সাইফুদ্দিন মাহমুদের গল্প
নিয়ামুল ক্লাস ফাইভের লাস্ট বেঞ্চিতে বসে সবসময়। বসে বলাটা শুদ্ধ হলো না। তাকে সবসময় পেছনের বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দেখতে দেখতে প্রতিদিন সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রথম দিকে এটা নিয়ে হাসাহাসি হতো। বছরের শুরুতে যখন ক্লাস ফাইভের ক্লাস শুরু হয় তখন মাসখানেক এই দৃশ্য দেখে নতুন ওঠা ক্লাস ফাইভের ছেলেরা হেসে ফেলতো।
ক্লাস ফাইভে সবাই নতুন। শুধু নিয়ামুল ছাড়া। নিয়ামুল গত তিন বছর ধরে ক্লাস ফাইভে পড়ে যাচ্ছে। প্রথমবার তার সাথে যারা ফাইভে উঠেছিল সেই বন্ধুগুলো এখন ক্লাস এইটে উঠে গেছে। কিন্তু বছরের পর বছর ফেল করতে করতে নিয়ামুল ফাইভেই থেকে গেছে। ফাইভে থেকেই সে সবার চেয়ে প্রায় পৌনে এক ফুট লম্বা হয়ে গেছে। তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে না কারণ সে এই স্কুলের দফতরির ছেলে। দয়া করে তার নামটা এখনো রাখা হয়েছে।
পেছনের বেঞ্চিটা নিয়ামুলের পছন্দ ছিল শুরু থেকেই। পড়া না পারলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার যে লজ্জা সেটা পেছনের বেঞ্চিতে কম লাগে। সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে ক্লাস করে। পেছনের দিকে তাকালে শিক্ষকের বকা শুনতে হয়। তাই নিয়ামুল পেছনের বেঞ্চিতে একা বসতে পছন্দ করে। আসলে সে ততক্ষণই বসে যতক্ষণ ক্লাসে টিচার না আসে। টিচার আসলে পড়া জিজ্ঞেস করবে, সে পড়া শিখে আসে না কোনদিনই, সুতরাং তাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
প্রথম দিকে তাকে পড়া জিজ্ঞেস করতো টিচার, তারপর বলতো কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর এমন হয়েছে টিচার ক্লাসে ঢুকলে সে আপনাতে বেঞ্চে উঠে কান ধরে দাঁড়িয়ে যায়, তাকে আর পড়া জিজ্ঞেস করতে হয় না। বছরের পর বছর নিয়ামুলের ক্লাস ফাইভে থাকার কারণে তার নাম হয়ে গেছে নাদু ভাই। ছাত্র শিক্ষক সবাই নাদু ভাই বললে এক নামে চেনে। এখন মুশকিল হয়ে গেছে সে তিন বছরে অনেক ঢ্যাঙা হয়ে গেছে। কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়ালে তাকে আরো বিশাল লাগে। তাই বেঞ্চে দাঁড়ানো মাফ করে দিয়ে তাকে শুধু দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি দেয়া হয়। কান ধরার ব্যাপারটিও ধীরে ধীরে কমে গেছে। এখন শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হচ্ছে আরো এক বছর ক্লাস ফাইভে থাকতে পারলে তার দাঁড়ানোর ব্যাপারটিও মাফ করে দেয়া হবে। সুতরাং নাদু ভাই অপেক্ষা করে ক্লাস ফাইভে আরো এক বছর কাটানোর জন্য।
কিন্তু সে বছর হঠাৎ করে একটা মহামারী আঘাত হানে সারা বিশ্বব্যাপী। সব স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়। সরকার থেকে নির্দেশ আসে আর কোন পরীক্ষা হবে না। ক্লাস হবে না। সবকিছু ছুটি। বছর শেষে সবাই অপেক্ষা করে কখনো যাবে এই মহামারী। কিন্তু কিছুতেই কমে না দুর্যোগ। শেষমেষ সরকার ঘোষণা দেয় কোন স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা নিতে হবে না। সবাইকে অটো পাশ করে দেয়া হবে।
করোনা মহামারী সারা পৃথিবীর জন্য বিপদ ডেকে আনলেও নাদু ভাইয়ের বিরাট উপকার করলো। অটো পাশের সুযোগে নিয়ামুল ওরফে নাদু ভাই অবশেষে ক্লাস ফাইভ থেকে প্রমোশন পেয়ে সিক্সে উঠে গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো নাদু ভাইয়ের পরিবার।
Comments
Post a Comment