সাদিয়া সুলতানার গল্প

 বন্ধু বন্ধুই 



 

 ১.

 
তদিন পর স্কুল খুলবে! এ কথা ভাবলেই সাদমানের বুকের ঠিক মাঝখানে কেমন কেমন করছে। এক সপ্তাহ ধরে কত কী যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সাদমান কাউকে বলতেও পারছে না। আর কাকেই বা বলবে। অফিস থেকে ফিরে বাবা-মা তো ওর স্কুলড্রেস, জুতো, ব্যাগ, সুরক্ষা সামগ্রী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

সাদমানের বুকের ভেতরটা অভিমানে গমগম করে ওঠে। এক পা দুই পা করে ও আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইস, ও কত বদলে গেছে! দাদা-দাদি বলে ও হাত পায়ে লম্বা হয়ে গেছে, চেহারাও বদলে গেছে। আনান বলে, 'এই দেড় বছর ঘরে থেকে থেকে তোর তো ভুঁড়ি হয়ে গেছে রে। কোন আইসক্রিমটা আর খাসনে, আমাকে দে।'

এই নিয়ে প্রতিদিনই আনানের সঙ্গে বিচ্ছিরি ঝগড়া হয় সাদমানের। এতদিন স্কুল বন্ধ হয়ে ঘরে থাকায় ভাইবোনের ঝগড়ার মাত্রা বেড়ে গেছে।

বাবা মাঝেমধ্যে রেগে ওঠে, বলে, 'এভাবে স্কুল বন্ধ থাকলে বাচ্চাকাচ্চা কী করে মানুষ হবে? কোনো সৃজনশীল কাজ নেই খালি টিভি আর গেমস নিয়ে বসে থাকা।'

বাবার কথায় সামান্য ভুল আছে। ওরা দুই ভাইবোন সারাক্ষণ তো আর টিভি, গেমস এসব নিয়ে থাকে না। এই সকালে পড়া শেষ হবার পর, খাওয়ার পর, বিকালে খেলার সময়ে, সন্ধ্যায় ঘুমানোর পর, রাতে শোবার আগে...এই তো। এই সময়ে শুধু একটু টিভি দেখে আর মোবাইলে গেমস খেলে।

সময়ের হিসেব করে সাদমান দাঁতে জিভ কাটে, তাই তো প্রায় সারাক্ষণই ওরা টিভি বা মোবাইল নিয়ে থাকে। কিন্তু আর কী করবে? করোনা ভাইরাস আতঙ্কে তো বাবা-মা এখন কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায় না। এমনকি ক্রিকেট খেলার মাঠে পর্যন্ত না। স্কুলও নেই। ঘরে ঘুরেফিরে শুধু আনানের সঙ্গে ঝগড়া করো, অনলাইন ক্লাস করো আর খাও।

এই খেতে খেতেই তো সাদমান এমন বড় আর লম্বা হয়ে গেল। এখন এই নিয়ে ওর চিন্তার শেষ নেই।

এই যে ঘরে থেকেই ও নতুন ক্লাসে উঠলো, একদিনও স্কুলে যাওয়া হলো না। এখন যে বারো তারিখে স্কুল খুলবে, এতদিন পর স্কুলে যাবে, ওর প্রাণের বন্ধুরা কি ওকে চিনতে পারবে?

কী করে চিনবে? সাদমান কি আর ক্লাস থ্রির ছোট সাদমান আছে? স্কুল প্যান্ট, শার্ট কিছুই তো ওর গায়ে লাগছে না, এমনকি জুতাও না। সব নতুন করে বানাতে বা কিনতে হলো। এমন যে বড় হয়ে গেল ও, স্বাস্থ্য আর চেহারা সবই পাল্টে গেল। সাকিব, রায়হান, শিমুল, মনি, টগর, পাপ্পু কেউই তো ওকে চিনতেই পারবে না। ও নিজেও কি বন্ধুদের চিনতে পারবে? এর ওপরে আবার স্কুল থেকে নোটিশ দিয়েছে, মাস্ক ছাড়া ক্লাসে যাওয়া যাবে না।

মুখ মাস্কে ঢেকে রাখলে ওরা কে কাকে চিনবে? আর নতুন ক্লাসরুমই বা চিনবে কী করে। এসব ভেবে ভেবে এবার সাদমানের কান্না পায়। বালিশে মুখ গুঁজে ও কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে টেরই পায় না।



২.

স্কুলের সামনে একদম ভিড় নেই। আগে একদম ঠেলাঠেলি করে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতো। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে তাদের অভিভাবকও থাকতো। এখন একজন দুজন করে ছাত্র ছাত্রী ভেতরে ঢুকছে। সবার বাবা-মাও দূর থেকে ওদের বিদায় জানাচ্ছে।

আজ স্কুল গেটটাও অন্যরকম লাগছে। গেটের দুই পাশে বড় বড় হার্ডবোর্ডে রঙিন ছবি লাগানো হয়েছে, ছবিতে স্কুল ব্যাগ কাঁধে দুজন ছেলে-মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, পাশে লেখা আছে, ‘হৈ হৈ রৈ রৈ, স্কুল আবার খুললো ঐ।’

সাদমানের বুকের ভেতরেও হৈ হৈ রৈ রৈ করছে। সবকিছু কেমন নতুন লাগছে, যেন ও আজই প্রথম স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাবা শক্তহাতে ওর হাত ধরে রেখেছে। সাদমান বাবার হাতের ওপরে হাতের চাপ বাড়াতেই ‍বাবা বলল, ‘কীরে ভয় করছে তোর? বুক ধুকপুক করছে? বন্ধুদের পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।’

সাদমান এবার অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। বাবা কী করে ওর মনের কথা টের পেলো? অবাক ভাব কাটতে না কাটতেই আবার অবাক হয় সাদমান, দূর থেকে হাত উঁচু করে একটা ছেলে ওকে ডাকছে, ‘এ্যাই সাদমান, কী রে কেমন আছিস?’

আরেকটি ছেলেও এগিয়ে আসছে ওর দিকে। কাছাকাছি এসে ছেলেটা চিৎকার করে ওঠে, ‘সাদমান…তুই কেমন আছিস? কতদিন তোকে দেখি না!’

আরে, এ তো রায়হান! আর ঐ তো টগর! ওরা কী করে সাদমানকে চিনে ফেললো!

সাদমান তো মুখে মাস্ক পরেছে। আরেকটা কাজ করেছে ও। বাসা থেকে বের হবার সময় ইচ্ছে করে ওর নেমব্যাচ খুলে পকেটে রেখেছে। মনে মনে খুব গোপনে ভেবেছে, দেখা যাক বন্ধুরা কেউ নাম না দেখেই ওকে চিনতে পারে কিনা।

রায়হান আর টগর তো ওকে সত্যিই চিনে ফেলেছে! সাদমানের মন ভালো হয়ে যায় মুহূর্তেই। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু এখন তো সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সতর্ক হয়ে ক্লাস করতে হবে। মনে পড়তেই সাদমান টগর আর রায়হানের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

রায়হান বলে, ‘আয় বন্ধু দূর থেকেই হাতে হাত মিলাই।’

ওরা তিনজন হাওয়ায় হাত বাড়িয়ে ধরে। একে একে শিমুল, মনি, পাপ্পুও এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সাকিবকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রায়হান বলে, ‘তুই কাকে খুঁজছিস সাদমান?’

সাদমান বলে, ‘সাকিবকে দেখতে পাচ্ছি না। ও কি আমাদের চিনতে পারছে না?’

টগর সাদমানের কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, ‘তুই কি যে বলিস না, সত্যিকারের বন্ধু কি বন্ধুকে ভুলতে পারে?’

টগরের কথা শুনে সাদমানের মনে প্রশান্তির হাওয়া লাগে। বন্ধুদের সঙ্গে মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ও ভাবে, আসলেই বন্ধু কি কখনো বন্ধুকে ভুলতে পারে? বন্ধু তো বন্ধুই।

 

 


Comments

  1. শিশুদের মনোজগতে প্রবেশের মতো কোমল মন না থাকলে এমন শিশুতোষ গল্প বের হবে না। এহসানের কাহিনী শুনে ওদের ভেতর যেভাবে মিশে গেছেন সবাই তা পারে না। বড়োদের পাশাপাশি শিশুতোষ লেখাও আরও চাই

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা