সাদিয়া সুলতানার গল্প

কাঁটা



মৌমিতা মাছ খেতে পছন্দ করে না। মাছের শরীরে কীভাবে যেন একটার পর একটা কাঁটা সাজানো থাকে। কিছু কিছু কাঁটা আবার ছুরির মতো ধারালো। মা মাছের কাঁটা বাছার সময়ই মৌমিতা আতংকে থাকে এই বুঝি মাছের কাঁটা মায়ের হাতে ফুটে গেল। মা কিন্তু দিব্যি ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে মাছের কাঁটা বেছে ফেলে। তারপর লেবু আর ডাল দিয়ে মাছ ভাত মাখিয়ে মৌমিতাকে খেতে দেয়।

মৌমিতা নিজের হাতেই খেতে পারে। মা বলে ক্লাস টুতে পড়া মেয়ের নিজে হাতেই খাওয়া উচিৎ। তবে বাবা মাঝেমাঝে একটু বেশি বেশি বলে। বাবা বলে, মৌমিতার নাকি নিজের হাতে মাছের কাঁটা বেছে খাওয়া উচিৎ।


এটা বলতে বলতে বাবা নিজের ছেলেবেলার গল্প ফাঁদে। বাবা নাকি চার/ পাঁচ বছর বয়স থেকেই মাছের কাঁটা বাছতে পারতো। দাদী এক থালা ভাত এনে টেবিলে রেখে দিতো। আর বাবা নাকি ভাজা মাছ বেছে নিয়ে তা দিয়ে কপকপ করে ভাত খেয়ে নিতো। মাঝেমাঝে কাঁটাও কুড়মুড় করে খেয়ে ফেলতো।

মৌমিতা জানে বাবা সত্যি বলছে। বাবা, মা ছোটবেলায় নিজেদের কাজ নিজেরাই করতো। তাই মৌমিতাও করে। নিজের স্কুলড্রেস নিজে পরা, মোজা পরা, পড়ার টেবিল গোছানো, খেলনা সাজানো, রুটিতে নসিলা মাখানো এসব। কিন্তু তাই বলে কাঁটা বাছা! ও পারবে না কিছুতেই। আজকাল মাছের কাঁটার ভয়ে ওর মাছ-ভাত খেতেই ইচ্ছে করে না।

বাবা তা শুনে বলে, ‘এ কী কথা! আমরা হলাম মাছে-ভাতে বাঙালি। খেতে তো হবেই।’

মৌমিতা টিভির সংবাদে দেখেছে, বাংলাদেশের মানুষ মাছে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু এ দেশের সব মানুষ চাইলেই মাছ খেতে পারে না।

সেদিন ঝুমুর এসেছিল। মা ওকে ভাত খেতে দিয়েছিল ইলিশ মাছ দিয়ে। ঝুমুর যতক্ষণ ভাত খেয়েছে মৌমিতা এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। মা ওকে মাছের কাঁটাসহ একটা টুকরোই দিয়েছিল। আর ছিল না কিছু। আগেরদিন ওরা সবাই খেয়েছিল ইলিশ মাছের তরকারি, তারই শেষ টুকরো দিয়ে মা ঝুমুরকে ভাত খেতে দিয়েছিল। মাছ দেবার আগে মা জানতে চেয়েছিল, ‘খেতে পারবে এই টুকরো। কাঁটা বেছে দিবো? না একটা ডিম বেছে দিবো?’

আধময়লা জামা দিয়ে মুখ ঢাকতে ঢাকতে ঝুমুর মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আমি কাঁটা বাছতে পারি খালা।’

শুনে মৌমিতা চমকে উঠেছিল। ঝুমুর ওর চেয়ে আধা ফুট খাটো হবে। দেখতেও ছোট। ও নিজে কাঁটা বাছতে পারে! মৌমিতাকে অবাক করে কাঁটা বেছে ভাতের লোকমা মুখে তুলতে তুলতে ঝুমুর বলেছিল, ‘ম্যালাদিন পর ইলিশ মাছ খাইতেছি।’

‘কতদিন পর?’

মৌমিতার প্রশ্ন শুনে ঝুমুর কড় গুনে গুনে বলেছিল, ‘বৈশাখ মাসে। খালা মায়েরে ইলিশ মাছের তরকারি দিছিল না? পয়লা বৈশাখে? সেইদিন।’

মৌমিতা দেখেছে বীণা খালাকে কিছু খেতে দিলেই খালা বক্সে ভরে। বলে, ‘খিদা নাই আপা, বাড়িতে গিয়ে খাব।’

মৌমিতা এবার বুঝেছে, বীণা খালা সেই সকালে এসে দুপুর পর্যন্ত ওদের বাসায় কাজ করলেও কেন খালার ক্ষুধা লাগে না। ভাবতে ভাবতে মৌমিতা টেবিলের দিকে তাকায়। আজ খাবারের তালিকায় ইলিশ মাছ, আলু-বেগুন ভাজি আর মুগ ডাল। নিজের প্লেটে ভাত তুলতে থাকে মৌমিতা।

মা ছুটে এসে বলে, ‘মৌমিতা আমি মাছ বেছে দিচ্ছি দাঁড়াও মা। বীণা বের হচ্ছে। আমি দরজা লাগিয়ে আসি। তুমি ভাজি দিয়ে ভাত খেতে থাকো।’

মৌমিতা মাছের বাটির দিকে তাকায়। ইলিশ মাছ ওরও প্রিয় মাছ। কিন্তু সেই যে কাঁটার ভয়।

সেদিন ঝুমুরকে দেখে মৌমিতার ইচ্ছে হয়েছে ও নিজে নিজে মাছের কাঁটা বেছে খাবে। মা অবশ্য ওকে সাহায্য করবে বলেছে। হঠাৎ মৌমিতার চোখের সামনে ঝুমুরের কাঁটা বেছে মাছ-ভাত মাখানোর দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। ঝুমুরের চোখ জোড়া কী সুন্দর দেখাচ্ছিল। চকচক করছিল। ইলিশ মাছ ঝুমুরের খুব প্রিয়। শেষ গাল ভাত মুখে তুলে আঙুল চেটে খেতে খেতে ঝুমুর বলেছিল, ‘ইলিশের তেইলা পেটি খুব সাদ।’

মৌমিতার প্লেটের পাশে রাখা বাটিতে মাছের পেটি ঝকঝক করছে। ঝুমুরের তেইলা পেটি। মেয়েটার চেহারা মনে পড়তেই মৌমিতার মনে হয়, ওর বুকের ভেতরে যেন একটা কাঁটা বিঁধে আছে। কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে ভেতরে। কাঁটাটা খোঁচা দিচ্ছে। এই কাঁটা মাছের কাঁটা না-মৌমিতা তা জানে।

হঠাৎ কী হয় মৌমিতার ও মাছের বাটি হাতে নিয়ে দরজার সামনে দৌড়ে যায়। বীণা খালা তখনো সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেনি। মৌমিতা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ‘মা, খালাকে ইলিশ মাছের পেটি দিয়ে দাও না মা, ঝুমুরের খুব পছন্দ ইলিশ মাছের তেইলা পেটি।’

মৌমিতার কথা শুনে মা হাসে। মায়ের হাসি দেখে মৌমিতা টের পায়, ওর বুকের ভেতরে আটকে থাকা কাঁটাটা আর নেই।

Comments

  1. মানবিক এই গল্পটা খুব ভালো লাগলো।।

    ReplyDelete
  2. গল্পের শেষ অংশে মৌমিতার মানবিক মন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, খুব সুন্দর হয়েছে।

    ReplyDelete
  3. শেষটা মন ছুঁয়ে গেল...

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রথমটা কী ভালো হয়নি?

      Delete
  4. আহা... কি মায়াময় গল্প!

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা