লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া
হারাধনের দশটি ছেলে
হারাধনের দশটি ছেলে হারিয়ে গেছে ভাই
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি কোথায় খুঁজে পাই?
দশটি ছেলেই দেশের প্রেমিক দেশেরই গান গায়
স্বাধীনতার জন্যে জীবন বিলিয়ে দিতে চায়।
অত্যাচারী শাসকগুলোর মসনদে দেয় হানা
হারাধনের দশটি ছেলের নাম সকলের জানা।
ইংরেজদের দুঃশাসনের তখন গ্রহণকাল
দুইশো বছর নিপীড়নের,রক্তে ভেজা,লাল।
একটি ছেলে বললো বিদায় দে মা ঘুরে আসি
ফাঁসির দড়ি গলায় পরেও মুখে অটুট হাসি।
সোনালি অক্ষরে লেখা সেই ছেলেটার নাম
অস্ত্রাগারের অস্ত্রশস্ত্র লুট করেছে কে?
ইংরেজদের তাড়াতে চায় দুঃসাহসী সে!
চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধার নামটা সূর্যসেন
বাজিয়েছে ইংরেজদের বিদায়ী সাইরেন।
মৃত্যুঞ্জয় একটি ছেলে নামটা তীতুমীর
বাঁশের কেল্লা বানিয়েছিলো দুঃসাহসী বীর।
বাংলা ভাষার কী অপরূপ আলোর পিদিম জ্বেলে
'বর্ণপরিচয়' লিখেছে একটি সোনার ছেলে।
সেই ছেলেটা নারী মুক্তির অবাক কথা কয়
বিদ্যাসাগর নামেই যে তাঁর দীপ্ত পরিচয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়
সমাজ থেকে অন্ধকারকে হটিয়ে দিতে চায়...
একটি ছেলে নাম বরকত গাইলো ভাষার গান
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ বিলিয়ে দিলো প্রাণ!
একটি ছেলে নাম মতিউর ইশকুলে সে পড়ে
আইউব শাহী পালিয়ে গেলো সেই ছেলেটার ডরে!
একটি ছেলে গণতন্ত্রের জন্যে লড়াই করে
নূর হোসেনের নাম বললেই চিনবে ঘরে ঘরে।
স্বৈরাচারকে হটিয়ে দিতে জীবন্ত পোস্টার
গণতন্ত্র মুক্তি পাবে স্বপ্ন ছিলো তার।
হারাধনের একটি ছেলে অগ্নিবীণা হাতে--
সবার আগে কুসুমবাগে দাঁড়িয়ে থাকে প্রাতে।
সবাই চেনে সবাই জানে সেই ছেলেটার নাম
প্রেম ও দ্রোহের প্রতীক কাজী নজরুল ইসলাম।
সে বিদ্রোহী উন্নত শির শত্রুকে নেয় চিনে
সে প্রেরণা একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনে--
লৌহ কপাট ভেঙে ফেলার সৌরভে গৌরবে।
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?...
আরেক ছেলে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজয়ী কবি
গান কবিতায় আঁকতে পারে বাংলা মায়ের ছবি।
রবির ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছে বাংলা সংস্কৃতি
আকাশ ভরা সূর্য তারার সংহতি সম্প্রীতি।
অভয় বাজে হৃদয় মাঝে গ্রীষ্ম বর্ষা শীতে
অবিনাশী মন্ত্র শোলক রবীন্দ্র সঙ্গীতে।
বদন খানি মলিন হলে নয়ন জলে ভাসি
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...
বাঙালি আর বাংলা মায়ের মেধাবী সন্তান
হারাধনের নয়টি ছেলের দীপ্তি অফুরান।
হারাধনের নয়টি ছেলেই হারিয়ে গেছে হায়
দেশ জননী জেগে থাকে ওদের প্রতীক্ষায়।
হারাধনের একটি ছেলেই কেবল বেঁচে রয়
যেই ছেলেটা উদ্যমী আর সাহসী নির্ভয়।
হারাধনের দশম ছেলের নামটি জানা নাই
তোমার মাঝেই সেই ছেলেকে আমরা খুঁজে পাই।
মা জননী বসে আছেন সোনার পিদিম জ্বেলে
তুমিই কি ভাই হারাধনের কাঙ্খিত সেই ছেলে?
-------------------
রচনাকাল/ ঢাকা ১৪ নভেম্বর ১৯৯২
পুনর্লিখন/ অটোয়া ০৮ অক্টোবর ২০২০
Comments
Post a Comment