ফারিহা শাহরিনের গল্প

ইঁদুর বিড়াল চুক্তি



রাস্তার এক ঘেয়ো কুকুরের ধাওয়া খেয়ে কোথা থেকে সাদা রঙের এক বিড়াল ছানা আমাদের খোলা দরোজা দিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকে সোজা এক লাফে সোফার গদিতে আরাম করে বসে গেল। কুকুরটা ভয়ে ঘরের কাছে ভিড়লো না। কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে ফিরে গেল। কয়েক সেকেন্ডের রুদ্ধশ্বাস ঘটনাটির সাক্ষী সাত বছরের মুমু।

সে বহুদিন ধরে আম্মুর কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিল একটা বিড়ালছানা কিনে দাও, একটা বিড়াল ছানা কিনে দাও। কিন্তু বিড়াল ছানা কেউ কী বিক্রি করে? আজব কথা। আম্মু সেটা না বলে তাকে বাহানা দিয়ে বশ করে রাখে, কিনে দেবো সোনা, কিনে দেবো। তোমার আব্বু বেতনটা পেলেই কিনে দেবো। আমরা (মানে আমি আর ভাইয়া) মুখ টিপে হাসি। এত কিছু থাকতে বিড়ালছানার বায়না। তাও বাজার থেকে কিনে দেবে। এ যেন টেডি বিয়ার আর কি। আবার রাগও হয়। আমরা কিছু চাইলে চটকানা। আমি ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলাম, আমাকে আব্বু একটা খেলনা রোবট কিনে দিলো না, বলে কিনা অনেক দাম। তার বদলে কিনে দিলো সুকুমার রায়ের ছড়া। আচ্ছা আমার কি ছড়া পড়ার বয়স আছে বলো? যত ননাই তনাই সব মুমুর জন্য। এবার বোঝো, দাও কিনে বিড়াল ছানা। বিড়াল আমার দু চোখের বিষ।

কিন্তু সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পর আমার চোখ ছানাবড়া। মুমুর কোলে সত্যি সত্যি একটা আদুরে বিড়াল ছানা। তখন আম্মু ঘটনাটি খুলে বলল। কিনতে হয়নি বিনে পয়সায় একটি বিড়াল ছানা সত্যি সত্যি মুমুর কাছে চলে এসেছে। আমি একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মুমু যা চায় তা কখনো ব্যর্থ হতে দেখিনি। হয় আব্বু কিনে আনবে, নয়তো চাচ্চু, এবার তো মনে হয় স্বয়ং আল্লায় দিয়েছে। সব পক্ষপাতিত্ব। আমার হিংসায় পেট জ্বলে। দেখা যাক। আদরের বিড়ালছানা যখন তোমার সাধের সাজানো বিছানায় পায়খানা করে দেবে, তখন কেমনে সামলাও। সেই বিড়ালের আবার নাম রাখা হয়েছে ‘ঝুমকি’। ভাইয়া তাকে নিয়ে ছড়া বানিয়েছে। ‘মুমুর বিড়াল ঝুমকি, মাছের কাঁটা খাওকি?

আম্মু বলে ঝুমকি আসার পর ঘর অনেক পরিষ্কার থাকে। এঁটোকাঁটা খেয়ে শেষ করে। ঘরে ইঁদুরের উৎপাত কমে গেছে। এঁটোকাঁটা যাই খাক, ঝুমকির জন্য দৈনিক আধকাপ দুধ বরাদ্দ। মুমুর আবদার। দুধ না খেলে শরীরে শক্তি হবে না। শক্তি না থাকলে ইঁদুর ধরতে পারবে না। আসলে মুমু দুধ খেতে চায় না। সে চুপিচুপি ঝুমকির বাটিতে দুধ রেখে আসে প্রতিদিন রাতে। একদিন আমি হাতেনাতে ধরেছি। মা তবু কিছু বলবে না ওকে।

আমি অবাক হয়ে গেছি ঝুমকির বাথরুম ব্যবহারের ভদ্রতায়। ভেবেছিলাম সে কোনো একদিন বিছানা বা সোফায় করে রাখবে, তখন তাকে তাড়ানোর অজুহাত পাওয়া যাবে। কিন্তু সে বাথরুম পেলেই বাইরে গিয়ে সেরে আসে। ঘরে কখনো এসব কাজ করে না।  

তাকে কিন্তু কক্ষণো ইঁদুর ধরতে দেখিনি। সে যে ইঁদুর তাড়ায় তার প্রমাণ কী। তার অকর্মণ্যতা নিয়ে অভিযোগ করলাম মার কাছে। বসে বসে শুধু অন্ন ধ্বংস করছে, একটা কোনো কাজে লাগে? এরকম অকর্মণ্য বিড়ালকে দুধভাত দিয়ে পোষার কী মানে আছে। বাবা মা দুজনে হাসে। প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলেছে মুমুটাকে। ভাইয়া আর আমি বেড়ালটাকে তাড়াবার মতলব খুঁজতে থাকি। আগামী এক মাসের মধ্যে যদি একটা ইঁদুরও না ধরে তাহলে ঝুমকির চাকরি নট। মুমু এসব পাত্তাও দেয় না। বাবা মা ওর পক্ষে বলে তেজ বেশী ওর। কিন্তু আগামী এক মাস। এর মাঝে যদি ইঁদুর না ধরে তাহলে আমরা ঝাড়ুপেটা করে তাড়াবো।

একদিন মাঝরাতে ম্যাঁও ম্যাঁও শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমাদের। সে প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়ে চেঁচাচ্ছে আর সবার ঘুম ভাঙ্গাচ্ছে। প্রথমে আমাদের বেডরুমে আসলো। তারপর বাবামার বেডরুমে, তারপর ভাইয়ার রুমে। এমন গলা মোটা করে মাঝরাতে আমাদের ঘুম ভাঙ্গানোর উদ্দেশ্য কী। আমি আর মুমু একসাথে ঘুমাই। সে সবাইকে ডেকে আমাদের রুমে জড়ো করলো। বিরক্ত হয়ে আমি বাতি জ্বালালাম। ইতোমধ্যে মা বাবা ভাইয়া সবাই এসে হাজির। দেখি এক আজব কাণ্ড। ঝুমকি একটা ইঁদুরছানা ধরে এনেছে। সেটা সামনে রেখে আমাদের সবার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যাতে বোঝা যায় সে কী বলতে চাইছে। আমি এমনি বসে বসে দুধভাত খাই না। ইঁদুরও ধরি। আমি বিরক্ত হই। ইঁদুর ধরেছিস তাতে আমাদের ডাকার কী আছে। আমাদের কেন ডেকেছে সেটা আরেকটু পর টের পাওয়া গেল।

বাতি জ্বালিয়ে সবাই চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়াবার পর ঘরের মাঝখানে তার খেলা শুরু হলো। ইঁদুরটাকে সে কামড়ে ধরে নিজের সামনে রাখলো। ছোট্ট ইঁদুরছানা। এখনো বেশী ছুটতে পারে না। দেখে মায়াই লাগছে। তারপর ইঁদুরটার পিঠে একটা হালকা চাপড় দিল। যেন একটা সিগন্যাল। 

সিগন্যাল পেয়ে ইঁদুরটা এক ছুটে ঘরের অন্যপ্রান্তে চলে গেল। কিন্তু দরোজা দিয়ে বের হবার আগেই ঝুমকি গিয়ে ধরে ফেললো তাকে। তারপর আবারো পিঠে চাপড়, এবার উল্টো দিকে খাটের নীচে ছুট দিল ইঁদুরছানা। আবারো ঝুমকি ছুটে গিয়ে খাটের নিচ থেকে ধরে আনলো। 

এভাবে একবার ধরে, আবার ছাড়ে, একটা তামশা আর কি। একবার খেলা দেখানো হলে সে গর্বের সাথে আমাদের দিকে তাকিয়ে ম্যাঁও করে ডাক ছাড়ে। তারপর আবার খেলা শুরু করে।  

আমি মহা বিরক্ত। ইঁদুর ধরেছিস ভালো কথা। বাইরে গিয়ে গপাগপ খেয়ে ফেলবি তা না, আমাদের খেলা দেখাতে বসেছিস রাত দুটোর সময়। ইচ্ছে করছে একটা চটকানা দেই। কিন্তু বাকী সবাই খেলাটায় মজা পেয়ে গেছে। তাই কিছু বলাও যাচ্ছে না। অবশেষে সবাই হাততালি দিলে সে খেলা শেষ করলো। ইঁদুরছানাকে মুখে নিয়ে বাইরে চলে গেল। আমি ভাবলাম এবার সে ওটাকে দিয়ে ভুরিভোজন করবে।  

সে যখন বাইরের বাগানে গেল ওটাকে নিয়ে আমি জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম। ওমা, দেখি সে ইঁদুরটাকে সামনে রেখে কানে কানে কী যেন বলছে। তারপর আরেকটা চাপড় দিয়ে ছেড়ে দিল। ইঁদুরটা এক ছুটে ঝোপের মধ্যে চলে গেল। আর আমাদের ঝুমকি জানালার গ্রিল বেয়ে ঘরের মধ্যে এসে নামলো ঝুপ করে।  

কত্তবড় ফন্দিবাজ বিড়াল! নিশ্চয়ই ইঁদুরছানা সাথে একটা চুক্তি করে রেখেছিল। চাকরি বাঁচাতে তার এই ফন্দী। আমি কাল সকালেই মাকে বলবো তার এই শয়তানীর কথা।

পরদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে আমি মাকে সবটা খুলে বললাম। শুনে মা তো হেসে কুটিকুটি। মুমুটা পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে বললো, ঝুমকি তো ইঁদুর খাবে না। ওকে আমি বারণ করেছি ওসব পচা জিনিস না খেতে। কিন্তু সে যে ইঁদুর ধরতে পারে সেটা আমাদের দেখিয়েছে বুঝলা?

হ্যাঁ বুঝলাম। আরো বুঝলাম ঝুমকির এই চক্রান্তের সাথে মুমুও জড়িত আছে। অতএব ঝুমকির চাকরিটা বহাল থেকে গেল।


Comments

  1. আমার মেয়ের খুব পছন্দ হয়েছে গল্পটা

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা