মাহবুব আজাদের গল্প
দেশপ্রেম কাকে বলে?
ব্যাপারটা এমন নয় যে ‘দেশপ্রেম’ শব্দটা ইমা প্রায়ই শুনতে পায়। টিভিতে সে ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেছে, দূর আফ্রিকার সরু সরু নদীর ঘোলাটে পানি ফুঁড়ে হঠাৎ ভুস করে মস্ত কুমির মাথাচাঁড়া দেয়; পড়ার বইতে এখানে-ওখানে তেমনই ঢঙে ‘দেশপ্রেম’ শব্দটা হঠাৎ সামনে চলে আসে।
ইমা স্কুলে বাংলা ম্যাডামকে সরল মনে শুধিয়েছিলো, “ম্যাডাম, দেশপ্রেম কী?” ম্যাডাম আসনে আরেকটু ঠেস দিয়ে বসে চোখ বুঁজে হাত নেড়ে খনখনে গলায় শুধু বলেছেন, “দেশের প্রতি প্রেম দেশপ্রেম। এখন তোমরা পড়ার বইয়ের একান্ন ক্রমিকের পাতা খোলো। প্রথম প্যারাটা মন দিয়ে তিনবার পড়ো। …য়্যাই পেছনের বেঞ্চের লম্বু মেয়ে, খিখি করে হাসছো কেন? দাঁড়াও বেঞ্চের ওপর!”
প্রেম জিনিসটা ইমা এখনও পুরোপুরি না বুঝলেও টিভির দাপটে এটুকু বোঝে, প্রেমের জন্যে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের দরকার পড়ে। সিনেমায় প্রেম হলে অনেক নাচ হয়, গান হয়, ছেলেটা আর মেয়েটার বাবা-মা রাগারাগি করেন শুরুতে, পরে সব মিটমাট হয়ে যায়। কিন্তু দেশের প্রতি প্রেমটা তাহলে কীভাবে হবে?
মায়ের কাছে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার নানা হ্যাপা। ইমার মা অল্পতেই অস্থির হয়ে পড়েন, হাঁ-হাঁ করে তেড়ে আসেন, বাড়ির বাকিদেরও তটস্থ করে তোলেন যখন-তখন। ইমা একদিন ছাদের টবে পানি দিয়ে ফেরার পথে দুটো বাঁদরছানার দুষ্টুমি দেখে মজা পেয়ে আনমনে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকেছিলো, তার মা কোত্থেকে ছুটে এসে, “ছাদে গিয়ে কার সাথে এতো হাসাহাসি?” বলে জেরার পর জেরা করে ইমার মনে এমন ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে বেচারি মায়ের কাছে মন খুলে কথা বলতেই এখন আর ভরসা পায় না।
দেশপ্রেম কী, সে কথা দিদুকে শুধাতে যাওয়া হবে বিরাট বোকামি। দিদুর সব জবাবই শুরু হয় পাকিস্তান আমল থেকে, তারপর শেখ সাহেবের আমল, মিলিটারির আমল হয়ে আরও একগাদা আমলে ঢুকে বিচিত্র সব গল্পের কাদামাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে মাঝপথে হারিয়ে যায়। বেড়াল ন্যাপথলিন খায় কি না, সে প্রশ্ন দিদুকে একবার শুধিয়ে ইমার শিক্ষা হয়ে গেছে; পাকিস্তান আমলে ন্যাপথলিনের দাম, শেখ সাহেবের আমলে বেড়ালের খোরাক আর মিলিটারির আমলে তুলার ধুনুরিদের আস্পদ্ধা নিয়ে ঘণ্টাখানেক বকে বকে দিদু ইমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছেন।
বাকি থাকে বাবা। কিন্তু বাবাকে ইমা পায়ই বা কতক্ষণের জন্যে? দিনভর রোগী দেখে ঘরে ফিরেও বাবার স্বস্তি নেই, মহল্লার আধবুড়ো লোকজন হয় বাড়িতে এসে বাবার সন্ধ্যাটা ইমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়, নয়তো বাবা নিজেই হুড়োহুড়ি করে একটু ভাত খেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আবার কী সব সভা-সমিতির কাজে বেরিয়ে যান। মাঝে মাঝে দু’চারটা ছুটির দিনে হয়তো ইমা কাছে পায় বাবাকে, কিন্তু তখন আবার বাবা একমনে কাগজ পড়েন আর কিছু শুধালে “হুঁ?” “হুঁ?” বলে আনমনা শব্দ করেন শুধু।
‘দেশপ্রেম’ ব্যাপারটা আসলে কী, সে প্রশ্নের সদুত্তর কারো কাছে না পেয়ে হয়তো ইমা ভুলেই যেতো, কিন্তু বাংলা ম্যাডামের দায়সারা উত্তর পাওয়ার পর হপ্তাখানেক পার না হতেই একদিন সন্ধ্যায় বৈঠকখানা থেকে বাবার চড়া গলা শুনে ইমা ঐকিক নিয়মের অঙ্ক কষা থামিয়ে কান খাড়া করলো। মা অবশ্য বারবার বলেন, বড়দের কথা কান পেতে শুনতে নেই; কিন্তু বড়রা যখন হাঁকডাক করেন, তখন ছোটদের করারই বা কী থাকে?
‘আজিজ ভাই, আপনি কথাটা গোড়াতে বোঝেননি বলে বোকার মতো স্যামুয়েল জনসনকে টানছেন!’ বাবা চটে গেলে তার গলাটা চড়ে যায়, জানে ইমা। ‘দেশপ্রেম নিয়ে উনি কথাটা বলেননি, বলেছেন দেশপ্রেমিক সাজা বাটপারদের নিয়ে।’
ইমা উৎসুক হয়ে ওঠে ‘দেশপ্রেম’ কথাটা শুনে। জনসন নামের একটা লোক দেশপ্রেম নিয়ে কিছু একটা বলেছে, এটুকু বোঝা যাচ্ছে। বাবার মেহমান আজিজ ভাই আরও কিছুক্ষণ ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কঠিন কঠিন তর্ক করে শেষে হাসতে হাসতে বলেন, ‘না না ডাক্তার, আপনার কথাই ঠিক। আজ উঠি তবে।’
মেহমান চলে যেতেই ইমা এক ছুটে বাবার কাছে গিয়ে হাজির হয়। বাবা ভুরু কুঁচকে জুড়িয়ে আসা চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন, মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে থাকার চিহ্ন ওটা। যদিও ইমাকে বাবা বকাঝকা করেন না কখনও, কিন্তু এরকম সময়ে নাকি বাবাকে জ্বালাতন করতে নেই, মা পইপই করে শিখিয়েছেন ইমাকে।
কিন্তু আজ ইমা আর কোনোকিছুর পরোয়া না করে বাবার পাশে সোফায় বসে সোজা কাজের কথায় চলে গেলো, ‘বাবা, বাবা, বাবা!’
ইমার বাবা আনমনা হয়ে বললেন, ‘হুঁ?’
ইমা বাবার কনুই ধরে ঝাঁকিয়ে বললো, ‘আমার কথা শোনো!’
বাবা এবার চমকে উঠে বললেন, ‘কে? কী? ওহ, আম্মু তুমি? পড়ালেখা করছো না যে?’
ইমা এবার শুধালো, ‘বাবা, দেশপ্রেম কী? দেশের সাথে কীভাবে প্রেম করে?’
ইমার বাবা একটু চমকে ওঠেন এ প্রশ্নে। কিছুক্ষণ চুপ করে চায়ের কাপের দিকে চেয়ে থেকে তিনি বললেন, ‘ইমা, তুমি তো তোমার আম্মুকে অনেক ভালোবাসো? আর দিদুকে? আমাকে? সালেহার মাকে?’
ইমা মাথা ঝাঁকায়। বাবা বলে চলেন, ‘আমাদের যদি অসুখ হয়, তাহলে তোমার মন খারাপ হবে না?’
ইমা জানে, তার ভীষণ মন খারাপ হবে। কিছুদিন আগেই দিদুর হঠাৎ কী ভীষণ শ্বাসকষ্ট হলো, বাড়ির সবাই তখন অনেক ভয় পেয়েছিলো। সালেহার মা ইমাকে কোলে নিয়ে দিদুর খাটের পাশে মাদুর পেতে বসে দুলে দুলে দোয়া পড়ে ইমাকে বলেছিলো, ‘আল্লারে ডাকো সোনামণি, ডাইকা বলো উনি য্যান চাচিরে ভালা কইরা দ্যায়।’ ইমার ডাক আল্লাহ তখন শুনেছেন, দিদু আবার ভালো হয়ে গেছেন। কিন্তু ইমা দিদুর কষ্ট দেখে অনেক কেঁদেছে তখন।
বাবা তবু পাল্টা প্রশ্ন করে চলেন, ‘তোমার স্কুলের বন্ধুরা, স্কুলের স্যার আর ম্যাডামরা, আমাদের ওপরতলার রিঙ্কি-পিঙ্কিরা… ওদের যদি অসুখ হয়, তোমার দুঃখ হবে না?’
ইমা মাথা ঝাঁকায়। বাবা বলেন, ‘ঐ যে চটপটিওয়ালা শরাফত আমাদের গলিতে চটপটি বিক্রি করতে আসে সন্ধ্যায়, তুমি কি চাও না ও ভালো থাকুক?’
ইমা শরাফত চাচাকে খুবই ভালোবাসে। সালেহার মায়ের সাথে সে মাঝে মাঝে চটপটি কিনতে বেরোয়, শরাফত চাচা ফোকলা হেসে দুটো বাড়তি ফুচকা বেশি টক ঢেলে বানিয়ে ইমাকে ছোট্ট একটা কাচের বাটিতে করে খেতে দিয়ে বলে, ‘এইডা আমার ছোট্টো আম্মার জন্যি ইশপিশাল!’ শরাফত চাচাকে তো ভালো থাকতেই হবে।
বাবা ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘এই যে আমরা, তোমার বন্ধুরা, তোমার পড়শীরা… এরাই তো তোমার দেশ। ওদের অসুখ হলে এই যে তোমার মন খারাপ হয়, তুমি যে ওদের ভালো চাও, এটাই দেশপ্রেম।’
ইমা কথাটা শুনে একটু ধন্ধে পড়ে যায়। কোনো নাচগান তো নেই দেশপ্রেমে, একটা ছেলে আর একটা মেয়েরও কোনো ব্যাপার নেই, তাহলে এটা প্রেম হয় কী করে?
ইমার বাবা থামেন না। ‘আম্মু, তুমি যত বড় হবে, তোমার দেশও পাল্লা দিয়ে তোমার সাথে বড় হবে। বড় হয়ে তুমি আমার মতো ডাক্তার যদি হও, দেখবে লক্ষ লক্ষ লোক নিয়ে তোমার দেশ। যদি তোমার মেজো মামার মতো এনজিনিয়ার হও, দেখবে লক্ষ লক্ষ লোক তোমার দেশে। যদি শিক্ষক হও, উকিল হও, পুলিশ হও, মিলিটারি হও, দেখবে দেশ মানেই লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেশপ্রেম মানে তখন আর শুধু মা-বাবা-দিদু-সালেহারমায়ের ভালো চাওয়া না, শুধু ওপরতলার রিঙ্কি-পিঙ্কিদের নিয়ে নিজেরা ভালো থাকা না, একা শুধু শরাফতের অসুখে মন খারাপ করা না। বড় হয়ে দেশপ্রেম মানে লক্ষ লক্ষ লোকের ভালো চাওয়া, তাদের অসুখে মন খারাপ করা।’ ইমাকে কাছে টেনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন বাবা। ‘তুমি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছো?’
ইমা একটু একটু বোঝে, বাবা কী বলছেন। বাবাও তো চান, আশেপাশে সবাই ভালো থাকুক। সেজন্যেই হয়তো সারাদিন কাজ করেন, বাড়ি ফিরেও অন্য লোককে সময় দেন। বাবাই তো দেশপ্রেম করছে তাহলে?
ইমার মাথায় একটা চুমু খেয়ে তাকে ছেড়ে দেন বাবা, ‘একা একা বেশিদিন ভালো থাকা যায় না, আম্মু। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টাই দেশপ্রেম। এখন যাও দেখি, তোমার ইংরেজি খাতাটা নিয়ে এসো, কিছু ট্র্যান্সলেশন করি তুমি-আমি মিলে।’
[পতাকার ছবি: আলোকিত রাঙ্গামাটি]
Comments
Post a Comment