ফাহ্রিয়াল রহমানের গল্প
গাড়িতে বসে ভিডিও গেমসে এতটাই ডুবে ছিলাম যে রেজাউল চাচু ঠিক কখন থেকে নক করছিল গাড়ির জানালায় টেরই পাইনি। হঠাৎ তাকাতেই দেখি আমার প্রিয় একটা লেস চিপসের প্যাকেট হাতে অস্থির হয়ে ইশারায় আমাকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি করে জানালার গ্লাসটা নামাতেই প্যাকেটটা আমার হাতে দিল, ঘামে ভিজে একসার চাচুর হাতে থেকে প্যাকেটটাও কেমন ভেজা ভেজা। আমি বা আম্মু যখন গাড়িতে বসে থাকি বিশেষ করে আম্মু থাকলে তখন রেজাউল চাচু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।গাড়ি চালানো ছাড়া ভেতরে বসে থাকতে চায় না। আমরা এসিতে বসা আর ও কাঠফাটা রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আম্মু বা আমি কত বলি ভেতরে বসতে, তার এককথা গরীব মানুষ এসিতে বেশিক্ষণ বসে থাকলে অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। বাসায় আমাকে আদর করে ডাকে ' বাবান', স্কুলে হাসিন আর রেজাউল চাচু মায়াভরা একটা নামে ডাকে সবসময়।
" বাবাসোনা কখন থেকে তোমারে ডাকতেসি নাও তাড়াতাড়ি খাও তুমার আম্মু একটুপর চলে আসবে। এটা দেখলে কিন্তু ....। "
" জানি আম্মু রাগ করবে কিন্তু তুমি কিভাবে বুঝতে পারলে আমার এটা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল?
" তুমারে তো এই আট বছরে চোক্ষের সামনে বড় হইতে দেখলাম। কেন জানি মনে হইলো তুমার এইটা খাইতে ইচ্ছা করতেছে, আমার ছেলেটা এইখানে থাকলে তারও মনে হয় চিপস খাইতে ইচ্ছা করতো, আমার ছেলেটা যদি....। "
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে যায়।আমি বুঝতে পারি আমার সমবয়সী ছেলের জন্য চাচুর মন কাঁদে।
আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে ফেরার পথে আম্মুর অফিসের তাড়া না থাকলে প্রায় নিজের টুকটাক কাজগুলো সারে। এই যেমন আজ নামল টেইলর্সে, আর এই কাজে পনেরো থেকে বিশ মিনিট লাগবে তা খুব জানা আছে। আম্মুকে একটা চিপস কিনে দেওয়ার কথা বলেছিলাম কিন্তু সপ্তাহে দুইটার বেশি খাওয়ার অনুমতি নেই, পরশুদিন সেই কোটা শেষ হয়ে গেছে সেটা মনে করিয়ে দিয়ে চলে গেলো। রেজাউল চাচু তখন গাড়ির বাইরে উল্টো মুখ করে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা কোনো ভাবেই শোনার কথা না। অথচ বেশির ভাগ সময়েই আমার প্রিয় খাবার গুলো ঠিক সময়ে নিয়ে এসে আমাকে চমকে দেয়। আব্বু আম্মুর পর রেজাউল চাচু আমাকে খুব ভালো বোঝে।
আমাকে অবাক করা এরকম কাজ চাচু প্রায় করে। কখনো কোকের ক্যান, কখনো আইসক্রিম, ঝালমুড়ি আরো কতকিছুই না এনে হাজির করে।
পয়সা খরচ করে এগুলো আনতে নিষেধ করলে কেমন যেন হয়ে যায় একই কথা বলতে থাকে
" আমার ছেলেটার বয়স আর তুমার বয়স তো একই তুমি খাইলে মনে হয় সে আমার সামনে বসে খাইতেসে। "
" তুমি যখন বাড়িতে যাও ওকে অনেক কিছু কিনে খাওয়াও তাই না? "
" নাহ্! সব রিজিক তো আল্লাহ সবার জন্য রাখেন নাই রে বাবা! ওর মায়ে যা খাওয়ায় তাই খায়। "
" আচ্ছা ও কী খেলতে বেশি পছন্দ করে ক্রিকেট না ফুটবল? "
" মনে হয় ফুটবল। খুব মনোযোগ দিয়া দেখে। ওর জন্যই টিভি কিনা দিসি।খুব সুন্দর কইরা বুঝায় দেয় ওর বোনে আমার মেয়েটা। ক্লাস ফাইভে পড়ে, নিজে পড়ে ভাইরেও পড়ায়। ভাইয়ের তিন বছরের ছোট কিন্তু আল্লাহ ওরে অনেক বেশি বুদ্ধি দিসেন। "
" আমি তো সেভেনে তাহলে তোমার ছেলেটাও সেভেনে তাকে ফাইভের মেয়ে পড়ায়! "
" হুমম"
ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায় চাচু।
ঢাকা থেকে মাত্র দেড় / দুই ঘন্টার রাস্তা মানিকগঞ্জে চাচুদের গ্রামটা কত সুন্দর,সেই গল্প শুনতে শুনতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল ঐ গ্রামে।
আমার সেই ইচ্ছেটা অপূরণীয় রেখেনি চাচু। আজ আমরা তালুকনগর গ্রামে এসেছি, আব্বুর ইচ্ছে থাকলেও আম্মু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার জোরাজোরিতে শেষ পর্যন্ত আসতে রাজি হলো।
আসলেই চোখ জুড়ানো সুন্দর গ্রাম। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ । ঢাকা থেকে এতো কাছে তবুও শহরে ছোঁয়া বেশি লাগতে দেয়নি।
কুমিল্লায় দাদাবাড়ী গেলে তো মনে হয়না কোনো গ্রামে এসেছি।নানাবাড়ি পাবনাতেও একই অবস্থা। বেশির ভাগ মানুষ হিন্দি সিনেমা আর সিরিয়ালে ডুবে থাকে। পাকা দোতলা বাড়ি বেশি চোখে পড়ে। আব্বু খুব দুঃখ করে এগুলো নিয়ে।
ধানিজমি কমে যাচ্ছে, সেখানে উঠছে মার্কেট বা অন্যকিছু আর এগুলো নিয়ে প্রায় আব্বু- চাচ্চুরা আফসোস করেন।
তালুকনগর গ্রামে ঢুকতেই আব্বু-আম্মু আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি চারিপাশ। রেজাউল চাচুর বর্ণনার চেয়ে আরো বেশি সুন্দর।
রেজাউল চাচুর বাড়িটাও খুব সুন্দর সামনে অংশে বড় বড় গাছ আম, কাঁঠাল, নারকেল আরও নাম না জানা অসংখ্য গাছ। ওদের গাছের অনেক কিছু চাচু প্রায় নিয়ে যায় আমাদের জন্য।
বাড়িতে ঢুকে বড় একটা ঘরে আমাদের বসতে দিলো। চাচু খুব অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে। 'রেজিনা' চাচুর মেয়ে আর বউ আমাদের জন্য সরবত নিয়ে এলো গাছের লেবু দিয়ে তৈরি,আরো অনেক রকমের পিঠা।আম্মু পিঠার চেয়ে প্রতিটি পিঠার প্লেটের নিচে বিছানো কুরুশ-কাঁটায় তৈরি ছোট ছোট রুমাল গুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছে দেখে চাচী খুব খুশি মনে বলে " ম্যাডাম আপনার এগুলি পছন্দ হইসে? আমি আপনারে এর চেয়েও সুন্দর করে বানায় দিবো। " আচ্ছা দিও " আম্মু খুব খুশি হয়ে বললো। ওদের এখানে আসা উপলক্ষে আব্বু আম্মু অনেক কিছু কিনেছে খাবার দাবার, ওদের দু ভাই-বোনের জন্য জামা কাপড়। আমার মাপেই কেনা হয়েছে চাচুর ছেলে মানে রাকিবের ড্রেস।
সেগুলো ওদের হাতে দেওয়ার জন্য আম্মু যখন রেজিনা আর রাকিব দুজনকে সামনে আসতো বল্লো তখনই হাসিখুশি পরিবেশটা কেমন ম্লান হয়ে গেলো যেন।
দুপুরের খাবার রান্নার কাজ পড়ে আছে বলে চাচী ভেতর বাড়িতে চলে গেলো।চাচু ঠিক কী করবে সেটা যেন বুঝতে পারছে না।
আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম ওদের আচরণে থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম " তোমাদের গ্রাম আর রাকিবকে দেখার জন্যই তো এলাম! ওকে ডাকো ওর সাথে গল্প করবো খেলবো। "
আব্বু আম্মুও একি কথা বললো।
" স্যার ম্যাডাম বেয়াদবি নিয়েন না । খাওয়ার পর একঘন্টা রাকিবকে শোয়ায় রাখতে হয় নাইলে সব বমি কইরা দেয়। আপনারা কি কষ্ট করে ভেতরে ওর ঘরে যাবেন? "
" আ-হা, ও কি অসুস্থ? চলো ওর কাছে চলো। " আব্বুর কথায় রেজাউল চাচু আর কথা না বলে আমাদের নিয়ে বড় উঠান পেরিয়ে ওদের ভেতর বাড়ির তিনটা ঘরের একটা ঘরে নিয়ে গেলো। আমরা যাওয়ার আগেই রেজিনা দৌড়ে পৌঁছে গেছে তার ভাইয়ের কাছে।একটা খাট, ছোট একটা পড়ার টেবিলের ওপর একটা ছোটো টিভি, দুটো চেয়ার আর একটা হুইল চেয়ার এই হলো রাকিবের ঘর। আমরা ঘরে ঢুকতেই রেজিনা ইশারায় শুয়ে থাকা ভাইকে দেখিয়ে দেয় সালাম দিতে। "আ স সা লা মু আ লা ই ক উ ম " অনেক কষ্ট করে ডান হাতটা খানিক উঁচিয়ে তারচেয়ে বেশি কষ্ট করে জড়ানো গলায় ভাঙা ভাঙা স্বরে সালাম দিলো রাকিব।
বিছানার উপর শোয়া রাকিব, ডান পা' টা ধনুকের মতো বাঁকা আর সরু,ডান হাতটাও বেশ বাঁকা। "হাতে কিছুটা জোর আছে,কিন্তু পা টা একদম অচল। ও হাঁটতে পারেনা। ওর খাদ্য নালি এতোটা সরু যে ছমাস এক বছরের বাচ্চাদের যে ভাবে ব্লেন্ড করে খাওয়াতে হয় ওকেও সেভাবে খাওয়াতে হয়, ভিতরের সমস্যার কারণে সেই খাওয়াও হজম করতে পারেনা প্রায় সব বমি হয়ে যায়। এইজন্য গ্রাম- গঞ্জের গরীবের বাচ্চারও ব্লেন্ডার লাগে স্যার। "
আব্বুর মুখটা দেখে বুঝতে পারছি কথাগুলো চাবুকের আঘাতের মতো বিঁধল। মনে পড়লো দুমাস আগে আব্বুর জরুরি অফিসিয়াল অনুষ্ঠানে কোথায় যেন যাওয়ার কথা, সেদিন হঠাৎই ব্লেন্ডার কিনে বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে বলে চাচু নিজে আসতে পারেনি, বদলি ড্রাইভার পাঠিয়েছিল।আব্বু ভীষণ রেগে গিয়েছিল অন্য কোন ড্রাইভার হলে সাথে সাথে চাকরি নট হতো। বিশস্ত বিশ্বাসী বলে চাচু বেঁচে গেছিল। কিন্তু অনেক কথা শুনতে হয়েছিল --" গ্রামে গঞ্জে আবার ব্লেন্ডার!৷ সেটা কী আমার মিটিংয়ের চেয়েও জরুরি? " সেদিন ও চাচু ছলছল চোখে নিচে তাকিয়ে ছিল আজও সেই একই ভঙ্গিতে মাটিতে তাকিয়ে।
আব্বু হঠাৎ চাচুর হাতটা ধরে বার বার বলতে থাকে " আমাকে মাপ করে দিও....। "
আম্মু লজ্জায় কেমন কুঁকড়ে গেছে, প্রায় রাগ হতো আমাকে রেজাউল চাচুর বেশি আদর করাটা মনে করতো লোকদেখানো আদিখ্যেতা।
কিছুক্ষণ আগেও বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে ভালো লাগছিলো। এই মুহূর্তে আমার বুক ভারি হয়ে আসছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার চেয়ে অর্ধেক লম্বা কঙ্কালসার অচল ছেলেটা যেন ওর মায়ামাখা চোখে আমাকে বলছে ---তুমি আমার সূর্যোদয়ের ছায়া হয়ে বাবার সাথে থেকো।
" জানি আম্মু রাগ করবে কিন্তু তুমি কিভাবে বুঝতে পারলে আমার এটা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল?
" তুমারে তো এই আট বছরে চোক্ষের সামনে বড় হইতে দেখলাম। কেন জানি মনে হইলো তুমার এইটা খাইতে ইচ্ছা করতেছে, আমার ছেলেটা এইখানে থাকলে তারও মনে হয় চিপস খাইতে ইচ্ছা করতো, আমার ছেলেটা যদি....। "
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে যায়।আমি বুঝতে পারি আমার সমবয়সী ছেলের জন্য চাচুর মন কাঁদে।
আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে ফেরার পথে আম্মুর অফিসের তাড়া না থাকলে প্রায় নিজের টুকটাক কাজগুলো সারে। এই যেমন আজ নামল টেইলর্সে, আর এই কাজে পনেরো থেকে বিশ মিনিট লাগবে তা খুব জানা আছে। আম্মুকে একটা চিপস কিনে দেওয়ার কথা বলেছিলাম কিন্তু সপ্তাহে দুইটার বেশি খাওয়ার অনুমতি নেই, পরশুদিন সেই কোটা শেষ হয়ে গেছে সেটা মনে করিয়ে দিয়ে চলে গেলো। রেজাউল চাচু তখন গাড়ির বাইরে উল্টো মুখ করে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা কোনো ভাবেই শোনার কথা না। অথচ বেশির ভাগ সময়েই আমার প্রিয় খাবার গুলো ঠিক সময়ে নিয়ে এসে আমাকে চমকে দেয়। আব্বু আম্মুর পর রেজাউল চাচু আমাকে খুব ভালো বোঝে।
আমাকে অবাক করা এরকম কাজ চাচু প্রায় করে। কখনো কোকের ক্যান, কখনো আইসক্রিম, ঝালমুড়ি আরো কতকিছুই না এনে হাজির করে।
পয়সা খরচ করে এগুলো আনতে নিষেধ করলে কেমন যেন হয়ে যায় একই কথা বলতে থাকে
" আমার ছেলেটার বয়স আর তুমার বয়স তো একই তুমি খাইলে মনে হয় সে আমার সামনে বসে খাইতেসে। "
" তুমি যখন বাড়িতে যাও ওকে অনেক কিছু কিনে খাওয়াও তাই না? "
" নাহ্! সব রিজিক তো আল্লাহ সবার জন্য রাখেন নাই রে বাবা! ওর মায়ে যা খাওয়ায় তাই খায়। "
" আচ্ছা ও কী খেলতে বেশি পছন্দ করে ক্রিকেট না ফুটবল? "
" মনে হয় ফুটবল। খুব মনোযোগ দিয়া দেখে। ওর জন্যই টিভি কিনা দিসি।খুব সুন্দর কইরা বুঝায় দেয় ওর বোনে আমার মেয়েটা। ক্লাস ফাইভে পড়ে, নিজে পড়ে ভাইরেও পড়ায়। ভাইয়ের তিন বছরের ছোট কিন্তু আল্লাহ ওরে অনেক বেশি বুদ্ধি দিসেন। "
" আমি তো সেভেনে তাহলে তোমার ছেলেটাও সেভেনে তাকে ফাইভের মেয়ে পড়ায়! "
" হুমম"
ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায় চাচু।
ঢাকা থেকে মাত্র দেড় / দুই ঘন্টার রাস্তা মানিকগঞ্জে চাচুদের গ্রামটা কত সুন্দর,সেই গল্প শুনতে শুনতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল ঐ গ্রামে।
আমার সেই ইচ্ছেটা অপূরণীয় রেখেনি চাচু। আজ আমরা তালুকনগর গ্রামে এসেছি, আব্বুর ইচ্ছে থাকলেও আম্মু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার জোরাজোরিতে শেষ পর্যন্ত আসতে রাজি হলো।
আসলেই চোখ জুড়ানো সুন্দর গ্রাম। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ । ঢাকা থেকে এতো কাছে তবুও শহরে ছোঁয়া বেশি লাগতে দেয়নি।
কুমিল্লায় দাদাবাড়ী গেলে তো মনে হয়না কোনো গ্রামে এসেছি।নানাবাড়ি পাবনাতেও একই অবস্থা। বেশির ভাগ মানুষ হিন্দি সিনেমা আর সিরিয়ালে ডুবে থাকে। পাকা দোতলা বাড়ি বেশি চোখে পড়ে। আব্বু খুব দুঃখ করে এগুলো নিয়ে।
ধানিজমি কমে যাচ্ছে, সেখানে উঠছে মার্কেট বা অন্যকিছু আর এগুলো নিয়ে প্রায় আব্বু- চাচ্চুরা আফসোস করেন।
তালুকনগর গ্রামে ঢুকতেই আব্বু-আম্মু আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি চারিপাশ। রেজাউল চাচুর বর্ণনার চেয়ে আরো বেশি সুন্দর।
রেজাউল চাচুর বাড়িটাও খুব সুন্দর সামনে অংশে বড় বড় গাছ আম, কাঁঠাল, নারকেল আরও নাম না জানা অসংখ্য গাছ। ওদের গাছের অনেক কিছু চাচু প্রায় নিয়ে যায় আমাদের জন্য।
বাড়িতে ঢুকে বড় একটা ঘরে আমাদের বসতে দিলো। চাচু খুব অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে। 'রেজিনা' চাচুর মেয়ে আর বউ আমাদের জন্য সরবত নিয়ে এলো গাছের লেবু দিয়ে তৈরি,আরো অনেক রকমের পিঠা।আম্মু পিঠার চেয়ে প্রতিটি পিঠার প্লেটের নিচে বিছানো কুরুশ-কাঁটায় তৈরি ছোট ছোট রুমাল গুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছে দেখে চাচী খুব খুশি মনে বলে " ম্যাডাম আপনার এগুলি পছন্দ হইসে? আমি আপনারে এর চেয়েও সুন্দর করে বানায় দিবো। " আচ্ছা দিও " আম্মু খুব খুশি হয়ে বললো। ওদের এখানে আসা উপলক্ষে আব্বু আম্মু অনেক কিছু কিনেছে খাবার দাবার, ওদের দু ভাই-বোনের জন্য জামা কাপড়। আমার মাপেই কেনা হয়েছে চাচুর ছেলে মানে রাকিবের ড্রেস।
সেগুলো ওদের হাতে দেওয়ার জন্য আম্মু যখন রেজিনা আর রাকিব দুজনকে সামনে আসতো বল্লো তখনই হাসিখুশি পরিবেশটা কেমন ম্লান হয়ে গেলো যেন।
দুপুরের খাবার রান্নার কাজ পড়ে আছে বলে চাচী ভেতর বাড়িতে চলে গেলো।চাচু ঠিক কী করবে সেটা যেন বুঝতে পারছে না।
আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম ওদের আচরণে থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম " তোমাদের গ্রাম আর রাকিবকে দেখার জন্যই তো এলাম! ওকে ডাকো ওর সাথে গল্প করবো খেলবো। "
আব্বু আম্মুও একি কথা বললো।
" স্যার ম্যাডাম বেয়াদবি নিয়েন না । খাওয়ার পর একঘন্টা রাকিবকে শোয়ায় রাখতে হয় নাইলে সব বমি কইরা দেয়। আপনারা কি কষ্ট করে ভেতরে ওর ঘরে যাবেন? "
" আ-হা, ও কি অসুস্থ? চলো ওর কাছে চলো। " আব্বুর কথায় রেজাউল চাচু আর কথা না বলে আমাদের নিয়ে বড় উঠান পেরিয়ে ওদের ভেতর বাড়ির তিনটা ঘরের একটা ঘরে নিয়ে গেলো। আমরা যাওয়ার আগেই রেজিনা দৌড়ে পৌঁছে গেছে তার ভাইয়ের কাছে।একটা খাট, ছোট একটা পড়ার টেবিলের ওপর একটা ছোটো টিভি, দুটো চেয়ার আর একটা হুইল চেয়ার এই হলো রাকিবের ঘর। আমরা ঘরে ঢুকতেই রেজিনা ইশারায় শুয়ে থাকা ভাইকে দেখিয়ে দেয় সালাম দিতে। "আ স সা লা মু আ লা ই ক উ ম " অনেক কষ্ট করে ডান হাতটা খানিক উঁচিয়ে তারচেয়ে বেশি কষ্ট করে জড়ানো গলায় ভাঙা ভাঙা স্বরে সালাম দিলো রাকিব।
বিছানার উপর শোয়া রাকিব, ডান পা' টা ধনুকের মতো বাঁকা আর সরু,ডান হাতটাও বেশ বাঁকা। "হাতে কিছুটা জোর আছে,কিন্তু পা টা একদম অচল। ও হাঁটতে পারেনা। ওর খাদ্য নালি এতোটা সরু যে ছমাস এক বছরের বাচ্চাদের যে ভাবে ব্লেন্ড করে খাওয়াতে হয় ওকেও সেভাবে খাওয়াতে হয়, ভিতরের সমস্যার কারণে সেই খাওয়াও হজম করতে পারেনা প্রায় সব বমি হয়ে যায়। এইজন্য গ্রাম- গঞ্জের গরীবের বাচ্চারও ব্লেন্ডার লাগে স্যার। "
আব্বুর মুখটা দেখে বুঝতে পারছি কথাগুলো চাবুকের আঘাতের মতো বিঁধল। মনে পড়লো দুমাস আগে আব্বুর জরুরি অফিসিয়াল অনুষ্ঠানে কোথায় যেন যাওয়ার কথা, সেদিন হঠাৎই ব্লেন্ডার কিনে বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে বলে চাচু নিজে আসতে পারেনি, বদলি ড্রাইভার পাঠিয়েছিল।আব্বু ভীষণ রেগে গিয়েছিল অন্য কোন ড্রাইভার হলে সাথে সাথে চাকরি নট হতো। বিশস্ত বিশ্বাসী বলে চাচু বেঁচে গেছিল। কিন্তু অনেক কথা শুনতে হয়েছিল --" গ্রামে গঞ্জে আবার ব্লেন্ডার!৷ সেটা কী আমার মিটিংয়ের চেয়েও জরুরি? " সেদিন ও চাচু ছলছল চোখে নিচে তাকিয়ে ছিল আজও সেই একই ভঙ্গিতে মাটিতে তাকিয়ে।
আব্বু হঠাৎ চাচুর হাতটা ধরে বার বার বলতে থাকে " আমাকে মাপ করে দিও....। "
আম্মু লজ্জায় কেমন কুঁকড়ে গেছে, প্রায় রাগ হতো আমাকে রেজাউল চাচুর বেশি আদর করাটা মনে করতো লোকদেখানো আদিখ্যেতা।
কিছুক্ষণ আগেও বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে ভালো লাগছিলো। এই মুহূর্তে আমার বুক ভারি হয়ে আসছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার চেয়ে অর্ধেক লম্বা কঙ্কালসার অচল ছেলেটা যেন ওর মায়ামাখা চোখে আমাকে বলছে ---তুমি আমার সূর্যোদয়ের ছায়া হয়ে বাবার সাথে থেকো।
😍😍😍
ReplyDeleteBah!
ReplyDelete❤️
ReplyDelete