নিবেদিতা আইচের গল্প
ঝিল্লী মানে তো পোকা। ঝিঁঝিঁ পোকা৷
মোটেও না।
ঝিল্লী মানে পো-কা, পো-কা!
তুই একটা বোকা।
ঝিল্লী, তুই একটা বিল্লি।
ঝিল্লী এবার খেলার মাঠ থেকে একছুট লাগায়। ছুটতে ছুটতে ভীষণ কান্না পায় ওর। রোজ রোজ এমন নাজেহাল হতে আর ভালো লাগে না। আজকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে জরুরি মিটিংয়ে বসতে হবে তার। কী বাজে একটা নাম রেখেছে! নাম দেবার সময় পছন্দ হয়েছে কিনা একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি ওকে। আচ্ছা ঝিল্লী তখন কি খুব বেশি ছোটো ছিল? কথা বলতেও শেখেনি? তাতে কি! জিজ্ঞেস করলেই ও মাথা নেড়ে তীব্র আপত্তি জানিয়ে দিতে পারত। বাবা মা একদম বোকা।
স্কুলবাসে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে ঝিল্লী। আগামীকাল থেকে শীতের ছুটি শুরু হতে যাচ্ছে। এ কথা মনে হতেই একটু ভালো লাগে ওর। বেশ হয়েছে আগামী একমাস কোনো রকম বাজে কথা শুনতে হবে না। ওদের ক্লাসের অন্তুটা না একদম বাজে। পিংকি, তুষ্টি, বুবুনটাও। সারাক্ষণ পোকা পোকা করছে ওকে।
তিতলি আপুও কম দুষ্টু নয়। পাশের সিট থেকে ওর গালে টোকা দিয়ে যাচ্ছে অযথাই। তিতলি আপু সুযোগ পেলে ওকে খ্যাপায়। তাই ওকে কিছুতেই বলা যাবে না অন্তু,পিংকি, বুবুনরা কী বলেছে। তিতলি আপু মুখ গম্ভীর করে বলবে-সত্যিই তো, ঝিল্লী মানে পোকা। তুই জানিস না? তুই কি বোকা রে!
তারপর ফিকফিক করে হাসবে।
আর দেখো তো তিতলি নামটা কত সুন্দর! তিতলি মানে প্রজাপতি। রঙিন পাখা যার। মা বলেছে তিতলির সঙ্গে মিলিয়েই নাকি ঝিল্লী হয়েছে ওর নাম। কী বোকা বোকা কথা! ওর নাম তো মিলি হতে পারতো। কিংবা ডলি। বাবা ওকে আদর করে এখনো ডল ডাকে। এসব কেন ওদের মাথায় এলো না! কী ভীষণ অন্যায় বলো তো!
রাতে খাবার টেবিলে ঝিল্লী আজকে তীব্র আপত্তি জানায়। তিতলি আপু পাশে বসে যথারীতি মিটিমিটি হাসে। মা কিন্তু সবটুকু শুনে বেশ মন খারাপ করে। তার মতে ঝিল্লি নামটা খুব মিষ্টি।
মিষ্টি নয়, তেতো। একেবারে বাজে। ঝিল্লী ঠোঁট ওল্টায়।
মোটেও না।
ঝিল্লী মানে পো-কা, পো-কা!
তুই একটা বোকা।
ঝিল্লী, তুই একটা বিল্লি।
ঝিল্লী এবার খেলার মাঠ থেকে একছুট লাগায়। ছুটতে ছুটতে ভীষণ কান্না পায় ওর। রোজ রোজ এমন নাজেহাল হতে আর ভালো লাগে না। আজকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে জরুরি মিটিংয়ে বসতে হবে তার। কী বাজে একটা নাম রেখেছে! নাম দেবার সময় পছন্দ হয়েছে কিনা একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি ওকে। আচ্ছা ঝিল্লী তখন কি খুব বেশি ছোটো ছিল? কথা বলতেও শেখেনি? তাতে কি! জিজ্ঞেস করলেই ও মাথা নেড়ে তীব্র আপত্তি জানিয়ে দিতে পারত। বাবা মা একদম বোকা।
স্কুলবাসে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে ঝিল্লী। আগামীকাল থেকে শীতের ছুটি শুরু হতে যাচ্ছে। এ কথা মনে হতেই একটু ভালো লাগে ওর। বেশ হয়েছে আগামী একমাস কোনো রকম বাজে কথা শুনতে হবে না। ওদের ক্লাসের অন্তুটা না একদম বাজে। পিংকি, তুষ্টি, বুবুনটাও। সারাক্ষণ পোকা পোকা করছে ওকে।
তিতলি আপুও কম দুষ্টু নয়। পাশের সিট থেকে ওর গালে টোকা দিয়ে যাচ্ছে অযথাই। তিতলি আপু সুযোগ পেলে ওকে খ্যাপায়। তাই ওকে কিছুতেই বলা যাবে না অন্তু,পিংকি, বুবুনরা কী বলেছে। তিতলি আপু মুখ গম্ভীর করে বলবে-সত্যিই তো, ঝিল্লী মানে পোকা। তুই জানিস না? তুই কি বোকা রে!
তারপর ফিকফিক করে হাসবে।
আর দেখো তো তিতলি নামটা কত সুন্দর! তিতলি মানে প্রজাপতি। রঙিন পাখা যার। মা বলেছে তিতলির সঙ্গে মিলিয়েই নাকি ঝিল্লী হয়েছে ওর নাম। কী বোকা বোকা কথা! ওর নাম তো মিলি হতে পারতো। কিংবা ডলি। বাবা ওকে আদর করে এখনো ডল ডাকে। এসব কেন ওদের মাথায় এলো না! কী ভীষণ অন্যায় বলো তো!
রাতে খাবার টেবিলে ঝিল্লী আজকে তীব্র আপত্তি জানায়। তিতলি আপু পাশে বসে যথারীতি মিটিমিটি হাসে। মা কিন্তু সবটুকু শুনে বেশ মন খারাপ করে। তার মতে ঝিল্লি নামটা খুব মিষ্টি।
মিষ্টি নয়, তেতো। একেবারে বাজে। ঝিল্লী ঠোঁট ওল্টায়।
তিতলি আপু বলে- ঠিক আছে, ঝিল্লী থেকে না হয় ঝিঁঝিঁ করে দেয়া হোক। তখন কেউ ওকে আর বিল্লি বলতে পারবে না।
এবার ঝিল্লী আর নিজেকে সামলাতে পারে না। শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে দেয় সে। তিতলি আপু ওর বোন হয়েও ওকে এমন করে বলতে পারে কী করে!
বাবা এবার হাত বাড়িয়ে ঝিল্লী নিজের কাছে টেনে নেয়, ওকে শান্ত হতে বলে। ওকে কাঁদতে দেখে তিতলি আপু নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্যরি বলে।
একটু পর খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই মা সবাইকে তাড়া দেয়। তখন ওদের মনে পড়ে পরদিন খুব ভোরে উঠে ট্রেন ধরতে হবে। এবার ঝিল্লী আর তিতলি দু'বোনেরই চোখমুখ ঝলমল হয়ে ওঠে।
ঝিল্লী বলল- আমরা কি এবার তাঁবুটা সঙ্গে নেব?
মা বলল- নিশ্চয়ই।
মা বলল- নিশ্চয়ই।
তিতলি বলল- আমরা কি রাত জেগে তারা দেখব?
বাবা বলল- অবশ্যই। আমরা তারাদের নামও জানব এবার।
বাবা বলল- অবশ্যই। আমরা তারাদের নামও জানব এবার।
মা জিজ্ঞেস করল- তাঁবুটা ব্যাগে ভরেছো?
বাবা বলল- আর বাইনোকুলারটা? ঝিল্লী আর তিতলি এবার হইহই করতে করতে নিজেদের ঘরে চলে গেল।
সবকিছু ব্যাগে ভরা হয়ে গেলে তিতলি চেকলিস্টটা নিয়ে বসল। হঠাৎ ঝিল্লী বলে- ওডোমস?
তিতলি মাথা নাডে। ঝিল্লী তক্ষুনি বাবার কাছে ছুটে যায়। ওডোমস আর টর্চলাইট নিয়ে ফিরে আসে।
তিতলি আপু ওর গালে টোকা দিয়ে বলে- ঝিল্লী, তুই মোটেও বোকা না, তুই খুব বুদ্ধিমান।
পরদিন অ্যালার্মের অনেক আগে,সবার আগে ঘুম থেকে জেগে ওঠে ঝিল্লী। আপুকে, মাকে, বাবাকে ডেকে দেয়। নাশতা করে ঝটপট তৈরি হয়ে নেয় ওরা। তারপর ব্যাগট্যাগ নিয়ে রেল স্টেশনে সময়মত পৌঁছে যায়।
পরদিন অ্যালার্মের অনেক আগে,সবার আগে ঘুম থেকে জেগে ওঠে ঝিল্লী। আপুকে, মাকে, বাবাকে ডেকে দেয়। নাশতা করে ঝটপট তৈরি হয়ে নেয় ওরা। তারপর ব্যাগট্যাগ নিয়ে রেল স্টেশনে সময়মত পৌঁছে যায়।
চার ঘন্টা সময় লাগে ফুলঝুরিতে পৌঁছাতে। বাইরের দৃশ্য দেখবে বলে তিতলির সঙ্গে ঝগড়া করে ঝিল্লী জানালার পাশে বসলেও একটু পরেই সে ঘুমে একেবারে কাদা হয়ে গেল। যখন এ ঘুম ভাঙল তখন দেখল ওরা ফুলঝুরিতে পৌঁছে গেছে। বাবা ব্যাগগুলো নিচে নামাচ্ছে, তিতলি আপু আর মা ওকে প্রায় কোলে করে সিট থেকে তুলে নিচ্ছে।
ট্রেন থেকে নেমে এবার ওরা একটা ভ্যানগাড়িতে চেপে বসল। মাটির পথ দিয়ে ভ্যানটা যখন চলতে শুরু করল ঝিল্লী তখন একটু একটু ভয় লাগতে থাকে। তিতলি আপু ওকে ধরে রাখে। আরেকপাশ থেকে মা বলে-ঐ দেখো, কত সুন্দর চারপাশ।
ঝিল্লী দেখল সত্যিই কী সুন্দর ঝকঝকে আকাশ। আরাম আরাম রোদ। ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে, টলটলে পুকুরের জলে হাঁসের ছানাদের দেখতে দেখতে একসময় ভয়টয় সব উবে গেল। কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে ওদের ভ্যানের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে ছড়া কাটছে ওরা-
ছুটি ছুটি, গরম গরম রুটি,
এক কাপ চা,সবাই মিলে খা।
এক কাপ চা,সবাই মিলে খা।
ঝিল্লী আর তিতলি হেসে কুটিকুটি হয় ছড়া শুনে। ওরাও গলা মেলায়। ছুটির পর স্কুলে ফিরে এসব গল্প শুনে ওদের বন্ধুরা অবাক হয়ে যাবে।
বাড়ি পৌঁছাতেই দাদা দাদী ঝিল্লীকে কোলে তুলে নিলেন, আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন ওদের দুজনকে। সারাটা বিকেল ওরা উঠানে খেলাধুলা করল। বাবামা আজ ওদের কোনো কিছুতে বাধা দিচ্ছে না। ঝিল্লির মনে হয়- ইস ছুটিটা যদি কখনো শেষ না হতো!
রাতে বাবা ওদের সবাইকে ভালো করে ঘুমিয়ে নিতে বলল। কারণ কাল সারাদিন অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। ঘুরেটুরে ওরা সবাই রাত কাটাবে তাঁবুতে।
ঝিল্লী হাত তালি দিয়ে বলে -ইয়াহু!
তিতলি বলে ওঠে- হুররে!
পরদিন ওরা যখন বনের পথে পা রাখল তখন শুরুতেই বাবা বলল- তোমরা কি জানো বনের একটা শব্দ আছে? নিজস্ব ভাষা আছে?
ওদেরকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবা আবার বলল- আজকে আমরা বনের গান শুনব। তার জন্য আমাদের কী করতে হবে কেউ বলতে পারো?
ঝিল্লী এবার তিতলি আপুর দিকে তাকাল। তিতলি তাকাল বাবার দিকে।
ঝিল্লী এবার তিতলি আপুর দিকে তাকাল। তিতলি তাকাল বাবার দিকে।
আমি জানি না। বাবা তুমিই বলো।
সে শব্দ বা গানটা শুনতে হলে আমাদের কান পাততে হবে।
বাবার কথাটা শুনেই ঝিল্লী হাঁটা থামিয়ে কানের পাশে হাত রেখে শোনার ভঙ্গি করল। ওটা দেখে তিতলি ফিকফিক করে হাসতে শুরু করে দিয়েছে। কোনো শব্দ না পেয়ে আরেকটু ভেতরের দিকে গিয়ে একটা শালগাছের গায়ে কান রাখল ঝিল্লী।
কোথায় বাবা? কিচ্ছু শুনতে পাই না!
তিতলি পেটে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলে- ঝিল্লীটা কি বোকা রে!
তিতলি পেটে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলে- ঝিল্লীটা কি বোকা রে!
হঠাৎ হইচই শুনে গাছের ডাল থেকে কয়েকটা পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেল অন্যদিকে। মা হাতের ইশারায় বলে- শশশস!
ঝিল্লী কাঁচুমাচু মুখ করে তাকিয়ে আছে। ঠিক তক্ষুনি কোথায় যেন একটা শব্দ হয়। 'টুইটুইটুই'।
একটু পর আরো গভীর থেকে ডাকটা ভেসে আসে। একবার দুইবার তিনবার।
বাবা ফিসফিস করে বলে- এবার বুঝতে পেরেছ? বনের শব্দ শুনতে হলে আমাদের কিন্তু হইচই করা চলবে না।
তাই ওরা এবার শব্দহীনভাবে চলতে শুরু করে। ঝিল্লীর মনে হয় যেন কোনো রঙিন ছবির দেশে চলে এসেছে ওরা। পথের ধারে বুনোফুলের উপর মৌমাছিরা উড়ছে, প্রজাপতিরা পাখা নাড়ছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাখিদের শরীর ছুঁয়ে পিছলে যাচ্ছে মিষ্টি রোদ। হাঁটতে হাঁটতে একসময় সে অবাক হয়ে একটা ব্যাপার লক্ষ করে। কোথাও কেউ নেই অথচ পুরো জঙলটা যেন খুব নিচুস্বরে গুনগুন করছে, ঝুমঝুম করছে।
একটা মখমলী ঘাস বিছানো জায়গা দেখতে পেয়ে ওরা সেখানে থামল। খুব কাছেই স্বচ্ছতোয়া জলের ফিতের উপর জরির মতো রোদ। মা তার ক্যামেরায় এসবের কিছু ছবি তুলে রাখল।
একটু পর বাবা ঝটপট তাঁবুটা খাটিয়ে ফেলতেই মা বলল- চলো এবার খেয়ে নিই। ঘাসের উপর চাদর পেতে বসল ওরা। অনেকটা পথ হেঁটে এসে সবাই ভীষণ ক্ষুধার্ত।
ঝিল্লীর অবশ্য বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসতে ইচ্ছে করে না। সে হেঁটে হেঁটে চারদিক ঘুরে দেখে। থোকা থোকা হলুদ রঙের ফুলটার গায়ে সোনালি রঙের কাচপোকা বসেছে। বাবা বলেছে ফুলটার নাম বন গাঁদা। আর সাদা রঙের শুঁড়ওয়ালাটা ভাঁটফুল। মা বলেছে ওরই আরেক নাম বনজুঁই।
বাইনোকুলার দিয়ে ফুলের গায়ে লেগে থাকা লেডিবাগ আর গুবরে পোকাদের শরীর দেখে ঝিল্লি।
বাইনোকুলার দিয়ে ফুলের গায়ে লেগে থাকা লেডিবাগ আর গুবরে পোকাদের শরীর দেখে ঝিল্লি।
বেলা পড়ে এলে তিতলি আর মা তাঁবুর ভেতরে ঘুমিয়ে নিল খানিকটা। বাবা আর ঝিল্লী বাইরেই রইল। দুজন কিছুক্ষণ নদীর ধারে হাঁটাহাঁটি করল। তারপর ফিরে এসে একটা বই নিয়ে বসল বাবা। আর ঝিল্লী ওর ড্রয়িং খাতা আর রঙপেন্সিলের বাক্সটা খুলল। এই বনটার ছবি আঁকতে ইচ্ছে করছে ওর। প্রজাপতি, ফুল, পাতা, লাল-কালো পলকা ডট লেডি বাগ। সবাইকে রঙ করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে ঝিল্লী। অনেকক্ষণ পর বাবার ডাকে খাতা থেকে মুখ তুলে তাকায় সে।
এটা কিসের শব্দ বাবা?
এটা কিসের শব্দ বাবা?
ঐ যে বলেছি তখন। বনের শব্দ।
বাবা আবার চাপাগলায় কথা বলছে। কিন্তু এই শব্দটা যেন ঠিক আগের মত নয়। একটু অন্যরকম। বিস্ময়ে ইতিউতি তাকায় ঝিল্লি।
কেমন লাগছে ঝিল্লী? ঝিঁঝিঁপোকারা বনকে গান শোনাচ্ছে।
সত্যি বাবা? খুব সুন্দর!
একটু ভেবে সে আবার প্রশ্ন করে- তার মানে কি ঝিঁঝিঁদের গানের মতো ঝিঁঝিঁরাও ভালো?
হ্যাঁ মা! ভীষণ ভালো।
বাবা হেসে ওর মাথায় হাত রাখে।
Comments
Post a Comment