মোহিত কামালের গল্প
টুঙ্গিপাড়ার হিমালয়
পুকুরপাড়ে আছে একটা আমগাছ। ঝাঁকড়া মাথার গাছটার একটা ডাল পুকুরের পানির ওপর ঝুঁকে আছে। ডালের সবুজ পাতারা চিকচিক করছে ভোরের কাঁচা সোনা রোদের পরশ পেয়ে। পাতার আলো প্রতিফলিত হচ্ছে পানিতে, ঝিকমিক করছে। পানিতে বয়ে যাওয়া চোখ ধাঁধানো দৃশ্যটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে ডালে বসা একটা মাছরাঙা পাখি। আর পুকুরঘাটে বসে পাখির দিকে চেয়ে আছে এক কিশোর, খোকা।
মাছরাঙাটার দেহের তুলনায় মাথা বড়ো। লম্বা, ধারালো, চোখা ঠোঁট, খাটো পা আর খাটো লেজ রয়েছে ওর। গায়ের রং উজ্জ্বল। পাখনায় আর মাথায় নীলের ওপর ফিরোজা রঙের বুটি, চোখের নিচ থেকে লাইনের মতো মেরুন-সাদা রঙের মেশানো টানটা সুন্দর। আর বুকের দিকটা সোনালি রঙের! সুন্দর পাখিটা প্রাণভরে দেখতে মোটেও ক্লান্তি লাগছে না। মাছরাঙার চোখের নিশানা পানিতে, আর খোকার নিশানা মাছরাঙার মনোযোগী চোখের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে পড়ে গেল দাদুর বলা-কথা। দাদুভাই বলেছিলেন, ‘তিন রকম মাছরাঙা আছে : গাঙ মাছরাঙা, পান মাছরাঙা আর গেছো মাছরাঙা। এটা গেছো নাকি পান মাছরাঙা, দেখে চিনতে পারল না খোকা। ধরে নিল গাছে বসা মাছরাঙাটা আসলে গেছো মাছরাঙা।চোখের পলকে একটা কাণ্ড ঘটে গেল। ডাল থেকে ডাইভ দিয়ে সাঁই করে পানিতে ডুবে গেল মাছরাঙাটা। পলকে আঙুলসমান লম্বা একটা বেলে মাছের বাচ্চা ধরে ফেলল শিকারি মাছরাঙা। মাছটা মাছরাঙার ঠোঁটের চিপার মধ্যে আটকে গেল। এবার গাছে নয়, তার বাসার দিকে উড়ে গেল। ঢুকে গেল গাছের ঝোপের ভেতর।
মাছরাঙার নিপুণ শিকার-কৌশল দেখে খুশি হয়ে গেল খোকা। মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করলে সফলতা ছিনিয়ে নেওয়া যায়, সফল হওয়া যায়। সব কাজে চোখ আর মনের সংযোগ ঘটাতে পারলে জীবনে এগিয়ে যাওয়া যাবে। ভাবতে ভাবতে বসা থেকে উঠে গাছের ঝোপের ভেতর বাসা খুঁজতে লাগল খোকা। নিচ থেকে দেখতে পেল না পাখির বাসা। এদিক ওদিক খুঁজল। না। দেখা যাচ্ছে না। খোকার কৌতূহল মিটছে না। টগবগ করে উঠল ওর অনুসন্ধানী মন। চুপিচুপি উঠতে লাগল গাছে। শাখা-প্রশাখার পাতার আড়ালে একটা তিনকোনা ডালের ফাঁকে দেখল খড়কুটো দিয়ে বানানো বাসাটা। খোকার প্রাণ জুড়িয়ে গেল যখন দেখল মাছরাঙা পাখিটা নিজে না খেয়ে একটা ছানা মাছরাঙাকে খাওয়াচ্ছে।
খোকার চোখে বিস্ময় জেগে উঠল। পাখিদের মধ্যে এত সুন্দর মমতার জীবন রয়েছে! নিজের জন্য নয়, অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এত প্রাণকাড়া কাজ করতে পারে পাখিরা? নিশ্চয়ই ছানাদের জন্য ওদের স্নেহ-মমতা মানুষের চেয়েও বেশি। পরের জন্য ওরা সব করে। ভাবতে ভাবতে জীবনের নতুন শিক্ষা পেয়ে গেল খোকা। অন্যের জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করার প্রেরণা ঢুকে বসে গেল ওর মনে, মগজে। ছিপছিপে লম্বাটে গড়নের খোকার বুকের ছাতা ফুলে উঠল, বেড়ে গেল কয়েক ইঞ্চি। নিজের প্রতি বিশ্বাসের একটা জোয়ার ঢুকে গেল মনে। সাহস আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে গাছ থেকে নেমে আসতে গিয়ে দেখল অসংখ্য কালো পিঁপড়া লাইন ধরে উঠছে গাছ বেয়ে। ওদের গতিপথ দেখার জন্য গাছের মূল কাণ্ড থেকে সরে একটা শাখায় আশ্রয় নিয়ে দেখতে লাগল পিঁপড়ার সুশৃঙ্খল যাত্রা, সার বেঁধে এগিয়ে যাওয়া। এগিয়ে আসতে থাকা কালো পিঁপড়াগুলোর মাথা বেশ মোটা, চিকন ঘাড়, দেহ বেশ ভারী। চিকন ধারালো শুঁড় আর পা চালিয়ে ওরা সহজে উঠে যাচ্ছে উপরে। কোথায় ওদের নিশানা?
কোথায় যাচ্ছে ওরা?
পাখির বাসার দিকে?
মাছরাঙার ছানাটাকে খেয়ে ফেলবে?
পুকুর থেকে ধরা বেলে মাছটাকে লুটে নেবে?
মাথায় জেগে ওঠা এসব প্রশ্ন ভয় পাইয়ে দিল খোকার মনে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করল ওই নিরীহ পাখির বাসাটা রক্ষা করতে হবে। ভাবনামতো কাজ। পাতার ঝাড়ওয়ালা একটা ডাল ভেঙে মূল কাণ্ড বরাবর অবস্থান নিয়ে ঝাড়ু দেওয়ার মতো করে পিঁপড়ার দলকে ঝাড় দিতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল ওদের পথ। কিছু পিঁপড়া পড়ে গেল নিচে, মাটিতে। গতিপথ পালটে ওরা হটে গেল। মাছরাঙার ছানার জীবন রক্ষা করতে পেরে সাহসী হয়ে উঠল খোকা।
কিছুক্ষণ পর ও চমকে উঠল। অবাক হয়ে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে দেখল অসংখ্য পিঁপড়া গাছের গোড়ায় আবার জড়ো হয়েছে। আরো তীব্র গতিতে উঠতে লাগল উপরে। ওরা পরাজয়কে মেনে নেয়নি। পরাজয়ের পর সংঘবদ্ধ হয়ে আরো জোরকদমে উপরের দিকে আসছে। হাল ছেড়ে দেওয়ার ছেলে নয় খোকা। সে এবার হাতে নিল আরেকটা ডাল। নিরাপদ দূরে থেকে একবার ডান হাতে আরেকবার বাঁ হাতে বাড়ি মারতে লাগল পিঁপড়ার মিছিলের অগ্রভাগে। মিছিল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আবারও আত্মতৃপ্তি পেয়ে খোকা নিচে নেমে এল। খোকার ঘোর কাটল না। পিঁপড়াদলকে পরাজিত করা যাচ্ছে না। ওরা বারবার সংঘবদ্ধ হওয়া শুরু করল। সংঘবদ্ধভাবে জয়ের জন্য এগোলে জয় নিশ্চিত ধরা দেবে ওদের হাতে—ভাবতে ভাবতে ও আবার গাছে উঠে গেল। আবার পজিশন নিয়ে মাছরাঙার বাসার দিকে তাকিয়ে বোকা বনে গেল। বাসাটা খালি। মাছের কাঁটা ঝুলে আছে বাসার খড়ের সঙ্গে। পিঁপড়ারা সে দিকে ছুটছে। মনে মনে খুশি হলো এ ভেবে যে, মাছরাঙা তার ছানাকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। একইসঙ্গে বুঝে ফেলল সংঘবদ্ধ জীবন, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের মূল্য সবচেয়ে বেশি। নতুন নতুন পথ খুলে এগোতে হবে। জয় ছিনিয়ে আনা তখন সহজ হবে।
দুই.
বাড়ির ভেতর থেকে দাদুভাই বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কী মিয়া ভাই, অমন করে কী খুঁজছো? গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন? হাঁ বন্ধ করো। চোখ মেলে তাকাও। চোখ মেলে দেখো, মুখ খুলে নয়।’
বংশের বড়ো ছেলে বলে দাদুভাই ওকে মিয়াভাই বলে ডাকেন। এখন দাদুভাইয়ের কথা শুনে সংকোচে কিছুটা দমে গিয়েও বলল, ‘পাখি দেখছি, দাদুভাই, পাখি। মাছরাঙা পাখি দেখেছি, গেছো মাছরাঙা গাছ থেকে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কীভাবে ওরা মাছ ধরে, কীভাবে ওদের ছানাপোনা লালনপালন করে, কীভাবে আদর করে, দেখেছি।’
‘শুধু মাছরাঙা দেখলে হবে? আর কিছু দেখোনি? দোয়েল, ঘুঘু, কানিবক, বাবুই পাখির ঝাঁক, বাসা দেখনি?’
‘দেখছি, দেখার চেষ্টা করছি, বোঝার চেষ্টা করছি ওরা কত মুক্ত, ওরা কত স্বাধীন, খোলা পৃথিবীতে ওরা নিজেদের মতো করে বাঁচে। কীভাবে ছানাকে আদর করে, বড়ো করে, দেখেছি।’
‘তোমার মা তোমাকে আদর করে না? তোমার বাবা? তোমার দাদু তোমাকে আদর করে না? দাদাভাই? ওদের চেয়েও বেশি আদর করে পাখি পাখির ছানাকে?’
‘হুম হুম হুম। আমার তা-ই মনে হয়েছে। তোমাদের আদরের পাল্লার চেয়ে ওদের পাল্লা অনেক ভারী, অনেক দামি, বুঝেছ?’
‘বাহ্! তোমার দেখার চোখ তো খুব ধারালো! বোঝার ক্ষমতাও খুব খুউব ভালো!’
‘তুমি কি ভেবেছিলে আমি কম বুঝি?’
‘ভেবেছিলাম তো। ভেবেছিলাম শুধু ফুটবল খেলতে জানো, শুধু দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি হুটোপুটি করতে জানো। শুধু ধুলোবালিছাই আর গায়ে কাদা মেখে ভালো করে গোসল না-করে ঘরে ঢুকতে জানো। আর খেলার মাঠের নেতা হতেও জানো। কিন্তু এসব ভাবনা এখন পানিতে ফেলে দিলাম। হা হা হা হা! তবে শেষের ভাবনাটা রেখে দিলাম মাথায়।’
দাদুর হাসি আর উৎসাহ পেয়ে খোকা ছুটতে লাগল পাশের তালগাছটার দিকে। সেখানে আছে বাবুই পাখির বাসা। বাসাগুলো কী চমৎকারভাবে ঝুলে থাকে তালপাতার সঙ্গে, ঝড়-তুফানেও এসব বাসা উড়ে যায় না। কী দিয়ে বানায় এমন সুন্দর বাসা? জানার কৌতূহল জেগে উঠল খোকার মনে। কৌতূহল থেকে সে তালগাছের তলে এসে দাঁড়াল। তারপর মাকড়সার মতো হাত-পা চালিয়ে উঠতে লাগল গাছে। দাদুভাই ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘মিয়াভাই, নেমে এসো। তালগাছে ওঠা কঠিন। তালপাতার ঝাঁকড়া মাথার ঝোপের মধ্যে সাপ থাকতে পারে। নেমে এসো, মিয়াভাই!’
দাদুর কথা পাত্তাই দিল না খোকা। উঠতে লাগল উপরে, আরো উপরে। সাহসের ঘাটতি নেই ওর। কৌতূহলের কাছে হেরে গেল ভয়ডর। উঠে গেল সে তালগাছের মুড়ির কাছে, মাথার কাছে। গাছের মাথায় উঠে বসল এবার। এখান থেকে বাবুই পাখির বাসাগুলো ছোঁয়া যাবে না। দু’বাহু বাড়ানোর মতো দেখতে তালের পাতার অগ্রভাগে ঝুলে আছে অপূর্ব কারুকাজ করা বাসা। খড়কুটো দিয়ে, চিকন সুতোর মতো লতা দিয়ে মোড়ানো এত সুন্দর বাসা তৈরি হতে পারে! এত বুদ্ধি ওদের! দেখে খুশি হয়ে গেল ও। নিবিড়ভাবে বাবুইদের বাসা বানানোর কারিগরি দিক দেখার সময় কোত্থেকে বেরিয়ে এলো চিকন সুতোর মতো দেখতে একটা সবুজ রঙের সাপ।
এটা কি বিষাক্ত সাপ! মনে প্রশ্ন এলো। কিন্তু ভয় পেল না খোকা। নিজেকে প্রস্তুত করে নিল শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য। সাহস বেড়ে গেল কয়েকগুণ বেশি। সাহস নিয়ে ও খপ করে ধরে ফেলল সাপের লেজ। তারপর একটা ঘূর্ণি দিয়ে সাপটাকে ছুড়ে মারল দাদুভাইয়ের দিকে। তিনি পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘নেমে এসো, নেমে এসো!’
গাছের উপর থেকেই খোকা উল্লাসে ফেটে পড়ল। দাদুভাইয়ের কিছুক্ষণ আগে দেওয়া হাসির জবাব দিল হা হা হা হা করে।
একসময় চুপ হয়ে গেল ও। মনে মনে ভাবল বড়দের কথা মানতে হয়। শুনতে হয়। বড়দের অভিজ্ঞতা নিজের করে নিতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সামনে এগোতে হয়। না হলে বিপদ হতে পারে। সে বিপদে বড়ো কিছু ঘটে যেতে পারে। আর তাই দাদুর জন্য আলাদা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মাথায় নিয়ে ও ধীরে ধীরে নেমে এলো গাছ থেকে। তারপরে দাদুভাইকে বলল, ‘তোমাকে স্যালুট, দাদুভাই।’
দাদুভাই স্যালুটের জবাব দিলেন না। অভিমান করে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। খোকা বাধা দিল না দাদুভাইকে। তার চলে যাওয়া দেখছে। আচমকা ওর খারাপ লাগা শুরু হলো। তখনই একছুটে দাদুভাইয়ের সামনে হালুম করে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই যে, ধরলাম কান।’ ধরে উঠবস করল ও।
‘আর তোমার কথা অমান্য করবো না, দাদুভাই।’ আবার বলল খোকা।
হেসে দিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘দোয়া করি তুমি হবা অনেক বড়ো, হিমালয় সমান উঁচু, সাহসী। আমি দোয়া করি, টুঙ্গিপাড়ার খোকা যেন দুনিয়ায় আলো ছড়ায়। প্রাণ থেকে দোয়া করি।’
দাদুর দোয়া মাথায় নিয়ে খোকা এবার ছুটতে লাগল পুকুরের দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরে। সাঁতরে এদিক থেকে ওই পাড়ের কাছে চলে গেল। দুঃসাহসী খোকার আনন্দ দেখে পাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন সকালের সূর্য থেকে একটা অন্য ধরনের আলোর রোশনি খোকার দিকে উড়ে উড়ে আসছে।
হুম করে ডুব দিয়েছে খোকা। ডুবেই আছে। উঠছে না। আতঙ্কিত হয়ে দাদুভাই পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন পানির ভেতর থেকে গর্জন তুলে আকাশের দিকে উঠে এসেছে হিমালয়সমান উঁচু এক পানির স্তম্ভ। তার চূড়ায় বসে হাসছে তাঁর আদরের মিয়াভাই, তাঁদের বংশের উজ্জ্বল বাতি, হিমালয় উচ্চতা ছাড়িয়ে যাওয়া খোকা।
Comments
Post a Comment