সাদিয়া সুলতানার গল্প
ইচ্ছে বেলুন
যদিও মা খুব জোরে চড় দেয়নি। ফায়জা তাতে ব্যথাও পায়নি। তবু ফায়জার বুক ব্যথা করছে। বুঝতে পারছে ফায়জা ব্যথাটা পিঠে নয় বুকের ভেতরে লেগেছে। ঘটনাটা ঘটার পর থেকেই ফায়জার মা বালিশে মুখ গুঁজে আছে। কোথায় চড় খেয়ে ফায়জার কাঁদবার কথা তা না, মা’ই জোরে জোরে কাঁদছে।
রাইসা চুপচাপ খাটে বসে টিভি দেখছে। যেন কিছু হয়নি। রাইসা ফায়জার তিন বছরের বড় কিন্তু রাইসার কর্মকা- দেখলে মনে হয় ও ত্রিশ বছরের বড়। বড় আপি হলে যে বড় ভাব করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কাজও করতে হয় তা রাইসা বোঝে না। এই যে মা যখন ফায়জাকে মারল তখন তো রাইসা এগিয়েই এলো না। উল্টো মিটিমিটি হাসল! যেন বেশ হয়েছে, মার খেয়েছে! আর ঠিক তখন শিলার মা এগিয়ে এসে ফায়জাকে কোলে তুলে না নিয়ে গেলে ফায়জার কান্না আর ঠেকানোই যেত না।
শিলার মা ফায়জাদের বাসায় কাজ করে। শিলা ফায়জার সমান, তাই শিলার মা ফায়জাকে খুব আদর করে। কিন্তু শিলার মার কোনো নাম নেই। শিলার মার নাম ‘শিলার মা’। ফায়জার অবাক লাগে, কারো নাম শিলার মা হয় নাকি! মাও ডাকে শিলার মা, বাবাও। রাইসা, ফায়জাও। প্রথম দিন যেদিন শিলার মা ওদের বাসায় কাজ করতে এল ফায়জা শিলার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমার নাম কী? শিলার মা খুব হেসেছিল আর বলেছিল, আমার নাম শিলার মা। শিলার মা কখনই নাম বলেনি।
ফায়জার এখন অনেক কষ্টের কথা মনে পড়ছে। একবার কষ্ট শুরু হলে আর থামতেই চায় না। এই যেমন ফায়জা বুঝতে পেরেছে রাইসা এবারের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ঠিকই প্রথম হবে আর ফায়জার কপালে বরাদ্দ হবে বকুনি।
ফায়জার মায়ের নাম সোনালী। যেমন নাম তেমনই সোনার মত সুন্দর মা ফায়জার। মাকে জ্বালালে মা রাগ হয় ঠিকই কিন্তু মারে না। দু’দিন আগেই ফায়জা ডায়নিং টেবিলে রাখা পানির ফ্লাক্সটা ভেঙে ফেলল তা দেখেও মা কিছু বলেনি। বকেওনি। আবার বাংলা পরীক্ষার দিন গোটা পেন্সিল বক্সটাই ও যে স্কুলে ফেলে এলো তার জন্য বকুনি খেল বাবা। এরকম আরও কত শত যে কা- আছে যা দেখে মা কিছুই বলে না পর্যন্ত। শুধু আজ মা কেন রাগ হল ফায়জা ধরতে পারছে না।
শিলার মা ফায়জাকে কোলে নিয়ে ঘুরছে আর বকবক করছে।
‘আপুনি, স্কুলের জামাখান খুইলা দেই?’
‘না...।’
‘মায়ের উপর রাগ করছো আপুনি?’
‘হুমম।’
‘আরে দুর, বোকা মানুষ নাকি তুমি! মায়ের উপর রাগ নাই। তোমার পরীক্ষা শেষ দেইখা মা কত্ত নাস্তা বানায় রাখছে। আসো খাওয়াই দেই।’
‘নাহ, খাব না।’
ফায়জা এইবার কেঁদেই ফেলবে। কিন্তু কাঁদলে রাইসা আপি ঠিক কোথা থেকে উড়ে এসে ওকে ক্ষেপাবে। বলবে, ফ্যাঁচকাঁদুনে। ছয় বছরের ফায়জার বুকের ভেতরটা অভিমানের তীব্রতায় ভারি হয়ে যায় তবু ও কান্না আটকে রাখে। ফায়জা মায়ের উপরে খুবই রাগ করেছে। মারার কারণটা মায়ের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়তো কিন্তু ফায়জার জন্য না।
ফায়জার আজ অংকন আর হস্তলিপি পরীক্ষা ছিল। মোমবাতি, বেলুন আর জাতীয় পতাকা অংকন এসেছে। ফায়জা বেলুন আঁকেনি। পরীক্ষার হলে ওর বেলুন আঁকতেই ইচ্ছে করল না। ফায়জা জানে, বেলুন আঁকতে হয় বার্থডে কার্ড এ। গতকাল টিভিতে যে দেখল ওর মতো একটা মেয়ে মোমবাতি নিয়ে জাতীয় পতাকার সামনে কী সুন্দর করে গাইছে, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে...।’ গানটা একটু কঠিন লেগেছে কিন্তু প্রথম লাইন দু’টো কী যে ভাল লেগেছে ফায়জার! মুখস্থই হয়ে গেছে। সেই সব ভাবতে ভাবতে আজ পরীক্ষার খাতায় ও বেলুনের বদলে দুইটা জাতীয় পতাকা আঁকল। এটাই কি ফায়জার দোষ?
ফায়জার প্রাণের বন্ধু প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তী আর ফায়জা একই বেঞ্চে বসে। প্রিয়ন্তীই ওকে বলেছে, তোর পতাকাটা বেস্ট হয় রে! সবদিক ভেবেচিন্তে তাইতো ও দুইটা পতাকা আঁকল! আর মা বলল, ও নাকি পাঁচ নাম্বার ছেড়ে এসেছে। পাঁচ নাম্বার ছেড়ে আসার মানে ফায়জার মাথায় ঢোকে না। ফায়জা জানে ওর পতাকা সবচেয়ে সুন্দর হয়। ক্লাস থেকে বের হয়ে বাবাকে ও যখন বলল, ও দুইটা পতাকা এঁকেছে বাবা তো হেসেই খুন। ফায়জাকে বলল বেশ করেছিস। বাবা ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেছে। বাবা বাসায় থাকলে ব্যাপারটা হতই না।
‘রাগ কইরো না। মা তোমারে মাইরা নিজেই কেমুন কষ্ট পাইতাছে দেখছো? মা মেলাক্ষণ কানতেছে। যাও মায়ের গলা জড়ায় ধরো। দেখবা মায়ের রাগ গইলা পানি।’
ফায়জা শিলার মায়ের ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। কান্না দুই চোখের আড়াল ভেদ করে বাইরে চলে আসে এবার। যাবেই না ফায়জা। আর বেলুনও আঁকবে না। কাল রাতে ভেবেছিল মামণির বার্থ ডে’তে বেলুন কার্ড বানাবে। প্রিয়ন্তী ফায়জাকে বেলুন কার্ড বানানো শিখিয়েছে। নাহ্ কিছুই বানাবে না।
শিলার মা ফায়জাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। ফায়জা বারান্দায় ঝোলানো বেতের দোলনাতে যেয়ে বসে। আস্তে আস্তে দোল করতে করতে ওর ঘুম ঘুম পায়। এটা ওর খুব প্রিয় জায়গা। রাইসা আগে এই দোলনা নিয়ে ঝগড়া বাধাঁতো কিন্তু এখন দুই বোনের দোলনা সংক্রান্ত খুনসুটি কমে এসেছে রাইসার গান শেখার কল্যাণে। কিন্তু ফায়জা মাকে বলেছে, ও গান শিখবে না। ও শিখবে অংকন। ছবি আঁকতে ফায়জা খুব পছন্দ করে। ও গানও পছন্দ করে। তবে গান গাইবার চেয়ে শুনতে বেশি ভাল লাগে ওর।
মা এসে কখন পাশে দাঁড়িয়েছে ফায়জা দেখেনি। কাছে এসে ফায়জাকে কোলে তুলে নেয় মা। ওকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বলে, ‘সরি মামণি। আমার ভুল হয়েছে। তোর যা ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে তুই তা-ই আঁকবি।’ মায়ের বুকের ওমে ফায়জার মন উষ্ণ হতে থাকে আর সেই সঙ্গে ওর ইচ্ছে বেলুন বারান্দার গ্রিল ফাঁকি দিয়ে উড়ে যায় আকাশ পানে।
Comments
Post a Comment