। এক দিন না, দুই দিন না, সাত দিন ধরে এই ঘটনা ঘটছে। বিষয়টা নিয়ে এবার ভাববার সময় এসেছে।
মায়ের সঙ্গে বাবা পরামর্শসভায় বসলেন। নয়নাকেও সঙ্গে রাখলেন।
মা বললেন, ‘নয়না কাটবে কেন? ও কাটলে তো বলেই দিত। ও তো কখনো মিথ্যা বলে না।’
বাবা বললেন, ‘তাহলে বাকি রইলাম আমরা দুজন। তুমি আর আমি।’
মা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুমি কেন কাটবে? তুমিই তো মশারি টাঙাও।’
বাবাও হেসে বললেন, ‘তাহলে কি তুমি কাটো?’
মা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘আমি!’
বাবা বললেন, ‘কাটতেও পারো। তুমি কী সব সেলাই-টেলাই করো।’
মা বললেন, ‘এই সুতা দিয়ে সেলাই করব? পাগল নাকি!’
নয়না বলল, ‘আমি তো বলেছি পরিতে কাটে। সুতাকাটা পরি।’
বাবা বললেন, ‘পরি বলে কিছু নেই। ইঁদুর-টিদুরে কাটে হয়তো।’
নয়না বলল, ‘ইঁদুর কীভাবে কাটবে? ইঁদুর কাটলে মশারি কাটত। একেবারে কোনা খুঁজে বের করে সুতা কেটে নেওয়া ইঁদুরের কাজ না।’
বাবা চিন্তিত হয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘পরিটরি হলে তো সমস্যা। বাসাটা পাল্টে ফেলতে হবে।’
বাসা পাল্টানোর কথা শুনে নয়নার মন খারাপ হলো।
এই বাসাটায় নয়নার একটা জগৎ আছে। তার রুমটা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। দক্ষিণে বারান্দা, পশ্চিমে জানালা। প্রতি বিকেলে জানালা দিয়ে সে সূর্যাস্ত দেখে। নারিকেল গাছের মাথার ওপর দিয়ে সূর্যটা যখন নেমে যায়, আকাশটা হয়ে যায় সিঁদুররঙা; দুয়েকটা চিল ডানা মেলে আকাশে ভাসতে থাকে, ভাসতে ভাসতে নীড়ে ফিরে যায় ওরা এসব দেখে নয়না মুগ্ধ হয়। মাঝে মাঝে এই দৃশ্যটা সে তার অঙ্কের খাতায় এঁকে ফেলে। অঙ্ক স্যারকে দেখায়। অঙ্ক স্যার বলেন একদিন তোমাদের বাসায় গিয়ে এই চমৎকার দৃশ্যটা দেখে আসতে হবে।
দক্ষিণের বারান্দা নয়নার আরও প্রিয়। এখানে দোয়েল পাখি আসে। পায়রা আসে। দোয়েলের শিস নয়নার শিশুমনকে আরও উচ্ছল করে দেয়।
না, এই বাসাটা কিছুতেই ছাড়া যাবে না। বাবা যদি আরেকবার বলেন বাসা ছাড়তে, নয়না ঠিক ঠিক কেঁদে দেবে।
কিন্তু সুতাটা কে কাটে? এটা তো একটা সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না হলে বাবা হয়তো বাসাটা ছেড়েই দেবেন। কী করা যায়। নয়না ভাবতে বসে।
ভাবতে ভাবতে নয়না ঠিক করে অঙ্ক স্যারকে জানাতে হবে বিষয়টা। অঙ্ক স্যারের কাছে কোনো সমস্যাই সমস্যা না।
অঙ্ক স্যার বললেন, ‘আমি যাব। তোমাদের বাসা থেকে সূর্যাস্ত দেখব। আর ঘুড়ি ওড়াব।’
নয়না বলল, ‘ঘুড়ি?’
অঙ্ক স্যার বললেন, ‘হ্যাঁ, ঘুড়ি। আমিই ঘুড়ি নিয়ে যাব। তোমাদের বাসার সবাইকে তখন ছাদে উঠতে হবে।’
‘মা-বাবাকেও?’
‘হ্যাঁ, মা-বাবাকেও। আর কে থাকে তোমাদের বাসায়?’
‘আর কেউ না।’
‘কাজের খালা?’
‘খালা আসে দুপুর বেলায়। কাজ করে আবার চলে যায়।’
‘একা আসে?’
‘না। তার ছোট মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে আসে।’
‘ঠিক আছে। ওদেরও থাকতে বোলো।’
‘আচ্ছা।’
‘আর শোনো, আমি যে সুতাকাটা ধরতে যাচ্ছি সেটা কাউকে বলবে না। সবাই জানবে আমি যাচ্ছি ঘুড়ি ওড়াতে। তোমাদের বাসার ছাদে ঘুড়ি উৎসব হবে। ঘুড়ি আমি নিয়ে যাব।’
পরের শুক্রবার বিকেলে অঙ্ক স্যার এলেন ছয় রঙের ছয়টা ঘুড়ি নিয়ে। মা বিরিয়ানি রান্না করলেন। অঙ্ক স্যারের কথা মতো নয়না আগে থেকেই মশারির চার কোনার সুতা পাল্টে হলুদ রঙের সুতা লাগিয়ে রাখল। সুতা পাল্টাতে গিয়ে সে দেখল, আজও একটা সুতা গায়েব।
অঙ্ক স্যার সবার হাতে একটা করে ঘুড়ি দিলেন। নিজেও একটা নিলেন। নয়নার ঘুড়িটা লাল রঙের। নয়না খুশিতে নাচতে লাগল।
অঙ্ক স্যার বললেন, ‘একটা সমস্যা হয়েছে।’
নয়না বলল, ‘অঙ্ক স্যার মানেই সমস্যা। আবার অঙ্ক স্যারই সমস্যার সমাধান।’
অঙ্ক স্যার মুচকি হেসে বললেন, ‘সুতায় টান পড়েছে। এক হাত পরিমাণ পাঁচ টুকরো সুতা লাগবে। এইটুকু সুতা আমি জোড়া লাগাব আর একটা ম্যাজিক দেখাব।’
বাবা বললেন, ‘ম্যাজিক?’
অঙ্ক স্যার বললেন, ‘হ্যাঁ, ম্যাজিক। তবে একটা শর্ত আছে। প্রত্যেককে একটা করে সুতা আনতে হবে। আর সুতা আনার জন্য প্রত্যেককে যেতে হবে আলাদা আলাদাভাবে।’
প্রথমে বাবা গেলেন। সাদা রঙের সুতা আনলেন।
মা গেলেন। কালো সুতা আনলেন।
নয়না আনল লাল সুতা।
খালা আনল সবুজ সুতা।
খালার মেয়েটা আনল হলুদ সুতা।
ঘুড়ি ওড়ানো শেষ। সূর্যাস্ত দেখাও শেষ। বিরিয়ানি খেতে খেতে অঙ্ক স্যার বললেন, ‘এখন তো আর বাসা পাল্টানোর দরকার নেই। সুতাকাটা রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।’
নয়না বাবাকে বলল, ‘খালার মেয়েটার জন্য কিছু সুতা কিনে এনো বাবা। ঘুড়িও এনো। ওর ঘুড়ি ওড়ানোর খুব শখ।’
Comments
Post a Comment