নাফিসা নাহিয়ানের গল্প

অপেক্ষা

  



যুগে যুগে জড়বস্তু নিয়ে কম গল্প লেখা হয়নি। আবার এমন অনেক গল্পও রয়েছে যেগুলোতে জড়বস্তুর মতো তুচ্ছ জিনিস দ্বিতীয়টি নেই। আমার এই গল্পটিতে জড়বস্তুর ভূমিকা আছে, আবার নেই। গল্পটি শুরু হবে একটা বাসস্ট্যান্ড থেকে, বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চটা থেকে।

সকাল ৮ঃ০০ টা বাজে, মজনু মিয়া বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। আশেপাশে ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করছেনা।

এতটুকু পড়েই অনেক পাঠক বুঝতে পারছেন মজনু মিয়া একজন গৃহহীন মানুষ। কিছুটা ঠিকই। তবে তার একটা ঘর আছে, একটা পরিবারও আছে। মূলত তাদের কারণেই বাড়িঘর ফেলে সে একটা ছাউনি দেয়া বাসস্ট্যান্ডে।

পেশায় মজনু একজন রিকশাচালক। একটা জরাজীর্ণ, আধভাঙা রিকশার মালিক সে। তার শরীরের অবস্থাও তার রিক্সার মতো। নইলে এমন ব্যস্ত সময়ে যেখানে কোনো রিকশাওয়ালাকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা সেই সময় সে ঘুমাচ্ছে।

মজনুর শরীরে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে ডাক্তার বলে দিয়েছে ভালো বিশ্রাম আর চিকিৎসা দরকার যাতে অনেক টাকার প্রয়োজন। প্রায় সবসময়ই সে দুর্বল থাকে। তাই ঠিকমত রিকশা চালাতে পারে না। প্রায় সারাদিনই দিনই তাকে বাসস্ট্যান্ডে পাওয়া যায়। আজও তাকে সেখানেই পাওয়া যাবে তবে আজ সে খুব আরামে না ঘুমালেও তার মনে অনেক শান্তি রয়েছে। তার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে তার পোষা কুকুরটা, অনেক দিন পর পেট ভরে খেতে পেয়েছে দুজনই।

কারণটা জানতে হলে একদিন পেছনে যেতে হবে। যেটা কেবল গল্প বা নাটক সিনেমায় সম্ভব। এটা একটা গল্প তাই যাওয়া যেতেই পারে। 

ভরদুপুরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মজনু মিয়া রাস্তার ধারে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক দিন পর রিকশা নিয়ে বের হয়েছে সে। এমন সময় একজন লোক তার রিক্সায় উঠলো। তার ক্লান্ত ভঙ্গিতে রিকশা চালানো দেখে তার খুব মায়া হলো। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। কেবল নামার সময় বেশকিছু টাকা তার হাতে দিয়ে তাকে অপার বিস্ময়ে রেখে নেমে গেলো। স্তম্ভিত মজনু সেদিন দুপুরে পেটপুরে ভাত খেল। তার কুকুরটাকে খাওয়ালো। রাতে ভরাপেটে ঘুমালো।

পরদিন সকালে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সে তার পরিবারকে শহরে নিয়ে এনে রাখবে। মেয়েটাকে স্কুলে পড়াবে। এইসব সুখচিন্তা করতে করতে সে অন্যমনস্কভাবে রাস্তার মাঝে চলে আসলো। একটা ট্রাক আর বাংলাদেশে রোড এক্সিডেন্টে আরও একটা স্পট ডেড....তার পরিচয় হয়তো জানা যাবে না।

তাই তার পরিবার হয়তো কিছুই জানতে পারবে না। তারা চিরকাল অপেক্ষাতেই থাকবে। তার কুকুরটাও তার অপেক্ষায় থাকবে। আর একটা প্রানহীন জড়বস্তুও তার অপেক্ষায় থাকবে। সেটা হল সেই বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চটা। হয়তো থাকবে আবার থাকবে না। এটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে।

শুরুতেই বলেছিলাম আমার গল্পে জড়বস্তুগুলোর ভূমিকা আছে, আবার নেই।




Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা