ফিচার: প্রতিভা সরকার


ডোডো পাখি আর ডায়ান ফসি




আজ প্রথমে তোমাদের ডোডো পাখির গল্প বলি। সেই যে মরিশাস দ্বীপপুঞ্জে ডানাহীন এক মোটাসোটা ভীতু পাখি বনে জঙ্গলে, সমুদ্রের তীরে অবাধে চরে বেড়াতো অনেকদিন আগে, তার নামই ডোডো। ডানা নেই বলে উড়তে পারতো না, আর শরীরে বেশি মাংস বলে জোরে দৌড়াতে পারতো না। বুঝতেই পারছ সহজেই শিকার করা যেত ডোডো পাখিকে। এরা বাসা করতো মাটিতে, ঝোপঝাড়ের ভেতরে। ফলে ডিম, ডোডোর ছানা, সবই সহজলভ্য ছিল। বনের অন্য মাংসাশী জীবজন্তুদের খিদে মেটাত এই পাখির মাংস। সেটা তো স্বাভাবিক। তাতে ডোডোর টিঁকে থাকায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি।

যত গোল বাঁধল মানুষের নজর পড়তে। আমরা মানুষেরা কিনা বেজায় লোভী। মাংস দেখে লোভ, ভালো মাছ, ফল-পাকুড় দুধ সবই আমাদের চাই। ডাচ নাবিকেরা একসময়ে জাহাজে ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হল মরিশাসে, তাদের নজর পড়ল ডোডোপাখির ওপর। সে আজ থেকে প্রায় চারশ বছর আগের কথা। সুস্বাদু মাংসের জন্য ডোডো পাখি ধরে ধরে খেতে শুরু করল তারা, পাখির খোঁজ করতে করতে তার বাসা ডিম ছানা সব নষ্ট করে দিল। এবার শুরু হল ডোডোর সংখ্যা কমে আসা। যত পাখি হত্যা করা হতে লাগলো, ততো পাখি জন্মালো না। ফলে একদিন পৃথিবী থেকেই লুপ্ত হয়ে গেল ডোডো পাখি।

আমরা সবাই প্রকৃতির সৃষ্টি। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার যেমন, পশু পাখি গাছপালা জলজ প্রাণীদের প্রত্যেকেরই ঠিক তেমন। যদি বিশাল বিশাল টেরোড্যাকটিল মানুষ খেয়ে খেয়ে মানুষের বংশ ধ্বংস করে দিত, সেটা কী খুব ভাল হত? মানুষ না থাকলে এই সৃষ্টিরহস্য জানা যেত না, বিজ্ঞানের অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলাও হতো না। তেমনি প্রকৃতিতে প্রত্যেকটি জীবের নিজস্ব স্থান আছে। কোনো প্রজাতিকে মেরে কেটে খেয়ে বা শুধুই বর্বর আনন্দের জন্য ধ্বংস করে দিলে তাকে বলে সেই প্রজাতিটির অবলুপ্তি। সেই প্রজাতিটির শেষ সভ্যটি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে সেটি অবলুপ্ত হয়ে যায়।

এখন প্রশ্ন হল ডোডোপাখির কথা আমরা জানলাম কী করে? সেই ডাচ নাবিকদের লেখাপত্রে ডোডোর কথা ছিল, আঁকা ছবিও পাওয়া গেছে, কেউ কেউ ডোডোর শুকনো মৃতদেহ নিয়ে ফিরেছিল, হয়ত অদ্ভুতদর্শন পাখিটিকে দেখিয়ে বন্ধুবান্ধবদের কাছে বাহবা নেবে। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সেই সব শুকনো হাড়গোড় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে বৈজ্ঞানিকরা ডোডোর ছবি এঁকে ফেললেন কম্পিউটারে, তার সম্বন্ধে অনেক তথ্য জড়ো করলেন। জানা গেল কী ভাবে ডোডো পাখির অবলুপ্তি ঘটেছে মানুষের বর্বরতায়।

কিন্তু সব মানুষই তো আর একরকম নয়। পশুপাখি গাছপালা সমুদ্রকে ভালবাসে এইরকম মানুষও অনেক। তাদের একজনের কথা জানলে অনেক দুঃখের মধ্যেও মন ভালো হয়ে যায়। তিনি একজন মহিলা, নাম ডায়ান ফসি। তিনি গরিলা সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিয়েছিলেন।

আগে ভাবা হতো গরিলা হল একরকমের দৈত্যবিশেষ, যারা মানুষ দেখা মাত্র তাকে হত্যা করতে তেড়ে আসে। এইরকম দুর্নাম যে জীবের, তাকে দেখামাত্র মেরে ফেলাই ঠিক বলে ভাবত বেশিরভাগ মানুষ। ফলে পাহাড়ি গরিলাদের সংখ্যা কমে আসছিল বিপজ্জনক ভাবে। ঠিক তখনই ফসি সভ্য সমাজকে ত্যাগ করে রোয়ান্ডাতে চলে যান পাহাড়ি গরিলাদের মধ্যে বাস করবেন বলে। গরিলাদের বিশ্বাসভাজন হবার জন্য তিনি তাদের মতো ঘাস চিবুতেন, আঙুল দিয়ে নিজের সারা গা আঁচড়াতেন, কখনো তাদের মতোই বুক চাপড়াতেন। গভীর বনের মধ্যে সব ত্যাগ করে ফসি গরিলাদের সঙ্গে বাস করতেন, তাদের সম্বন্ধে সব তথ্য লিপিবদ্ধ করতেন যাতে বাইরের বিশ্ব জানতে পারে যে গরিলারাও বুদ্ধিমান ও সমাজবদ্ধ জীব। গরিলাদের সংখ্যা যাতে না কমে যায়, সেজন্য তাঁর প্রাণপণ চেষ্টা ছিল। কী না করেছেন তিনি- রোয়ান্ডা সরকারের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন, লোকাল লোকেদের পালিত পশুরা কেন গরিলাদের বাসস্থানে হানা দেবে, লোকেরাই বা কেন পশুপালনের নামে বনের জমি দখল করে নেবে, এইসব নিয়ে তুলকালাম করেছেন, চোরা শিকারীদের হাতেনাতে ধরে ফেলে শাস্তি দিয়েছেন।

কিন্ত মানুষের লোভ মরতে চায় না। ফসির এইসব চেষ্টায় ওখানকার লোকেরা খেপে যাচ্ছিল। তাদের স্বার্থে আঘাত লাগছিল। ফসির প্রিয় গরিলা যার নাম ছিল ডিজিট, তাকে তারা মেরে ফেলে, তারপর একদিন ফসিকেও ঘরে ঢুকে মেরে ফেলে।

আসলে ফসি কিন্তু অমর হয়েই বেঁচে রইলেন তার গরিলাদের মধ্যে। আজ পৃথিবীতে যে কটি পাহাড়ি গরিলা বেঁচে আছে, তারা ফসির জন্যই অবলুপ্ত হয়ে যায়নি।

খুব ছোট থেকে পশুপাখি গাছপালায় ভরা বনের জন্য, সামুদ্রিক প্রবাল আর প্রাণীর জন্য ভালবাসা অভ্যেস করলে তবেই ফসির মতো মানুষ হওয়া যায়।

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা