প্রজ্ঞা মৌসুমীর গল্প
একটি লাল বাক্সের স্মৃতি
মহামারী শুরু হয়নি তখনও। গরমের ছুটিতে এখানকার পাঠাগারে নানা আয়োজন করা হতো শিশুদের জন্য। কখনো যাদুকর আসতো, গানের আসর বসতো, মঞ্চনাটক হতো, আনা হতো হরেক রকম পশু-পাখি, বাচ্চাদের মাঝে ছেড়ে দেয়া হতো বড় কাছিম, একবার চাঁদ থেকে নভোচারীদের সংগ্রহ করে আনা পাথরও দেখানো হয়েছিল। এসবের সাথে যথারীতি চলে বই পড়ার উৎসব। একশ ঘন্টাকে কয়েক ভাগে ভাগ করে, থাকে পুরস্কারের আয়োজন। এই যেমন পঁচিশ ঘন্টা বই পড়ে শেষ করা সব ছেলেমেয়েদের জন্য থাকে উপহার বই, সাথে শহরের কোন এক রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার কুপন। পরের ধাপগুলোতে আরও কিছু চমৎকার উপহার পাওয়ার সুযোগ, লটারী পদ্ধতিতে।
পাঠাগারের দুটো আলমারিতে পুরস্কারগুলো পুরো মাস সাজিয়ে রাখা হতো। মনে আছে প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম, একটা টুকটুকে লাল ব্লকসের বাক্স মন ছুঁয়ে গেল। আমার মেয়ের তখন পাঁচ মাস বয়স, ব্লকস কিনে দেয়া হয়নি। আমার তিন বছরের বোনপো'র ঘরে ব্লকসের ছড়াছড়ি। কিন্তু বোনকে খেলতে দিতে ভাইমনির মন সবসময় সায় দেয় না। বোনও একরোখা, ব্লকস দেখলেই খেলতে চাইবে। একদিন ওদের বড় মামা পাশে বসে দেখছিল। হঠাৎ দুষ্টুমি করে বললো 'ওর ভাইয়েরা ব্লকস দিয়ে খেলবে আর ও খেলবে হাঁড়ি পাতিল নিয়ে।' মেয়ে বাচ্চা মানে খেলনা পাতিল-পুতুল, ছেলে বাচ্চা মানে গাড়ি- এই ধারণার পক্ষে আমি নই। কেন যেন কথাটায় মন খারাপ হলো। বাসায় এসে মেয়েকে বললাম আমি তোমাকে ব্লকস কিনে দেব না, তুমি নিজেরটা নিজে অর্জন করবে।
আমার মনে তখন কাচের আলমারিতে সাজিয়ে রাখা সেই লাল বাক্স; শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী গ্রুপের চতুর্থ ধাপের একটি পুরস্কার। মন স্থির করলাম। মেয়ে কি বুঝলো কে জানে। তবে বই পড়াতে নিলে বাঁধা দেয়নি কখনো, এতটুকু বিরক্তও হয়নি। যখনই সময় পেতাম, বই পড়াতে বসতাম। পনের মিনিট করে করে ঘন্টা শেষ হতো, শেষ হতো একেকটা ধাপ। তখন কেমন এক আনন্দ বয়ে যেত। আবার পরের ধাপের জন্য 'রিডিং লগ' আনতে গিয়ে, আমরা মা-মেয়ে নিজেদের অজান্তেই কাচ আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে লাল বাক্সটা দেখতাম।
এভাবেই একদিন শেষ হলো আমার মেয়ের প্রথম বই পড়ার উৎসব। কিছুদিন পর ফোন এল- মেয়ে পুরস্কার জিতেছে। আহা, আমাদের সেই লাল বাক্স! আনন্দে সে রাতে ঘুমই আসতে চাইছিল না। পররে দিন সন্ধ্যায় গেলাম, মেয়ের নাম বললাম। লাইব্রেরিয়ান কয়েক জায়গায় খুঁজলেন। মনে হলো দ্বিধায় পড়ে গেছেন। ভেতরের আরো ক'জনের সাথে কথা বলে ফিরে এসে জানালেন এই ব্রাঞ্চের বিজয়ীরা যার যার পুরস্কার নিয়ে গেছে, আমার মেয়ের নামে আসলে কোন পুরস্কার নেই। তবে কি আমারই বোঝার ভুল?
স্বপ্নে ভাসতে হয়, স্বপ্নে তলিয়ে গেলে কখনো সখনো আঘাত পেতে হয়। কাচের দেয়ালের লাল বাক্সটা আসলে অন্য কোন শিশুর অপেক্ষায় ছিল, আমাদের জন্য নয়। বাড়ি ফিরলাম কিছু পাওয়া আর না-পাওয়া নিয়ে। পরের দিন ফোন দিলেন আমাদের পাঠাগারের সুপারভাইজার। ভাবলাম হয়ত ক্ষমা চাইতে অনিচ্ছাকৃত ভুল খবরের জন্য। তবে তিনি ভুল ধরিয়ে দিলেন আমার। পাড়ার পাঠাগারে নয়, আমাদের যেতে হবে ডাউনটাউনে, মেইন লাইব্রেরিতে। কেননা কোন লাল বাক্স নয়, অন্য কোন কিছু আমার মেয়ের, এ বছরের 'গ্র্যান্ড প্রাইজ' বিজয়ীর অপেক্ষায়।
Comments
Post a Comment