ফারিহা শাহরিনের গল্প


কাপ আইসক্রিম




সেই কখন থেকে ছেলেটা পিছু পিছু আসছে। লামিয়া ঈষৎ বিরক্তবোধ করছিল। আরো কিছুক্ষণ পর বিরক্তিটা রাগে পরিণত হলো। মার্কেট থেকে বেরিয়ে মায়ের হাত ধরে বাসার পথে রওনা দেবার কিছু পরেই খেয়াল করলো একটা ছেলে তাদের পিছু নিয়েছে। বয়সে তার সমান বা কিছু ছোট হবে। লামিয়া ক্লাস ফাইভে পড়ে। স্কুলের বইখাতা কিনতে গিয়েছিল পাশের একটা মার্কেটে। বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথ, তাই রিকশা নেয়নি ওরা। মায়ের হাতে বইখাতার ব্যাগটা, লামিয়ার হাতে আইসক্রিম।
ইগলুর কাপ আইসক্রিম। কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খেতে খুব মজা। লামিয়া চুকচুক করে আইসক্রিম খেয়ে খুব মজা করে মায়ের সাথে হাঁটছিল। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে ভয়ে তার মজা সব উড়ে গেল। ছেলেটা পিছু নিয়েছে কেন? বাবার কাছে শুনেছে এই বয়সী ছেলেরাও ছোট ছোট ছিনতাইয়ের কাজ করে। হাতের জিনিস কেড়ে নিয়ে এক ছুটে পালায়। মাকে সাবধান করতে হবে। মা একটা যা তা। এমন সময়ে কানে ফোন লাগিয়ে রেখেছে। খালামণির সাথে গল্প করতে করতে হাঁটছে। যদিও ফুটপাতে, তবু লামিয়ার বিরক্ত লাগে কাউকে হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলতে দেখলে। লামিয়া খুব সতর্ক। বাবা যা বলে লামিয়া সব মনে রাখে। কখনো অসতর্ক হয় না। সে আইসক্রিম খাবার ফাঁকে ফাঁকে ছেলেটার দিকে নজর রাখছিল।

গরমে আইসক্রিম দ্রুত গলে যায়। ছেলেটার দিকে মন দিতে গিয়ে আইসক্রিম খেতে দেরী হচ্ছিল। আইসক্রিম গলে দুধ হয়ে যাচ্ছে। ওটা এক বিরক্তিকর ব্যাপার। দুধ তার এমনিতে অপছন্দ, তার উপর কাঠি দিয়ে এই দুধ আইসক্রিম খাওয়া অসম্ভব জটিল ব্যাপার। গলে যাওয়া অংশগুলো দ্রুত খেতে চেষ্টা করলো চাকুম চাকুম করে। কিন্তু পেছন দিকে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে ভাবতে খাওয়া থেমে গেল। সে মাকে ফিসফিস করে ডাকলো মা মা দেখো ছেলেটা পেছন দিকে আসছে। মা তার দিকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল। তারপর ফোনের কথায় হাহাহিহি করতে থাকলো। সময় চলে যাচ্ছে, আইসক্রিম গলে যাচ্ছে, রাগে লামিয়ার শরীর রি রি করছে।

সে আবারো আইসক্রিমে মন দিল। গলে যাওয়া অংশ বাদ দিয়ে বাকীটা খেতে থাকলো দ্রুত। দ্রুত খেতে গিয়ে গলায় লেগে যাবার দশা। আড়চোখে পেছনে দেখলো ছেলেটা ঠিক লেগে আছে। জাফর ইকবালের লেখা টুনটুনি ও ছোটচ্চু গল্পের কথা মনে পড়লো তার। এরকম সময়ে টুনটুনি কী করতো? লামিয়া তার ছোট্ট মাথায় টুনটুনির বুদ্ধি ধার করার চেষ্টা করলো। গোয়েন্দা গল্পে এরকম কেউ পিছু নিলে তাকে খসিয়ে ফেলতে হয়। খসিয়ে ফেলার জন্য নানান গলি ঘুপচি লাগে। এখন তারা সোজা বড় রাস্তার ফুটপাত ধরে হাটছে। এখানে ছেলেটাকে কিভাবে খসাবে সে বুঝতে পারলো না। মা এখনো ফোনে খিলখিল করে হাসছে। বুঝতেই পারছে না পেছন দিকে একটা বিপদ এগিয়ে আসছে। বড়রা মাঝে মাঝে এমন গাধামো করে।

আইসক্রিম শেষ হয়ে আসছে। গলে যাওয়া অংশটা চাকুম চুকুম করে কাঠের চামচ দিয়ে শেষ করার চেষ্টা করছে সে। আইসক্রিমের সবটুকু মজা। শেষ ফোঁটাও সে চেটে খেয়ে ফেলে আচারের মতো। খাওয়া শেষে কাঠিটা রেখে কাপটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আইসক্রিম খাওয়া শেষে কাঠিটাই তার সবচেয়ে প্রিয়। সুন্দর মসৃণ ডিজাইনের কাঠিগুলো সে জমিয়ে রাখে। খালি কাপটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে বাবার নির্দেশ মনে পড়লো, যেখানে সেখানে উচ্ছিষ্ট ছুঁড়ে ফেলতে নেই। ডাস্টবিন খুঁজে ফেলতে হবে। ওটাই সভ্যতা। বাবা এখন অফিসে থাকলেও সে অসভ্যতা করতে পারে না। এদিকে কোন ডাস্টবিন নেই। কী করবে? হাতে নিয়ে বাসায় চলে যাবে?

সামনে একটা ইলেকট্রিক পিলার দেখতে পেয়ে সে আলগোছে তার পাশে কাপটা রেখে দিল। তারপর মায়ের সাথে হাঁটতে লাগলো। ছেলেটা এখনো পিছু লেগে আছে কিনা দেখার জন্য পেছনে তাকিয়ে যা দেখলো তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। ছেলেটা আইসক্রিমের কাপটা কুড়িয়ে নিয়ে কাপের ভেতর মুখ দিয়ে আইসক্রিমের তলানিটা খাবার চেষ্টা করছে।

মায়ের ফোন শেষ হয়েছে। এবার মা তাড়া দিল, ‘কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে পড়লে কেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। জলদি পা চালাও’।

লামিয়া চলতে চলতে একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো -সেই ছেলেটা আর পিছু পিছু আসছে না। আইসক্রিমের খালি কাপটার মধ্যেই তার সমস্ত মনোযোগ।






Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা