নিলয় নন্দীর গল্প
মাটির রং লাল
দড়ি ধরে টানতে টানতে শামলীকে নিয়ে
উঠোনে ঢোকে কাশেম। প্যন্টের দড়িটা ওর কখন ছিঁড়ে গেছে, কোমড়ের কাছটা টেনে এনে বাঁধতে থাকে একসাথে। এই ফাঁকে শামলী
উঠোনের কোনে ফুলগাছে মুখ গুঁজে দিতে যায়। কাশেম দৌড়ে গিয়ে গলার দড়িটা হাতে তুলে
নিয়ে ফিরে আসে, ‘ও খালা, শামলীকে এই ধারে বেন্ধে দেব না গোয়ালে তুলে রাখব?’
‘গোয়ালেই তুলে
রাখ বাবা,’ শানুর আম্মা বারান্দা থেকে হাত নাড়ে।‘আবু ভাই পরে ধোঁয়া দিয়ে আসবে যা।’
গরুটাকে গোয়ালে বেঁধে রেখে কাশেম
ফিরে আসে। শানুর আম্মা আঁচলে বেঁধে রাখা পয়সাটা কাশেমের হাতে দিয়ে ভ্রু কুঁচকান, ‘বেশি মিষ্টি খেলে পেটে কী হয়, জানিস?’
কাশেম উঠোনের কোনে গিয়ে মাথা
চুলকায়,
হাত নেড়ে ডাকে শানুকে। শানু গিয়ে মাথায় দেয় এক চাপড়, ‘যা বাড়ি যা !’
‘শানু ভাই,’ কাশেমের গলার স্বর খাদে নেমে আসে, ‘মফিজ কাকার দোকেনে কী দেখেছি জানো?’
‘কী?’
‘পতাকা ! বাংলা দেশের পতাকা !’
ইদানীং গ্রামটাকে খুব নির্জন বলে
মনে হয় শানুর। ভর দুপুরে পুকুরঘাটে সেই হইচই নেই। বাঁশবাগানের বাতাসে শুধু ফিসফিস
শব্দ। ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোও ডাকবে কি ডাকবে না সেই ভাবনায় মগ্ন। আকাশে কি আগের মতো চিল
দেখা যায়?
ঘোষবাড়ির বাগানে কি আগের মতো অত জবা ফুল ফোটে? ঘরে ফেরার আগে ওই বাগানে একবার উঁকি দিয়ে শানু বুঝতে পারে
কেউ আগে থেকেই ফুলগুলো ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। বাইরে থেকে যেন বোঝা না যায় এটা হিন্দু না
মুসলমানের বাড়ি। শানু দেখে মাঠের ওপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ঘোষবাড়ির গরুটা। বোধহয়
অপেক্ষায় আছে কখন ও বাড়ি থেকে কেউ এসে গোয়ালে নিয়ে যাবে। এরাও কি বুঝতে পারে কোথাও
কিছু একটা হয়েছে ! নাকি কোথাও কিচ্ছু হয়নি, সবই মনের ভুল !
শোনা যায় ঢাকা শহরের অবস্থা ভাল
নয়। পুলিশ না মিলিটারি- কারা যেন অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে। শেখ সাহেবকেও ধরে নিয়ে
গেছে ওরা। কোথায় গেছে তাও ঠিক মতো বলা যাচ্ছে না। চারদিকের অবস্থা থমথমে। এই সময়
গ্রাম থেকেও একে একে লোকজন পালাতে শুরু করেছে। যে কোন দিন নাকি মিলিটারি নামবে
গ্রামে। পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলবে সবাইকে। এই সব ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না
শানুর। দোষ-ঘাট কিছু নেই এমনই এমনই মেরে ফেলবে তাই আবার হয়ে নাকি? কথাটা সে বেলী আপাকে জিজ্ঞেস করেছিল। বেলী আপা কিছু না বলে
শুধু একটু গম্ভীর হয়ে গেল। ইদানীং ওর ভাবভঙ্গীও খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না। কোথায়
যেন একটা তাল কেটে গেছে। গ্রামের কোন মেয়ে আর বাড়ির বাইরে বের হয় না।
আব্বা সেদিন বাজারে গিয়ে দাঁড়ি না কাটিয়েই ফিরে আসেন। ‘মদনের দোকান বন্ধ। সদাশিবও পালিয়েছে। এইভাবে এরা পালাতে
শুরু করলে তো মুশকিল।’
দাদী বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ‘ও ইসাক, ওরা সব যায় কই? এত ভয়ই বা পায় ক্যান?’
দাদীর কথায় কেউ কান দেয় না। আবু
চাচা কোদাল দিয়ে দেয়ালের শ্যাওলা পরিষ্কার করছিল, উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে, ‘কোন সমস্যা নাই। মেলেটারি কি আর এমনেই মানুষ মারবে? দেশের তো একটা ভালো-মন্দ আছে নাকি?’
আব্বা হাত তুলে একটা বড় ধমক দিতে
গিয়েও দেয় না, শুধু গজগজ করে বলে, ‘তুই নিজের কাজ কর আবু !’
আবু চাচা দেয়ালের শ্যাওলা চাঁছে
আর বিড়বিড় করে, ‘আমেদকে
তো কইছি এইবার দেশে আইলে একটা পাঞ্জাবী লয়া আইবি আমার লাইগা। কুর্তা-পাঞ্জাবী
এইগুলান গায়ে দিলে মেলেটারিরা আর কিছু কয় না।’ কথাটা শুনেই বেলী আপা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে ওঠে। আম্মা
বেলী আপাকে বকতে বকতে ঘরে ডেকে নিয়ে যান।
আব্বা কী বলবেন বুঝতে না পেরে গাল
চুলকাতে থাকেন। শেষে পকেট থেকে টাকা বের করে আবু চাচার দিকে বাড়িয়ে ধরেন, ‘যা তো, বাজারে গিয়ে দেখ
ক্ষুর আর ফিটকিরি পাওয়া যায় কিনা।’
আবু চাচা হাত ঝেড়ে পরিষ্কার করে
টাকাটা নিয়ে চলে যায়। দেয়ালের ওপাশের অর্জুন গাছটার ওপর একটা কাক এসে বসে।
ডাকাডাকির চেষ্টা করতেই আব্বা হঠাৎ কাকটার ওপর ক্ষেপে ওঠেন, ‘এই যা, যা-যা!’
শানু অবাক হয়ে এইসব দেখে। কোন
কিছুই আর আগের মতো নেই- সব বদলে গেছে।
চৌধুরী বাড়ির রং করা দেয়ালে কে
যেন পানের পিক ফেলে চলে গেছে। এই নিয়ে ওরা কোন শোরগোল করে নি। পাড়ার লাইব্রেরী
থেকে কতগুলো বই চুরি হয়ে গেল। কেউ কোন কথা বলে নি। হাশেম মোল্লার গাছ থেকে কারা
যেন দিনে দুপুরে ডাব পেড়ে খেয়ে গেল। হাশেম মোল্লা নিশ্চুপ। কোথাও নিশ্চয়ই কিছু
হয়েছে,
নয়তো হবে বলেই সবাই অপেক্ষা করছে।
এরই মধ্যে শোনা গেল অঞ্জলীরা আজ
চলে যাবে।
অঞ্জলী, অজয় কাকু আর মিনতি কাকীমা থাকেন সামনের বাড়িটায়। এই গ্রামেই
তাঁদের চার পুরুষের বাস। সেই কবে কোন কালে অজয় কাকুর পূর্ব পুরুষ এইখানে জমি কিনে
বাড়ি করতে শুরু করেন। অনেক পরে বাড়ি তৈরি শেষ হয়। অজয় কাকু টাউনে ফার্মেসি
দিয়েছেন। ওষুধের বেচা-বিক্রীতে লাভ ভালই। কী যে মনে হলো কে জানে, গনু মোল্লার কাছে ব্যবসা বিক্রী করে দিয়ে অজয় কাকু চলে
যাচ্ছেন। অঞ্জলীকে কোলে নিয়ে বৈঠকখানার ঘরে বসে আব্বা অনেক কিছু বোঝান
কাকুকে। কিন্তু উনি অনড়। প্রাণ বাঁচাতে
চাইলে এখানে আর থাকা চলবে না।
জন্ম থেকেই অঞ্জলী এ বাড়িতেই খেয়ে
পরে মানুষ হয়েছে। আড়াই বছর বয়সী মানুষ বলতে যা বোঝায় আর কি ! কত দিন শানু আর বেলী
আপা মুখোমুখি বসে অঞ্জলীকে হাঁটতে শিখিয়েছে। এই কোল থেকে দু পা হেঁটে ওই কোলে
ঝাঁপ। আবার ওই কোল থেকে এই কোলে। সন্ধ্যেবেলায় কোলে করে ওকে চাঁদ দেখাতে নিয়ে গেছে
শানু। হাতের মুঠো খোলে আর বন্ধ করে অঞ্জলী, আ-য়া-য়া-য়া-তিত !’ শেষ শব্দটায় নিজের কপালে আক্সগুল।
ওড়না দিয়ে নাকের পানি মুছতে মুছতে
বেলী আপা ওর ছোট বেলার চুড়িগুলো অঞ্জলীকে পরিয়ে দিতে থাকে। ‘অনু, তুই ভুলে যাবি
আমাদের?’
‘ভুলে যাব।’ কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ে অঞ্জলী। আম্মা এসে দরজায় দাঁড়িয়ে
শূন্য চোখে ওদেরকে দেখতে থাকেন। দাদীর ঘর থেকে অজয় কাকা আর কাকীমা দাদীকে প্রণাম
করে বেরিয়ে যান। শানু দেখে দাদী বিছানায় বসে তসবিহ টিপছেন আর হা-হুতাশ করছেন-‘হায় রে দুনিয়া ! এ কোন দুনিয়া !’
অঞ্জলীকে কোলে নিয়ে রিকশায় বসে
আছেন আব্বা। দেখে মনে হয় তাঁর কোল থেকে অঞ্জলীকে কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারবে না।
ক্ষুর কিনে এনে নিজেই দাঁড়ি কামাতে গিয়ে আব্বা গাল কেটে ফেলেছেন। এখন আর দাঁড়ি
কামান না। গালে দশ দিনের জমানো দাঁড়িসহ রিকশায় বসে থাকা আব্বাকে দেখতে লাগছিল
পাগলের মতো।
তিনটা রিকশা নিয়ে ওরা টাউনে চলে
যায়।
‘এত ভয় পাইলে হয়?’ রিকশা চলে যাওয়ার পরে আবু চাচা হাতের নিড়ানীটা ছুঁড়ে ফেলে
দেয় উঠোনের কোনে। ‘আরে, মেলেটারির কি খাইয়া দাইয়া আর কাম কাইজ নাই রে বাপ? তোদের মারবে ক্যা? দেশের লাইগা আর মানুষ আছে না?’
আবু চাচার কথা কারো কানে যায় না।
সবাই যে যার মতো ঘরে চলে যায়। আবু চাচা
নিজের টিনের সুটকেস খুলে একটা ছেঁড়া পাঞ্জাবী বের করে সেলাই করতে বসে। শানুকে দেখে
বলে,
‘তইয়ার থাকন ভাল। কখন কামে লাইগা যায় কওন যায়?’
তারপর একদিন সন্ধ্যায় বিজন
মাস্টার আব্বার সাথে দেখা করতে আসে। দু জনে বৈঠকখানার ঘরে বসে কি সব কথা বলে শানু
জানে না। একটু পরে আবু চাচাকেও আব্বা ডেকে নিয়ে যান ওই ঘরে। শানু পর্দার ফাঁক দিয়ে
দেখে চাচা মেঝেতে বসে কুঁই কুঁই শব্দ করে কাঁদছে। বিজন মাস্টার হাত ধরে টেনেও
তুলতে পারছে না। এটা আবার কী ব্যাপার?
আম্মা রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে
ঘরে ঢুকে বলে, ‘কী হয়েছে? এই বলো আমাকে কী হয়েছে?’
আব্বা মাথা নিচু করে বসে থাকে।
বিজন মাস্টার গলা খাঁকড়ে বলে, ‘ঢাকায় আমেদকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে।’
আম্মা প্রথমে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকেন
। তারপর হাত ধরে আবু চাচাকে টেনে তুলতে গিয়েও পারেন না। শেষে আব্বাকে ডাকেন, ‘তুমি একটু ধরো না!’ জানালা দিয়ে আসা দমকা বাতাসে আব্বার পাগুলে চুল-দাঁড়ি উড়তে
থাকে। তিনি কোন সাড়া শব্দ করেন না।
তিন দিন পর ভোর বেলা শানু ঘুম
থেকে উঠে শোনে আবু চাচা নেই। বগলে তার ছোট্ট বিছানা আর টিনের সুটকেস নিয়ে কোথায় যে
চলে গেছে কেউ জানে না। শুধু শোনা যায় খুব ভোরে মধু গাছীর সাথে আবু চাচার দেখা
হয়েছিল। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে আবু চাচার উত্তর, ‘টেরনিং নিতে যাই রে ভাই। মেলেটারি মারমু।’
Comments
Post a Comment