তাবাসসুম নাজের গল্প:
লীলাবতী ও তার মা, সামিয়া!
জবাব নাই।
--- লী! বেবি! উঠে পড়ো, সোনা। আর কত দেরী করবে? সকাল দশটা বাজে তো!
--- উ উ উ… আধাঘুমের মধ্যে জবাব দিল লী অর্থাৎ লীলাবতী। কিন্তু ঘুম ভাঙল না ওর।
আধাঘন্টা পর আবার।
--- লীম! লীমসু! লিম্বাস!
লী এর তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নাই।
আরো কয়েকবার ডেকে মা সামিয়া গেল খেপে।
--- এই লীলা…এই! এই! লীলাবতী, এখুনি উঠে পড়ো বলছি। ফাজলামি পেয়েছ, না?
ফটাস করে লীর চোখ গেল খুলে। এই রে! মা ক্ষেপে গেছে। এমনিতে লীলাবতীর মাটা খুব ভালো কিন্তু বেলা অবধি শুয়ে থাকা খুবি অপছন্দ করে। বলে তাতে অলসতা বেড়ে যায়। ছোট মানুষ, সকাল সকাল উঠে দিন শুরু করে দিতে হবে। তা নাহয় করল লী। কিন্তু তাই বলে ছুটির দিনেও একটু ঘুমাতে পারবে না?
এ কেমন মার্শাল ল চালাচ্ছে মা?
--- উউউ…মা, আমি আরেকটু ঘুমাব!
--- কী! সকাল সাড়ে দশটা বেজে পার হয়ে গেছে। আর কত ঘুমাবে?
--- আর একটু, মা।
--- এখুনি ওঠো বলছি। লাইফে একটা ডিসিপ্লিন থাকবে না? যখন খুশি ঘুমাচ্ছ, যখন খুশি উঠছ। এসব কী অভ্যাস করছ, শুনি?
নাহ, আর শুয়ে থাকা উচিত হবে না। খুব অনিচ্ছাসত্ত্বে লীলাবতী উঠে বসল। কিন্তু মনে মনে রাগ করল মায়ের উপরে। মাটা যে কী। আশ্চর্য ব্যপার। সে পড়াশুনায় ঠিক আছে। খেলাধুলাও করে। আবার গানও গায়। তারপরেও এসব ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মা এত জ্বালায় কেন?
গোমড়া মুখ করে রুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল, মা দেখতে পেয়ে বকে উঠল
--- কী? ঘুম হল? কখন থেকে ডাকছি।
--- উফ মা! আজ তো ছুটির দিন। একটু ঘুমালে কী হয়?
--- কী হয়? আবার মুখেমুখে তর্ক? জানো, তোমাদের বয়সে আমরা মা বাবার সাথে তর্ক করবার সাহসই পেতাম না? যা বলত, মুখ বন্ধ করে শুনতাম।
ঐ রে। আবার শুরু হয়ে গেল মার পুরানো গল্প! তাদের সময়ে তারা কত ভালো ছিল, তার কেচ্ছা। শুনতে শুনতে লীলাবতীর মাঝে মাঝে সন্দেহই হয়। এতটাই কি সুবোধ বালিকা ছিল মা? একটু আধটু বানিয়ে বলছে না তো?
--- লীম! লীমসু! লিম্বাস!
লী এর তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নাই।
আরো কয়েকবার ডেকে মা সামিয়া গেল খেপে।
--- এই লীলা…এই! এই! লীলাবতী, এখুনি উঠে পড়ো বলছি। ফাজলামি পেয়েছ, না?
ফটাস করে লীর চোখ গেল খুলে। এই রে! মা ক্ষেপে গেছে। এমনিতে লীলাবতীর মাটা খুব ভালো কিন্তু বেলা অবধি শুয়ে থাকা খুবি অপছন্দ করে। বলে তাতে অলসতা বেড়ে যায়। ছোট মানুষ, সকাল সকাল উঠে দিন শুরু করে দিতে হবে। তা নাহয় করল লী। কিন্তু তাই বলে ছুটির দিনেও একটু ঘুমাতে পারবে না?
এ কেমন মার্শাল ল চালাচ্ছে মা?
--- উউউ…মা, আমি আরেকটু ঘুমাব!
--- কী! সকাল সাড়ে দশটা বেজে পার হয়ে গেছে। আর কত ঘুমাবে?
--- আর একটু, মা।
--- এখুনি ওঠো বলছি। লাইফে একটা ডিসিপ্লিন থাকবে না? যখন খুশি ঘুমাচ্ছ, যখন খুশি উঠছ। এসব কী অভ্যাস করছ, শুনি?
নাহ, আর শুয়ে থাকা উচিত হবে না। খুব অনিচ্ছাসত্ত্বে লীলাবতী উঠে বসল। কিন্তু মনে মনে রাগ করল মায়ের উপরে। মাটা যে কী। আশ্চর্য ব্যপার। সে পড়াশুনায় ঠিক আছে। খেলাধুলাও করে। আবার গানও গায়। তারপরেও এসব ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মা এত জ্বালায় কেন?
গোমড়া মুখ করে রুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল, মা দেখতে পেয়ে বকে উঠল
--- কী? ঘুম হল? কখন থেকে ডাকছি।
--- উফ মা! আজ তো ছুটির দিন। একটু ঘুমালে কী হয়?
--- কী হয়? আবার মুখেমুখে তর্ক? জানো, তোমাদের বয়সে আমরা মা বাবার সাথে তর্ক করবার সাহসই পেতাম না? যা বলত, মুখ বন্ধ করে শুনতাম।
ঐ রে। আবার শুরু হয়ে গেল মার পুরানো গল্প! তাদের সময়ে তারা কত ভালো ছিল, তার কেচ্ছা। শুনতে শুনতে লীলাবতীর মাঝে মাঝে সন্দেহই হয়। এতটাই কি সুবোধ বালিকা ছিল মা? একটু আধটু বানিয়ে বলছে না তো?
মার দিকে তাকালো লীলাবতী। মা তখনো চালিয়েই যাচ্ছে। মনে হয় বলবার ঝোঁক এসে গেছে। অনেকটা পলিটিশিয়ানদের বক্তৃতার মত।
--- জানো, আমরা কয়টার সময় উঠতাম? ছয়টা। ম্যাক্সিমাম সাড়ে ছয়টা। এরবেশি বিছানায় থাকতে সাহসই পেতাম না। তারপরে বিছানা গুছিয়ে তবেই রুম থেকে বের হতাম।
নতুন সন্দেহ দেখা দিল সামিয়ার চোখে।
--- তুমি নিশ্চয় বিছানা না করে বের হয়েছ?
বিড়বিড় করে কী জবাব দিল লীলাবতী। শুনতে না পেয়ে ফের চিল্লায়ে উঠল সামিয়া
--- কী? করেছ বিছানা?
--- না, মা। অপরাধীর মত মুখ করে উত্তর দিল লীলাবতী।
--- তা করবে কেন? সারাদিন বিছানা ওলটপালট হয়ে পড়ে থাকবে, ফিরেও তাকাবে না।
এইটা মা একটু বেশিবেশি বলল। লীলাবতী দাঁত মেজে নিয়ে ঠিকই বিছানাটা করে ফেলত।
--- জানো, আমরা আর কী কী করতাম?
জবাব দিল না লীলাবতী। জানা কথা এখন লিস্টি ধরে মার অশেষ গুণাগুণ একে একে বেরুবে। সত্যি, এতটাই কি ছিল মা? কে জানে? ওরা থাকে বিদেশে। নানা নানীও মারা গেছেন। সামিয়া এক সন্তান হবার সুবাদে লীলাবতীর খালা মামাও নাই যে জিজ্ঞেস করবে। তাই মার মুখে মারিতং বাঘ নীরবে হজম করতে হয় লীলাবতীকে।
সামিয়া বলতে থাকে
--- বিছানা করার পর ঘর গুছাতাম। মাকে হেল্প করতাম। অনেক কাজ করতাম আমি। তোমার মত ঠ্যাঙের উপরে ঠ্যাং তুলে বসে থাকতাম না।
--- মা, আমি ঠ্যাঙের উপরে ঠ্যাঙ তুলে বসে থাকি? তাহলে পড়াশুনা, খেলাধুলা, গান শেখা এসব করে কে?
--- সেসব আমরাও করতাম। এককথায় উড়িয়ে দিল কথাটা সামিয়া।
এবারে মোক্ষম কামড় দিল লীলাবতী
--- আসলে মা, তুমি যতটা বলছ, ততোটা ভালো কি সত্যি ছিলে?
--- কী ইইই? মাকে নিয়ে সন্দেহ? জানো, আমরা ছোট থাকতে…
এবারে সামিয়াকে কথাটা শেষ করতে দিল না লীলাবতী।
--- সত্যি মা! আমি সত্যি দেখতে চাই, আমার বয়সে তুমি কী করতে!
সামিয়াও ঠিক একই সময়ে বলল
--- যদি দেখাতে পারতাম তোমার বয়সে আমি কী করতাম!
হুট করে কী যে হয়ে গেল, ভালো করে বুঝল না লীলাবতী। ওর মাথাটা ঘুরে উঠল নাকি ঘরবাড়ি দুলে উঠল, ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু সে এক সেকেন্ডের জন্য। পরমুহূর্তে আবার যে কে সেই।
লীলাবতী তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেল। বের হয়ে বিছানা করে রুম গুছিয়ে ফেলল। আজ ওর বেস্ট ফ্রেন্ড অহনার বার্থ ডে। অহনাদের বাসা কাছেই। বিকালে যাবে লীলাবতী। মাকে শুধুশুধু চটিয়ে লাভ নাই। ভালোয়ভালোয় বিকাল হয়ে যাক, মা রেগে থাকলে হয়ত বলেই বসবে
--- থাক, তোমার বার্থ ডে পার্টিতে যেতে হবে না।
অংক নিয়ে বসল লীলাবতী। মাকে ইম্প্রেস করার জন্য। হুট করে ঘরে ঢুকল সামিয়া।
--- লীলু, নাস্তা খেলে না?
বাহ! মার রাগ আর নাই দেখি। কখন কী মতি হয়! উফ!
--- এই তো, মা। একটু পড়ে নেই।
কিছুক্ষণ পরে নাস্তার প্লেট হাতে ফিরে এল সামিয়া।
--- নাও, খেয়ে নাও।
আশ্চর্য হয়ে গেল লীলাবতী। মা ঘরে খাওয়াদাওয়া একদম পছন্দ করে না।
--- আমি একটু শুতে গেলাম, বুঝেছ? শরীরটা কেমন জানি করছে। তোমার বাবাও কালকের আগে ফিরবে না। যদি ঘুমিয়ে থাকি ফ্রিজে তোমার লাঞ্চ রাখা আছে। জাস্ট মাইক্রোওয়েভে একটু গরম করে নিও, কেমন?
বাধ্য মেয়ের মত মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল লীলাবতী। মা চলে যেতেই অহনার কল। রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করল
--- আজ কী পরে আসবি, লীলাবতী?
কোথায় অংক, কোথায় কী। দুই বান্ধবী বিকালের পার্টি নিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করে দিল।
দুপুর তিনটা। মা এখনো ওঠেনি। গোসলে যাচ্ছিল লীলাবতী। মার রুমের সামনে দিয়ে যেতে একঝলক তাকিয়ে দেখে মা কেমন অদ্ভুত ভঙ্গীতে শুয়ে আছে। খেয়াল না করে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। ফিরে এসে মার রুমে ঢুকে ক্লজেটে তুলে রাখা পোশাকি জামা নিতে গেছে, বিছানার দিকে তাকিয়ে আক্কেল গুড়ুম!
মার বিছানায় এ কে শুয়ে রয়েছে?
ওর বয়সী একটা মেয়ে। চেহারাটা কেমন চেনাচেনা লাগছে। কিন্তু ও মার বিছানায় কী করছে? কাপড়ও পরেছে মার সাইজের! এ কী কথা! এ তো মারই কাপড়!
--- মা আ আ আ!
চিতকার করে উঠল লীলাবতী। মা জবাব দিল না। কিন্তু চিতকারে মেয়েটা ঘুম ভেঙ্গে চমকে উঠে বসল।
--- তুমি কে?
চোখ কচলে ঘুম তাড়ালো মেয়েটা
--- আমি সামিয়া।
--- কী বললে?
একটু বিরক্ত হল মেয়েটা
--- বললাম তো আমি সামিয়া। আমার নাম জানতে চাইলে না? নাম বললাম।
লীলাবতীর মাথাটা দ্বিতীয়বারের মত চক্কর দিয়ে উঠল যেন। ঘুরে দৌড়ে পুরা বাড়ি চেক করে দেখল। নাহ, কোথাও নাই মা।
তবে কী? তবে কী সে যা ভাবছে…
আর ভাবতে পারল না।
কী করে সম্ভব এ? সায়েন্স একে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে?
ভয়েভয়ে ফিরে এল লীলাবতী সামিয়ার রুমে। দেখে মেয়েটা তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দিব্যি চুল আঁচড়াচ্ছে। ভয় পেয়েছে বা কোনো প্রশ্ন ওর মনে এসেছে বলে তো মনে হয় না। লীলাবতীকে দেখে প্রশ্ন করল
--- তোমার নাম কী?
--- লীলাবতী। নিজের মাকে নাম বলতে পেরে খুবি অদ্ভুত এক অনুভূতি হল লীলাবিতীর।
--- তোমার নাম সত্যি সামিয়া?
--- কী আশ্চর্য! নিজের নাম আমি জানব না? তোমার কি বুদ্ধি একটু কম নাকি?
বাব্বাহ! এভাবে কথা বলত মা? এভাবে কথা বললে তো মা ওকে মেরেই ফেলবে।
--- নাহ। প্রথমবার ঠিকভাবে শুনতে পাইনি আরকি!
--- খাবার আছে কিছু? আমার খুব খিদে পেয়েছে।
--- আছে তো। আমার সাথে এসো।
ফ্রিজ খুলে প্লেট বের করে মাইক্রোওভেনে গরম করে মাকে খেতে দিল লীলাবতী। এতক্ষণে একটু ধাতস্ত হয়ে সে। ভাবছে এরপরে কী হয়? মজাই লাগছে কিন্তু পিচ্চি মাকে দেখে।
ওমা। মা দেখি ঠিকমত খেতেও পারে না। এ কেমন ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া? তাছাড়া অর্ধেক খাবার নষ্ট করল। এভাবে খেলে লীলাবতীর খবরই হয়ে গেছিল।
কড়া করে ধমক দিল লীলাবতী।
--- এমন করে খাচ্ছ কেন? ঠিকমত খাও। খাওয়া শেষ হলে সিঙ্কে প্লেটটা ধুয়ে রাখবে কিন্তু।
নাক শিটকে মুখ বেকালো মা।
--- ইশ, আমি কেন ধুয়ে রাখব? আমি বাসায় কোনো কাজ করিনা!
হোয়াট! তবে মা যে কথায় কথায় লীলাবতীকে শুনিয়ে দেয় কত কাজ করত সে!
খাওয়া শেষে সোফার উপরে দড়াম করে বসল মা। পা নাচাতে নাচাতে বলল
--- টিভি দেখব।
টিভিটা অন করে দিল লীলাবতী। রিমোটটা মায়ের হাতে দিয়ে বলল
--- তুমি টিভি দেখো, আমি রেডি হচ্ছি।
--- কই যাবে?
--- বার্থ ডে পার্টি আছে।
--- কী মজা। আমিও যাব!
এ কেমন আবদার রে বাবা। লীলাবতী দোটানায় পড়ে গেল। কিছু না বলে রুমে গিয়ে চেঞ্জ করতে আরম্ভ করে দিল। মা নিশ্চয় কিছু বলবে না ভেবে মনের সুখে সেজে নিল লীলাবতী। ড্রয়িংরুম থেকে এত শব্দ আসছে! এত জোরে টিভি দেখলে মা খুব রাগ করে! এখন মা নিজেই…
হঠাত সব চুপচাপ। তারপরে ঝনঝন শব্দে কিছু ভাঙ্গার শব্দ।
তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখে সোফার পাশে সাইড টেবিলে রাখা মার ফেভারিট ক্রিস্টালের ফুলদানিটা টুকরা টুকরা হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। হায় হায়। এখন কী হবে?
--- কী হয়েছে? কী করে ভাঙল?
--- কীজানি। আমি টিভি দেখছিলাম। হঠাত ওটা পড়ে গেল।
--- নিজে থেকে? তুমি কিছু করো নি?
--- ইয়ে একটু হাত সোজা করতে গেছিলাম আরকি!
--- টিভি বন্ধ কেন? রিমোট কই?
--- রিমোটও ফুলদানির সাথে…
--- সর্বনাশ! রিমোটও ভেঙ্গে ফেলেছ?
--- ঐ আরকি।
--- মা দেখলে আমাকে মেরে ফেলবে।
বলেই মনে পড়ল মা নিজেই তো একাজ করেছে। যাক, কী আর করবে। তবে মাকে রেখে পার্টিতে যাওয়া মনেহয় ঠিক হবে না। দেখা যাবে পুরা বাড়িঘরের আর কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না মা।
--- চল ওঠো। পার্টিতে যাই আমরা।
সাথেসাথে একান ওকান হাসি দেখা গেল মায়ের। মার রুমের ক্লজেটে গিয়ে নিজের একটা দামী জামা বের করে দিল লীলাবতী।
--- যাও, বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে পরে নাও। দেখো, আবার জামা নষ্ট করে ফেলো না আবার। অনেক দামী জামা কিন্তু।
লীলাবতীর মনে হল মা যেন ওর মুখ দিয়ে কথা বলছে। হুবহু এই কথাগুলিই মা ওকে বলেছিল।
এতক্ষণে সত্যি মজা লাগল লীলাবতীর। মাকে ধমক দিয়ে সামলে সুমলে রাখতে হবে দেখি। নাহলে কী যে করে বসবে!
যাক, কাল পর্যন্ত সময় পাওয়া গেল। কাল বাবা বাড়িতে ফিরলে বাবাই বুঝবে বাকিটা।
*****
দরজা খুলে দিয়ে মাকে দেখে অহনা প্রশ্ন করল
--- ও কে রে?
--- আমার কাজিন সামিয়া।
--- সামিয়া?
--- হুম। ওর নামও সামিয়া রে। মার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছে।
--- তোর আবার কাজিন কই থেকে এল?
--- আরেহ। আজকেই জানতে পেয়েছি। চল, তোর কেক দেখি।
অহনাকে অন্য কথায় ব্যস্ত রাখতে চাইল লীলাবতী। সামিয়া ততক্ষণে অহনাদের বাগানের ফুল পটাপট ছিঁড়ছে। দেখতে পেয়ে এক ধমক লাগালো লীলাবতী।
--- অন্যের বাগানের ফুল না বলে ছিঁড়তে হয় না, জানো না বুঝি? চল চল, ভিতরে চল।
সামিয়াকে ঘরের মধ্যে ধেই ধেই করে ঢুকে যেতে দেখে আবার চ্যাচালো লীলাবতী
--- আরে আরে। জুতা পরে যাচ্ছ কেন? জুতা দরজার সামনে খুলে রাখো।
জুতা খুলতে খুলতেই মাকে কড়া করে বলে দিল লীলাবতী
--- গিয়ে ভদ্রভাবে থাকবে বলে দিলাম আমি। কোনো দুষ্টামি করতে যেন না দেখি।
সামিয়া কিছু বলল না।
--- শুনতে পেয়েছ আমি কী বললাম?
--- শুনেছি তো! আমি কালা নই!
--- আহ! ঠিকভাবে কথা বল! কী যে হচ্ছ না!
লীলাবতী নিজেকে অভিভাবকের ভূমিকায় খুব বেশি এঞ্জয় করছে যেন।
ড্রয়িংরুমে সবাই বসে রয়েছে। সামিয়া ঠাস করে একটা সোফায় বলতে গেলে আরেক মেয়ের কোলেই বসে পড়ছিল দেখে লীলাবতীও বাধ্য হল ওখানে থাকতে। খুব ইচ্ছা করছে ভিতরে গিয়ে দেখার, অহনার সাজগোজে সাহায্য করার। কিন্তু সাহস হল না। মা আবার কী করে বসে, কে জানে!
--- লীলাবতী! ভেতর থেকে অহনার গলা পাওয়া গেল। নিশ্চয় অবাক হয়েছে লীলাবতীকে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখে। উঠে পড়ল লীলাবতী। অহনার রুমে উঁকি দিতেই অহনা বলল
--- আমার বেণীতে ফুলের মালাটা জড়িয়ে দে তো, লীলাবতী।
অহনা পুরানো যুগের রাজকন্যা সেজেছে। টার্সেল দিয়ে লম্বা বেণী করে দিয়েছে ওর মা। এখন আন্টি খাবারের তদারকিতে চলে গেছে দেখে লীলাবতীকে ডেকে এনেছে অহনা।
অহনার সাথে গল্প করতে করতে ওর সাজে সাহায্য করতে গিয়ে অনেক্ষণ কাটিয়ে দিল লীলাবতী। হঠাত মনে পড়ে গেল মার কথা। ঝটপট বের হয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে যাচ্ছিল, করিডোরেই মা’কে পাওয়া গেল। একটা শিঙাড়া কচরমচর করে খাচ্ছে!
--- এ কী! কেক এখনো কাটা হয়নি, তুমি খাবার খেতে আরম্ভ করে দিলে কী মনে করে? ধমকে উঠল লীলাবতী। চট করে বাকিটা মুখে পুরে দিল সামিয়া।
--- গরম গরম ভেজে টেবিলে রাখা ছিল, আমি লোভ সামলাতে পারলাম না।
--- আশ্চর্য! এই না বাসা থেকে খেয়ে এলে? তাছাড়া কেক কাটবার আগে খাওয়া! একটা ভদ্রতা আছে না!
সন্দেহের দৃষ্টিতে মার দিকে তাকালো লীলাবতী।
--- অন্য হাত পিছনে রেখেছ কেন? দেখি কী আছে?
টেনে হাতটা সামনে আনতেই দেখে সে হাতে আরেকটা শিঙাড়া রয়েছে। সত্যি, মাকে নিয়ে কী যে করবে লীলাবতী!
--- অহনা! রেডি তুমি? চল কেক কাটবে!--- আন্টিকে করিডোরের দিকে এগিয়ে আসতে শোনা গেল। সামিয়ার হাতটা ধরে টান দিয়ে সামনের দরজা খুলে ঢুকে গেল লীলাবতী। এটা ওদের গেস্ট বেডরুম। এখানে আন্টি আসবে না আশা করা যায়। মাকে ধমক দিল লীলাবতী
--- এখন কী হবে? হাতে শিঙাড়া নিয়ে তুমি কেক কাটতে যাবে?
চট করে পুরা শিঙাড়া মুখে পুরে দিল সামিয়া। বলল
--- তা কেন? খেয়ে নিব!
হাঁ হয়ে গেল লীলাবতী!
--- মুখে খাবার নিয়ে কথা বলছ কেন? যাও, বাথরুমে ঢুকে হাত ধুয়ে আসো। হাতে তেল নিশ্চয়।
ভালোমানুষের মত বাথরুমে চলে গেল সামিয়া। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকল লীলাবতি। অহনা এখনি ওর খোঁজ করবে। প্রাণের বন্ধু ছাড়া ও কেক কাটবেই না।
সামিয়া হাতে পেট চেপে ধরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল। আশ্চর্য হয়ে গেল লীলাবতী।
--- কী হল?
--- পেট ব্যথা করছে আমার!
শুনে খুব বিরক্ত হল লীলাবতী।
--- কে তোমাকে এতকিছু খেতে বলেছিল।
বিছানায় লুটিয়ে পড়ল সামিয়া।
--- সত্যি বলছি। খুবি পেট ব্যথা করছে।
দ্রুত ভেবে নিল লীলাবতী। সামিয়ার গায়ে কম্ফর্টারটা টেনে দিতে দিতে বলল
--- তুমি তাহলে চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি চললাম। আমাকে যেতে হবে।
মুখ কুঁচকে সামিয়া জবাব দিল
--- আচ্ছা ঠিক আছে। উহঃ বাবা রে।
বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দিল লীলাবতী। বাবা রে বাবা। একটা বাচ্চার টেক কেয়ার করা যে কত ঝামেলা! ঠিকমতো পার্টি এঞ্জয় পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।
কেক কাটা হল, সবাই প্লেটে খাবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে খেতে খেতে গল্প করছে, হঠাত করে লীলাবতীর মার কথা মনে পড়ে গেল। দেখা দরকার কেমন আছে মা।
কিচেনে প্লেট রেখে গেস্ট বেডরুমের দরজা খুলে চক্ষুস্থির হয়ে গেল লীলাবতীর। এ কী! মা বিছানার উপরে লাফাচ্ছে কেন!
--- তোমার না পেট ব্যথা? তুমি না ব্যথায় নড়তে পারছিলে না?
লাফানো বন্ধ করে একগাল হেসে সামিয়া জবাব দিল
--- সেরে গেছে। এখন একদম ভালো আমি।
--- সেজন্য অন্যের বাড়িতে এসে বিছানায় লাফাচ্ছ? কী যে কর না তুমি! নামো, নামো বলছি!
সামিয়া নেমে পড়তেই বিছানা যতটা পারে গুছিয়ে ফেলল লীলাবতী। নাহ, মা’কে নিয়ে এখানে থাকা আর নিরাপদ না। কখন যে কী করে বসে মা! লীলাবতীও শান্তিতে পার্টি এঞ্জয় করতে পারছে না।
ওকে নিয়ে বেরিয়ে এল লীলাবতী। অহনাকে বলে এল
--- আমার কাজিনের খুব পেট ব্যথা রে অহনা। ওকে নিয়ে বাড়ি গেলাম আমি।
অহনাকে আশাহত দেখালো। সেইসাথে সামিয়ার মুখের বিশাল হাসি দেখে চেহারায় সন্দেহও ফুটে উঠল। কিন্তু অহনা কিছু বলবার আগেই মা’কে নিয়ে রওনা দিয়ে দিল লীলাবতী। কী যে একটা অবস্থা। মা’র যন্ত্রণায় দেখি অহনার সাথে ওর বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে যাবে!
বাসায় ফিরে ওকে মা’র জামাকাপড় থেকে একটা ঢলঢলে পাজামা আর টিশার্ট বের করে দিল। বলল
--- কাপড় বদলে নিয়ে শুয়ে পড়বে কিন্তু। তোমার দুষ্টুমি আমি আর নিতে পারছি না।
বাধ্য মেয়ের মত কাপড় বদলিয়ে বিছানার দিকে যেতেই লীলাবতী বকে উঠল
--- ও কী! যাও, দাঁত মেজে এসো।
মা’কে ভালোমত বিছানায় সেট করে দিয়ে নিজের রুমে এসে বড়সড় একটা নিঃশ্বাস নিল লীলাবতী। একবেলা মা’কে দেখেশুনে রেখেই টায়ার্ড হয়ে গিয়েছে ও। কোনোমতে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচে!
পরদিন সকাল। বাবা ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে বলল
--- সামিয়া! লীলাবতী! তোমরা এখনো ঘুমাচ্ছ? আমি ফিরে এলাম কি এমনি এমনি নাকি। কেউ নাই আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য!
সামিয়া নিজের রুম থেকে বের হতে হতে বলল
--- উফ, সত্যি। কী মরার মতো ঘুমিয়েছিলাম আমি। কেন জানি খুব টায়ার্ড লাগছিল।
পুর্ণবয়স্ক সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বাবা প্রশ্ন করল
--- লীলাবতী কই?
বিরক্তমুখে মা জবাব দিল
--- ঘুমাচ্ছে নিশ্চয়। এত দেরী করে ওঠে প্রতিদিন! আমাদের বয়সে আমরা…
--- শুরু হয়ে গেল মা’র বড়বড় বুলি। আধাঘুমের মধ্যেই হাসল লীলাবতী।--- তুমি যে কী বিচ্ছু ছিলে, জানা আছে আমার!
(সমাপ্ত)
--- তুমি নিশ্চয় বিছানা না করে বের হয়েছ?
বিড়বিড় করে কী জবাব দিল লীলাবতী। শুনতে না পেয়ে ফের চিল্লায়ে উঠল সামিয়া
--- কী? করেছ বিছানা?
--- না, মা। অপরাধীর মত মুখ করে উত্তর দিল লীলাবতী।
--- তা করবে কেন? সারাদিন বিছানা ওলটপালট হয়ে পড়ে থাকবে, ফিরেও তাকাবে না।
এইটা মা একটু বেশিবেশি বলল। লীলাবতী দাঁত মেজে নিয়ে ঠিকই বিছানাটা করে ফেলত।
--- জানো, আমরা আর কী কী করতাম?
জবাব দিল না লীলাবতী। জানা কথা এখন লিস্টি ধরে মার অশেষ গুণাগুণ একে একে বেরুবে। সত্যি, এতটাই কি ছিল মা? কে জানে? ওরা থাকে বিদেশে। নানা নানীও মারা গেছেন। সামিয়া এক সন্তান হবার সুবাদে লীলাবতীর খালা মামাও নাই যে জিজ্ঞেস করবে। তাই মার মুখে মারিতং বাঘ নীরবে হজম করতে হয় লীলাবতীকে।
সামিয়া বলতে থাকে
--- বিছানা করার পর ঘর গুছাতাম। মাকে হেল্প করতাম। অনেক কাজ করতাম আমি। তোমার মত ঠ্যাঙের উপরে ঠ্যাং তুলে বসে থাকতাম না।
--- মা, আমি ঠ্যাঙের উপরে ঠ্যাঙ তুলে বসে থাকি? তাহলে পড়াশুনা, খেলাধুলা, গান শেখা এসব করে কে?
--- সেসব আমরাও করতাম। এককথায় উড়িয়ে দিল কথাটা সামিয়া।
এবারে মোক্ষম কামড় দিল লীলাবতী
--- আসলে মা, তুমি যতটা বলছ, ততোটা ভালো কি সত্যি ছিলে?
--- কী ইইই? মাকে নিয়ে সন্দেহ? জানো, আমরা ছোট থাকতে…
এবারে সামিয়াকে কথাটা শেষ করতে দিল না লীলাবতী।
--- সত্যি মা! আমি সত্যি দেখতে চাই, আমার বয়সে তুমি কী করতে!
সামিয়াও ঠিক একই সময়ে বলল
--- যদি দেখাতে পারতাম তোমার বয়সে আমি কী করতাম!
হুট করে কী যে হয়ে গেল, ভালো করে বুঝল না লীলাবতী। ওর মাথাটা ঘুরে উঠল নাকি ঘরবাড়ি দুলে উঠল, ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু সে এক সেকেন্ডের জন্য। পরমুহূর্তে আবার যে কে সেই।
লীলাবতী তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেল। বের হয়ে বিছানা করে রুম গুছিয়ে ফেলল। আজ ওর বেস্ট ফ্রেন্ড অহনার বার্থ ডে। অহনাদের বাসা কাছেই। বিকালে যাবে লীলাবতী। মাকে শুধুশুধু চটিয়ে লাভ নাই। ভালোয়ভালোয় বিকাল হয়ে যাক, মা রেগে থাকলে হয়ত বলেই বসবে
--- থাক, তোমার বার্থ ডে পার্টিতে যেতে হবে না।
অংক নিয়ে বসল লীলাবতী। মাকে ইম্প্রেস করার জন্য। হুট করে ঘরে ঢুকল সামিয়া।
--- লীলু, নাস্তা খেলে না?
বাহ! মার রাগ আর নাই দেখি। কখন কী মতি হয়! উফ!
--- এই তো, মা। একটু পড়ে নেই।
কিছুক্ষণ পরে নাস্তার প্লেট হাতে ফিরে এল সামিয়া।
--- নাও, খেয়ে নাও।
আশ্চর্য হয়ে গেল লীলাবতী। মা ঘরে খাওয়াদাওয়া একদম পছন্দ করে না।
--- আমি একটু শুতে গেলাম, বুঝেছ? শরীরটা কেমন জানি করছে। তোমার বাবাও কালকের আগে ফিরবে না। যদি ঘুমিয়ে থাকি ফ্রিজে তোমার লাঞ্চ রাখা আছে। জাস্ট মাইক্রোওয়েভে একটু গরম করে নিও, কেমন?
বাধ্য মেয়ের মত মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল লীলাবতী। মা চলে যেতেই অহনার কল। রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করল
--- আজ কী পরে আসবি, লীলাবতী?
কোথায় অংক, কোথায় কী। দুই বান্ধবী বিকালের পার্টি নিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করে দিল।
দুপুর তিনটা। মা এখনো ওঠেনি। গোসলে যাচ্ছিল লীলাবতী। মার রুমের সামনে দিয়ে যেতে একঝলক তাকিয়ে দেখে মা কেমন অদ্ভুত ভঙ্গীতে শুয়ে আছে। খেয়াল না করে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। ফিরে এসে মার রুমে ঢুকে ক্লজেটে তুলে রাখা পোশাকি জামা নিতে গেছে, বিছানার দিকে তাকিয়ে আক্কেল গুড়ুম!
মার বিছানায় এ কে শুয়ে রয়েছে?
ওর বয়সী একটা মেয়ে। চেহারাটা কেমন চেনাচেনা লাগছে। কিন্তু ও মার বিছানায় কী করছে? কাপড়ও পরেছে মার সাইজের! এ কী কথা! এ তো মারই কাপড়!
--- মা আ আ আ!
চিতকার করে উঠল লীলাবতী। মা জবাব দিল না। কিন্তু চিতকারে মেয়েটা ঘুম ভেঙ্গে চমকে উঠে বসল।
--- তুমি কে?
চোখ কচলে ঘুম তাড়ালো মেয়েটা
--- আমি সামিয়া।
--- কী বললে?
একটু বিরক্ত হল মেয়েটা
--- বললাম তো আমি সামিয়া। আমার নাম জানতে চাইলে না? নাম বললাম।
লীলাবতীর মাথাটা দ্বিতীয়বারের মত চক্কর দিয়ে উঠল যেন। ঘুরে দৌড়ে পুরা বাড়ি চেক করে দেখল। নাহ, কোথাও নাই মা।
তবে কী? তবে কী সে যা ভাবছে…
আর ভাবতে পারল না।
কী করে সম্ভব এ? সায়েন্স একে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে?
ভয়েভয়ে ফিরে এল লীলাবতী সামিয়ার রুমে। দেখে মেয়েটা তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দিব্যি চুল আঁচড়াচ্ছে। ভয় পেয়েছে বা কোনো প্রশ্ন ওর মনে এসেছে বলে তো মনে হয় না। লীলাবতীকে দেখে প্রশ্ন করল
--- তোমার নাম কী?
--- লীলাবতী। নিজের মাকে নাম বলতে পেরে খুবি অদ্ভুত এক অনুভূতি হল লীলাবিতীর।
--- তোমার নাম সত্যি সামিয়া?
--- কী আশ্চর্য! নিজের নাম আমি জানব না? তোমার কি বুদ্ধি একটু কম নাকি?
বাব্বাহ! এভাবে কথা বলত মা? এভাবে কথা বললে তো মা ওকে মেরেই ফেলবে।
--- নাহ। প্রথমবার ঠিকভাবে শুনতে পাইনি আরকি!
--- খাবার আছে কিছু? আমার খুব খিদে পেয়েছে।
--- আছে তো। আমার সাথে এসো।
ফ্রিজ খুলে প্লেট বের করে মাইক্রোওভেনে গরম করে মাকে খেতে দিল লীলাবতী। এতক্ষণে একটু ধাতস্ত হয়ে সে। ভাবছে এরপরে কী হয়? মজাই লাগছে কিন্তু পিচ্চি মাকে দেখে।
ওমা। মা দেখি ঠিকমত খেতেও পারে না। এ কেমন ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া? তাছাড়া অর্ধেক খাবার নষ্ট করল। এভাবে খেলে লীলাবতীর খবরই হয়ে গেছিল।
কড়া করে ধমক দিল লীলাবতী।
--- এমন করে খাচ্ছ কেন? ঠিকমত খাও। খাওয়া শেষ হলে সিঙ্কে প্লেটটা ধুয়ে রাখবে কিন্তু।
নাক শিটকে মুখ বেকালো মা।
--- ইশ, আমি কেন ধুয়ে রাখব? আমি বাসায় কোনো কাজ করিনা!
হোয়াট! তবে মা যে কথায় কথায় লীলাবতীকে শুনিয়ে দেয় কত কাজ করত সে!
খাওয়া শেষে সোফার উপরে দড়াম করে বসল মা। পা নাচাতে নাচাতে বলল
--- টিভি দেখব।
টিভিটা অন করে দিল লীলাবতী। রিমোটটা মায়ের হাতে দিয়ে বলল
--- তুমি টিভি দেখো, আমি রেডি হচ্ছি।
--- কই যাবে?
--- বার্থ ডে পার্টি আছে।
--- কী মজা। আমিও যাব!
এ কেমন আবদার রে বাবা। লীলাবতী দোটানায় পড়ে গেল। কিছু না বলে রুমে গিয়ে চেঞ্জ করতে আরম্ভ করে দিল। মা নিশ্চয় কিছু বলবে না ভেবে মনের সুখে সেজে নিল লীলাবতী। ড্রয়িংরুম থেকে এত শব্দ আসছে! এত জোরে টিভি দেখলে মা খুব রাগ করে! এখন মা নিজেই…
হঠাত সব চুপচাপ। তারপরে ঝনঝন শব্দে কিছু ভাঙ্গার শব্দ।
তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখে সোফার পাশে সাইড টেবিলে রাখা মার ফেভারিট ক্রিস্টালের ফুলদানিটা টুকরা টুকরা হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। হায় হায়। এখন কী হবে?
--- কী হয়েছে? কী করে ভাঙল?
--- কীজানি। আমি টিভি দেখছিলাম। হঠাত ওটা পড়ে গেল।
--- নিজে থেকে? তুমি কিছু করো নি?
--- ইয়ে একটু হাত সোজা করতে গেছিলাম আরকি!
--- টিভি বন্ধ কেন? রিমোট কই?
--- রিমোটও ফুলদানির সাথে…
--- সর্বনাশ! রিমোটও ভেঙ্গে ফেলেছ?
--- ঐ আরকি।
--- মা দেখলে আমাকে মেরে ফেলবে।
বলেই মনে পড়ল মা নিজেই তো একাজ করেছে। যাক, কী আর করবে। তবে মাকে রেখে পার্টিতে যাওয়া মনেহয় ঠিক হবে না। দেখা যাবে পুরা বাড়িঘরের আর কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না মা।
--- চল ওঠো। পার্টিতে যাই আমরা।
সাথেসাথে একান ওকান হাসি দেখা গেল মায়ের। মার রুমের ক্লজেটে গিয়ে নিজের একটা দামী জামা বের করে দিল লীলাবতী।
--- যাও, বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে পরে নাও। দেখো, আবার জামা নষ্ট করে ফেলো না আবার। অনেক দামী জামা কিন্তু।
লীলাবতীর মনে হল মা যেন ওর মুখ দিয়ে কথা বলছে। হুবহু এই কথাগুলিই মা ওকে বলেছিল।
এতক্ষণে সত্যি মজা লাগল লীলাবতীর। মাকে ধমক দিয়ে সামলে সুমলে রাখতে হবে দেখি। নাহলে কী যে করে বসবে!
যাক, কাল পর্যন্ত সময় পাওয়া গেল। কাল বাবা বাড়িতে ফিরলে বাবাই বুঝবে বাকিটা।
*****
দরজা খুলে দিয়ে মাকে দেখে অহনা প্রশ্ন করল
--- ও কে রে?
--- আমার কাজিন সামিয়া।
--- সামিয়া?
--- হুম। ওর নামও সামিয়া রে। মার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছে।
--- তোর আবার কাজিন কই থেকে এল?
--- আরেহ। আজকেই জানতে পেয়েছি। চল, তোর কেক দেখি।
অহনাকে অন্য কথায় ব্যস্ত রাখতে চাইল লীলাবতী। সামিয়া ততক্ষণে অহনাদের বাগানের ফুল পটাপট ছিঁড়ছে। দেখতে পেয়ে এক ধমক লাগালো লীলাবতী।
--- অন্যের বাগানের ফুল না বলে ছিঁড়তে হয় না, জানো না বুঝি? চল চল, ভিতরে চল।
সামিয়াকে ঘরের মধ্যে ধেই ধেই করে ঢুকে যেতে দেখে আবার চ্যাচালো লীলাবতী
--- আরে আরে। জুতা পরে যাচ্ছ কেন? জুতা দরজার সামনে খুলে রাখো।
জুতা খুলতে খুলতেই মাকে কড়া করে বলে দিল লীলাবতী
--- গিয়ে ভদ্রভাবে থাকবে বলে দিলাম আমি। কোনো দুষ্টামি করতে যেন না দেখি।
সামিয়া কিছু বলল না।
--- শুনতে পেয়েছ আমি কী বললাম?
--- শুনেছি তো! আমি কালা নই!
--- আহ! ঠিকভাবে কথা বল! কী যে হচ্ছ না!
লীলাবতী নিজেকে অভিভাবকের ভূমিকায় খুব বেশি এঞ্জয় করছে যেন।
ড্রয়িংরুমে সবাই বসে রয়েছে। সামিয়া ঠাস করে একটা সোফায় বলতে গেলে আরেক মেয়ের কোলেই বসে পড়ছিল দেখে লীলাবতীও বাধ্য হল ওখানে থাকতে। খুব ইচ্ছা করছে ভিতরে গিয়ে দেখার, অহনার সাজগোজে সাহায্য করার। কিন্তু সাহস হল না। মা আবার কী করে বসে, কে জানে!
--- লীলাবতী! ভেতর থেকে অহনার গলা পাওয়া গেল। নিশ্চয় অবাক হয়েছে লীলাবতীকে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখে। উঠে পড়ল লীলাবতী। অহনার রুমে উঁকি দিতেই অহনা বলল
--- আমার বেণীতে ফুলের মালাটা জড়িয়ে দে তো, লীলাবতী।
অহনা পুরানো যুগের রাজকন্যা সেজেছে। টার্সেল দিয়ে লম্বা বেণী করে দিয়েছে ওর মা। এখন আন্টি খাবারের তদারকিতে চলে গেছে দেখে লীলাবতীকে ডেকে এনেছে অহনা।
অহনার সাথে গল্প করতে করতে ওর সাজে সাহায্য করতে গিয়ে অনেক্ষণ কাটিয়ে দিল লীলাবতী। হঠাত মনে পড়ে গেল মার কথা। ঝটপট বের হয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে যাচ্ছিল, করিডোরেই মা’কে পাওয়া গেল। একটা শিঙাড়া কচরমচর করে খাচ্ছে!
--- এ কী! কেক এখনো কাটা হয়নি, তুমি খাবার খেতে আরম্ভ করে দিলে কী মনে করে? ধমকে উঠল লীলাবতী। চট করে বাকিটা মুখে পুরে দিল সামিয়া।
--- গরম গরম ভেজে টেবিলে রাখা ছিল, আমি লোভ সামলাতে পারলাম না।
--- আশ্চর্য! এই না বাসা থেকে খেয়ে এলে? তাছাড়া কেক কাটবার আগে খাওয়া! একটা ভদ্রতা আছে না!
সন্দেহের দৃষ্টিতে মার দিকে তাকালো লীলাবতী।
--- অন্য হাত পিছনে রেখেছ কেন? দেখি কী আছে?
টেনে হাতটা সামনে আনতেই দেখে সে হাতে আরেকটা শিঙাড়া রয়েছে। সত্যি, মাকে নিয়ে কী যে করবে লীলাবতী!
--- অহনা! রেডি তুমি? চল কেক কাটবে!--- আন্টিকে করিডোরের দিকে এগিয়ে আসতে শোনা গেল। সামিয়ার হাতটা ধরে টান দিয়ে সামনের দরজা খুলে ঢুকে গেল লীলাবতী। এটা ওদের গেস্ট বেডরুম। এখানে আন্টি আসবে না আশা করা যায়। মাকে ধমক দিল লীলাবতী
--- এখন কী হবে? হাতে শিঙাড়া নিয়ে তুমি কেক কাটতে যাবে?
চট করে পুরা শিঙাড়া মুখে পুরে দিল সামিয়া। বলল
--- তা কেন? খেয়ে নিব!
হাঁ হয়ে গেল লীলাবতী!
--- মুখে খাবার নিয়ে কথা বলছ কেন? যাও, বাথরুমে ঢুকে হাত ধুয়ে আসো। হাতে তেল নিশ্চয়।
ভালোমানুষের মত বাথরুমে চলে গেল সামিয়া। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকল লীলাবতি। অহনা এখনি ওর খোঁজ করবে। প্রাণের বন্ধু ছাড়া ও কেক কাটবেই না।
সামিয়া হাতে পেট চেপে ধরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল। আশ্চর্য হয়ে গেল লীলাবতী।
--- কী হল?
--- পেট ব্যথা করছে আমার!
শুনে খুব বিরক্ত হল লীলাবতী।
--- কে তোমাকে এতকিছু খেতে বলেছিল।
বিছানায় লুটিয়ে পড়ল সামিয়া।
--- সত্যি বলছি। খুবি পেট ব্যথা করছে।
দ্রুত ভেবে নিল লীলাবতী। সামিয়ার গায়ে কম্ফর্টারটা টেনে দিতে দিতে বলল
--- তুমি তাহলে চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি চললাম। আমাকে যেতে হবে।
মুখ কুঁচকে সামিয়া জবাব দিল
--- আচ্ছা ঠিক আছে। উহঃ বাবা রে।
বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দিল লীলাবতী। বাবা রে বাবা। একটা বাচ্চার টেক কেয়ার করা যে কত ঝামেলা! ঠিকমতো পার্টি এঞ্জয় পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।
কেক কাটা হল, সবাই প্লেটে খাবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে খেতে খেতে গল্প করছে, হঠাত করে লীলাবতীর মার কথা মনে পড়ে গেল। দেখা দরকার কেমন আছে মা।
কিচেনে প্লেট রেখে গেস্ট বেডরুমের দরজা খুলে চক্ষুস্থির হয়ে গেল লীলাবতীর। এ কী! মা বিছানার উপরে লাফাচ্ছে কেন!
--- তোমার না পেট ব্যথা? তুমি না ব্যথায় নড়তে পারছিলে না?
লাফানো বন্ধ করে একগাল হেসে সামিয়া জবাব দিল
--- সেরে গেছে। এখন একদম ভালো আমি।
--- সেজন্য অন্যের বাড়িতে এসে বিছানায় লাফাচ্ছ? কী যে কর না তুমি! নামো, নামো বলছি!
সামিয়া নেমে পড়তেই বিছানা যতটা পারে গুছিয়ে ফেলল লীলাবতী। নাহ, মা’কে নিয়ে এখানে থাকা আর নিরাপদ না। কখন যে কী করে বসে মা! লীলাবতীও শান্তিতে পার্টি এঞ্জয় করতে পারছে না।
ওকে নিয়ে বেরিয়ে এল লীলাবতী। অহনাকে বলে এল
--- আমার কাজিনের খুব পেট ব্যথা রে অহনা। ওকে নিয়ে বাড়ি গেলাম আমি।
অহনাকে আশাহত দেখালো। সেইসাথে সামিয়ার মুখের বিশাল হাসি দেখে চেহারায় সন্দেহও ফুটে উঠল। কিন্তু অহনা কিছু বলবার আগেই মা’কে নিয়ে রওনা দিয়ে দিল লীলাবতী। কী যে একটা অবস্থা। মা’র যন্ত্রণায় দেখি অহনার সাথে ওর বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে যাবে!
বাসায় ফিরে ওকে মা’র জামাকাপড় থেকে একটা ঢলঢলে পাজামা আর টিশার্ট বের করে দিল। বলল
--- কাপড় বদলে নিয়ে শুয়ে পড়বে কিন্তু। তোমার দুষ্টুমি আমি আর নিতে পারছি না।
বাধ্য মেয়ের মত কাপড় বদলিয়ে বিছানার দিকে যেতেই লীলাবতী বকে উঠল
--- ও কী! যাও, দাঁত মেজে এসো।
মা’কে ভালোমত বিছানায় সেট করে দিয়ে নিজের রুমে এসে বড়সড় একটা নিঃশ্বাস নিল লীলাবতী। একবেলা মা’কে দেখেশুনে রেখেই টায়ার্ড হয়ে গিয়েছে ও। কোনোমতে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচে!
পরদিন সকাল। বাবা ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে বলল
--- সামিয়া! লীলাবতী! তোমরা এখনো ঘুমাচ্ছ? আমি ফিরে এলাম কি এমনি এমনি নাকি। কেউ নাই আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য!
সামিয়া নিজের রুম থেকে বের হতে হতে বলল
--- উফ, সত্যি। কী মরার মতো ঘুমিয়েছিলাম আমি। কেন জানি খুব টায়ার্ড লাগছিল।
পুর্ণবয়স্ক সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বাবা প্রশ্ন করল
--- লীলাবতী কই?
বিরক্তমুখে মা জবাব দিল
--- ঘুমাচ্ছে নিশ্চয়। এত দেরী করে ওঠে প্রতিদিন! আমাদের বয়সে আমরা…
--- শুরু হয়ে গেল মা’র বড়বড় বুলি। আধাঘুমের মধ্যেই হাসল লীলাবতী।--- তুমি যে কী বিচ্ছু ছিলে, জানা আছে আমার!
(সমাপ্ত)
Comments
Post a Comment