নাহার তৃণার অনুবাদ গল্প

 ক্ষীণদৃষ্টির ভাইদের গল্প


চীন দেশের এক শহরের শেষপ্রান্তে বিশাল এক বাড়িতে তিন ভাই বাস করতো। তিন ভাইয়েরই চোখের অবস্হা ছিল বেশ খারাপ। চোখে ভালো দেখতে না পারার কারণে তিন ভাই তাদের ব্যবসাবাণ্যিজ্য ঠিকঠাক দেখাশোনা করতে পারতো না। বিশেষ করে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারটা। ছোট ভাই ঠিক করলো, এখন থেকে সে টাকা পয়সার দিকটা দেখাশোনা করবে।

 তাই সে বাকি ভাইদের উদ্দেশ্য করে বললো , "বড় ভাইয়ের চোখের অবস্হা খুবই খারাপ, তিনি ঠিক মতো দেখতেই পান না কত টাকা তাকে দেয়া হলো বা তিনি অন্যকে কত দিলেন।" সে আরো বললো। "লোকেরা তার দুর্বলতার সুযোগ নেবার চেষ্টা করে।"

"তুমি যেন কত্ত দেখো চোখে," টিটকারি দিয়ে ওঠলো মেজো ভাই। "যদি এমনটা চিন্তা করে থাকো, যে আমাদের টাকাপয়সার লেনদেন তারই করা উচিত যে আমাদের মধ্যে চোখে সবচে' ভালো দেখে, তাহলে আমি বলবো সেটি হচ্ছি আমি। টাকা পয়সা লেন-দেনের দায়িত্বটা আমাকেই দেয়া উচিত। কারণ তোমাদের দু'জনের চেয়ে আমার চোখের দৃষ্টি অনেক ভালো।"



"এতে আমার ব্যাপক সন্দেহ আছে।" বড় ভাই বলে ওঠে। "এসো আমরা বরং এর একটা স্হায়ী সমাধান বের করি। আমি শুনেছি আজ রাতে মন্দিরের প্রধান গেটে বাণী খোদাই করা একটা ফলক টাঙানো হবে। চলো আগামীকাল সেখানে গিয়ে আমাদের কার চোখের অবস্হা কেমন সেটা পরীক্ষা করি। যে খুব অনায়াসে ফলকের লেখা পড়তে পারবে তার হাতেই টাকা পয়সা লেনদেনের দায়িত্ব দেয়া হবে। তোমরা রাজী?"

"রাজী", একসাথে বাকি দুই ভাই বলে উঠলো।

"বেশ! এখন তোমরা যাও তো বাপু, চোখের একটু বিশ্রাম নিতে দাও।"

দুই ভাই চলে যাওয়া মাত্রই, বড় ভাইটা করলো কি তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা মন্দিরে গিয়ে সেখানকার পুরোহিতের সাথে দেখা করলো।

"আমি শুনেছি আপনারা মন্দিরের সদর দরজায় বাণী লেখা একটা ফলক টাঙাবেন।" বড় ভাই বললো।  "আপনি কি আমাকে ফলকে কী লেখা আছে পড়ে শোনাতে পারেন?"

"অবশ্যই। ফলকে কনফুসিয়াসের মহান একটা উক্তি লেখা আছে। যাতে বলা হয়েছে , "সব সময় সৎ থেকো।"

আগেভাগে ফলকের লেখা জেনে নিয়ে বড় ভাই নিজের বুদ্ধির প্রশংসায় মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে বাড়ি চলে গেল। 

অল্প কিছুক্ষণ পর মেজো ভাই মন্দিরে এসে উপস্হিত হলো।

" আপনি কি বলতে পারেন মন্দিরের সদর দরজায় যে ফলকটা টাঙানো হবে তাতে কি লেখা আছে, পড়ে শোনাবেন?" মেজো ভাই পুরোহিত কে বললো।

"বিষয়টা নিয়ে দেখছি সবার জানার কৌতূহল।" পুরোহিত উত্তর দিলেন। এতে লেখা, " সব সময় সৎ থেকো।"

"এটার চারপাশে কোন নকশা টকশা আছে নাকি?"

"ফলকটার চারপাশে ফুলের নকশা আছে।" মেজো ভাই নিজের বুদ্ধিতে আনন্দে ডগমগ হয়ে বাড়ি চলে গেল। 

সে যেতে না যেতেই ছোটভাই এসে হাজির। আগের দুই ভাইয়ের মতো সেও পুরহিত কে ফলকে কি লেখা আছে সেটা পড়ে শোনানোর অনুরোধ করলো। এছাড়া ফলকের আর কোথাও অন্য কিছু লেখা আছে কিনা সেটাও জেনে নিতে ভুললো না।

"একদম নীচে শুধু দাতার নাম, 'ওয়াং লী' লেখা আছে।" পুরোহিত তাকে জানিয়ে দিলেন। 

পরদিন সকালে ক্ষীণদৃষ্টির তিনভাই মন্দিরে গিয়ে উপস্হিত হলো।

"ওই তো ফলকটা।" মন্দিরের কাছাকাছি আসা মাত্রই বড়ভাই বলে উঠলো। ফলকে কি লেখা আছে আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। এতে বলা আছে, " সব সময় সৎ থেকো।"

"তোমার চোখের অবস্হা যতটা খারাপ ভেবেছিলাম তারচে ঢের ভালো।" মেজো ভাই বলে উঠলো। "তবে অবশ্যই আমারচে' অতটা ভালো নয়। ফলকের চারপাশে কোনো অলংকরণ কি দেখতে পেয়েছো তুমি?"

"অলংকরণ? কিসের অলংকরণ?"

"ফলকটার চারপাশে ফুলের নকশাদার অলংকরণ আছে।" বিজয়ীর ভঙ্গিতে উত্তর দিলো মেজো ভাই।

" খুব ভালো, খুব ভালো।" প্রশংসার সুরে বললো ছোট ভাই। "কিন্তু তোমাদের দু'জনের কেউ কি ফলকের বাণীটা ছাড়াও অন্য কোনো লেখা দেখতে পাচ্ছো?"

"অন্য কিছু লেখা?" বিড়বিড় করলো মেজো ভাই, তার মুখটা কেমন ঝুলে পড়লো। "অন্য কিছু আবার কি লেখা আছে ফলকে?"

"দাতার নাম, ওয়াং লী" আঙুল তুলে দেখানোর ভঙ্গি করলো ছোট ভাই," তোমরা দেখতে পাচ্ছো না? একদম কোণার দিকটায় আছে লেখাটা।"

আগের দিন সন্ধ্যায় তিন ভাইয়ের সাথে যে পুরোহিতের দেখা হয়েছিল, সেই পুরোহিত ঠিক তখন মন্দির থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন।

"ওহ তোমরা কি ফলকটা দেখতে এসেছো?" পুরোহিত জানতে চাইলেন, "খুব দুঃখিত, গত সন্ধ্যায় ফলকটা টাঙানোর কথা থাকলেও আমরা ওটা টাঙাতে পারিনি। আজ নিশ্চয়ই সেটা টাঙানো হবে।" তিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন পুরোহিত।

উপর চালাকি করতে গিয়ে তিন ভাই কতটা বোকামি করে বসেছে সেটা বুঝতে পেরে তিনজনই খুব লজ্জিত হলো।



-------------------


মূলগল্প : The Short-Sighted Brothers (Chinese Story) by Anonymous

 

 

                                                                 



Comments

  1. শিক্ষামূলক, আবার একই সঙ্গে আনন্দপাঠ। একবারও মনে হয়নি যে অনুবাদ।

    ReplyDelete
  2. হা হা! খুবই মজা পেলাম। বৈশালীকে শোনাতে হবে। খুব সুন্দর অনুবাদ আপু।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা