মারজানা সাবিহা শুচির গল্প

পতাকার পিছনের কান্নাগুলো



“বাবুই বাবুই তাড়াতাড়ি আয়, দাদু খাচ্ছেন!

বাবুই তার পুতুলগুলো সাজাচ্ছিলো, পাপাইয়ের চাপা গলার ডাক শুনে সব ফেলে ছুট লাগলো। দুই ভাইবোন একদৌড়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে ভাল মানুষের মতো মুখ করে বসলো, একটা চেয়ারেই দুইজন গাদাগাদি করে। একসাথে বসলে নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি আর হাসাহাসি করতে সুবিধা হয় যে!

বসির দাদু খাচ্ছেন। বাবুই পাপাইকে মা আগেই খাইয়ে দেন। অন্যদিন হলে ওরা এতোক্ষণে বিছানায় উঠে বালিশ নিয়ে মারামারিটা শুরু করে দিতো। আজ দাদুর খাওয়া দেখবে বলে অপেক্ষায় ছিলো।

শুধু কি আজ, ওরা দুইদিন ধরে প্রতি বেলায়ই দাদুর খেতে বসার অপেক্ষায় থাকছে। দুদিন আগে ওদের বাবার এই মামাটি বেড়াতে এসেছেন, আর যেই না উনি খেতে বসলেন ওরা তো অবাক! এমনিতে কত শান্ত-শিষ্ট, খেতে বসলেই কেমন যে হয়ে যান! এক হাতে থালাটা আগলে রাখেন আর এক হাতে গাপুস গুপুস করে খেতে থাকেন। যেন খুব তাড়া আছে, এক্ষুনি খেয়ে শেষ না করলে যেন আর খাওয়াই হবেনা। আর চারপাশে কেমন ভয়-ভয় রাগ-রাগ চোখে তাকাতে থাকেন! দাদু অত বুড়ো নন কিন্তু খাওয়ার সময় মুখটা কেমন বুড়োটেও লাগে।

বাবুই কনুইয়ের একটা গুঁতো দিলো পাপাইকে, ফিসফিস করে বললো, “দাদুর থালায় হাত দে তো ভাইয়া, কী করেন দেখি?” পাপাই আরো বেশি গলা নামিয়ে বলে, “একদম খুন করে ফেলবে! হিহি!”

মা একটু উসখুস করছেন। ওনাদের এই মেহমানটি খেতে বসলেই দুই বিচ্ছু সামনে এসে বসবেই বসবে। কারণটিও জানেন। গতরাতেই পাপাই জিজ্ঞেস করেছে, মা দাদু কি খুব গরীব? খেতে পাননা? মা যখন বললেন যে- মোটেও না, উনি হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন, মোটেও গরীব নন। তখন বাবুই বলেছে, তাহলে কি খুব পেটুক? কেমন রাক্ষসের মতো গপগপ খান!

মা তক্ষুনি ধমক দিয়েছিলেন এভাবে বলার জন্যে। আর মানাও করেছিলেন খাওয়ার সময় হাঁ করে যেন তাকিয়ে না থাকে, কিন্তু ওরা যে না এসে পারেইনা!

থালায় আরো ভাত তরকারি তুলে দিতে দিতে মা বলেন ওদেরকে, “যাও যাও তোমরা শুয়ে পড়ো।”

ওরা একটু নড়ে চড়ে অমনি গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলো, খাওয়া শেষ না হলে যাবেই না! এমন আজব খাওয়া তারা কোনোদিন দেখেনি। দাদু তখন থালায় নতুন দেওয়া ভাত তরকারি হুড়মুড় করে টেনে নিচ্ছেন নিজের দিকে। দুই পিচ্চির দিকে একটু হাসি হাসি মুখে তাকালেন, যদিও ওদের কাছে হাসিটা কেমন কান্না কান্না মনে হলো।

খাওয়ার পাট চুকে যেতেই দুই ভাই বোন বিছানায় উঠে আলোচনায় বসে। কী হতে পারে এমন হুপহাপ খাওয়ার কারণ? দাদুর সাথে কি ভূত থাকে, তাড়া দেয় খাওয়ার জন্য? উনি কি পাগল? নাকি আসলেই উনি গরীব হয়ে গেছেন, মা জানেননা!

অনেক ভেবে শেষে দুইজন ঠিক করলো কাল তারা দাদুকেই জিজ্ঞেস করবে, যা থাকে কপালে। সকালটা যেন তাড়াতাড়ি আসে তাই ওরা তখন তখনই ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঠিকই পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে দাঁত ব্রাশ সেরে সুরসুর করে গিয়ে ঢোকে দাদুর ঘরটায়। মা বাবা দুজনেই কাজে চলে গিয়েছেন। রান্নার খালা ব্যস্ত রান্নাঘরে। এই তো সুযোগ!

কে জিজ্ঞেস করবে এই নিয়ে দুজনে ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতি চলে খানিকক্ষণ। দাদু বিছানায় হেলান দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন মন দিয়ে। একটু পরেই ওদের দাঁড়িয়ে থাকা টের পেয়ে মুখ তুলে হাসেন , “কী দাদুভাইরা, আজ স্কুল নেই বুঝি?”

“না, আজ ছুটি”- বলতে বলতে দুই জন খাটে উঠে বসে।

“আচ্ছা!” দাদু পত্রিকাটা পাশে সরিয়ে রাখেন, “তারপর পাপাই, অংক তোমার কেমন লাগে?”

এই রে! দাদু কিনা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, পড়ালেখার আলাপ ওনার মনে হয় খুব প্রিয়। আসল কথাই না ভেস্তে যায়। বাবুই একটা চিমটি দেয় পাপাই-এর হাতে আর পাপাইও অমনি হড়বড় করে বলে, “দাদু একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হ্যাঁ বলো?”

“দাদু আপনি ওরকম গপগপ করে খান কেন? কেউ তো আপনার থালা কেড়ে নিচ্ছে না!”

ইশশ, পাপাই ভেবে রেখেছিলো সুন্দর করে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু গপগপ শব্দটাই যে দুম করে মনে এলো! ভয়ে ভয়ে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা, উনি কি রাগ করলেন? এখন কি ওদের বকা দেবেন?

না, রাগ করেন নি বোধহয়! উনি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, তারপরেই মনে হয় যেন লজ্জা পেয়ে গেলেন। তবুও বাবুই ভয় পায়, বলে, “থাক দাদু বলতে হবেনা। আমরা যাচ্ছি...” বলেই সে পাপাই-এর হাত ধরে টানে।

কিন্তু দাদু হাত তুলে থামান ওদের। বলেন, “তোমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা জানো?”

ওরা একটু অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকায় আর মাথা নেড়ে বোঝায় যে তারা জানে।

এবার একটু হাসিমুখে বললেন দাদু, “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি এই তোমার বয়েসীই ছিলাম পাপাই, কিংবা একটু বড়। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি।”

গপগপ করে খাওয়ার সাথে যুদ্ধের কী সম্পর্ক কিছুই বুঝতে পারে না ওরা। চুপ করে শুনতে থাকে দাদুর কথা, “আমরা তখন শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছি গ্রামে, নানাবাড়িতে। শহরে তখন পাকসেনারা রোজ কত মানুষ মারতো। আমি নিজেই রাস্তায় দেখেছি গুলি খেয়ে মরে আছে কতজন। আরো অনেক মানুষ পালিয়ে গিয়েছিলো সেখানে, তাই গ্রামে তখন খাবারের খুব অভাব। এর মধ্যে বৃষ্টিতে ধানও গেলো ডুবে। টাকা দিয়েও খাবার পাওয়া যায়না। বুঝেছো?”

টাকা দিলেও কেন খাবার পাওয়া যাবে না সেটা ওরা ঠিক বোঝেনা, তারপরেও মাথা নাড়ে।

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো ঠিকমতো খেতে না পেয়ে।” দাদু বলতে থাকেন, “ কচু সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, শাক, ডাঁটা বেশিরভাগ দিন এইসবই জুটতো। পেটও ভরতো না, মনও ভরতো না। আমি শুধু ভাতের জন্যে কাঁদতাম। ”

হাঁ হয়ে শুনছে ওরা, যুদ্ধের সময় খেতে না পেয়ে দাদু এমন পেটুক হয়ে গিয়েছেন?

“আর ছিল মিলিটারির ভয়, রাজাকারের ভয়। প্রায়ই শোনা যেত, পাক সেনারা এসেছে গ্রামে। আমরা তখন পালাতাম। নানাবাড়ির একটু দূরেই ছিল একটা হাঁটুপানির জলা, সেটা পেরোলেই জঙ্গল। মিলিটারি আসছে শুনলেই আমরা দৌড়ে জঙ্গলে গিয়ে লুকাতাম। পরে হয়তো দেখা যেতো হানাদাররা আসলে দূরে অন্য কোথাও এসেছে। ”

ওদের দিকে তাকিয়েই কথা বলছেন দাদু, তবু মনে হচ্ছে উনি এখানে নেই, উনি যেন সেই অনেক আগের যুদ্ধের সময়টায় চলে গিয়েছেন।

“একবার জানো, চার পাঁচ দিন ধরে ভাত না খেয়ে ছিলাম। সেদিন সন্ধ্যার আগে আমার বোন ছুটে এসে বললো, “ভাইয়া, ভাত রান্না করছে রে! মামা কোত্থেকে চাল নিয়ে এসেছে!” শুনেই আমিও তক্ষুণি গিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে থাকলাম, আমাকে না দিয়ে যেন অন্যেরা খেয়ে না ফেলে!

ঠিক সন্ধ্যায়, আবছা আলো আছে তখনো, ছোটদেরকে ভাত বেড়ে দিলেন মা -মামীরা। গরম ভাত, আর বুটের ডালে ডোবানো ডিম ভাজা! মনে হলো, দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল খাবারটা আমার সামনে!” দাদু এমনভাবে তাকিয়ে আছেন, যেন সেই খাবারের থালাটা দেখতে পাচ্ছেন এখনো। উনি একটু থামতেই পাপাই বাবুই একসাথে বলে ওঠে, “তারপর?”

“কেবল প্রথম গ্রাসটা মুখে পুরেছি, আহ্ যেন অমৃত মুখে দিলাম...অমনি দূরে চিৎকার শোনা গেলো, মিলিটারি আসছে মিলিটারি আসছে!”

“মিলিটারি!” দুই ভাইবোন চমকে ওঠে।

“হ্যাঁ, আর এবার যে সেটা গুজব না তাও বোঝা গেলো। ঠা ঠা গুলির আওয়াজ শোনা গেলো উত্তর পাড়ার দিকে, বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দেখা গেলো দাউদাউ আগুন জ্বলছে ওই পাশের বাড়িঘরগুলোয়। অনেক মানুষের বাঁচাও বাঁচাও পালাও পালাও চিৎকার শুনতে পেলাম।”

ওদেরকে গল্প শোনাতে শোনাতে আধশোয়া দাদু কখন সোজা হয়ে উঠে বসেছেন। পাপাই বাবুই একজন আরেকজনের হাত চেপে ধরেছে, কেমন ভয় লাগছে ওদের!

“পালা, জঙ্গলে পালা - বলে আমাদের হাত ধরে টেনে তুলতে লাগলো বড়রা। আমি কিন্তু ভাতের থালা আঁকড়ে শক্ত হয়ে বসে থাকলাম। চিৎকার করে কত মানুষ ছুটছে, আল্লাহকে ডাকছে ভগবানকে ডাকছে কাঁদতে কাঁদতে, আর আমি চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম, আমি যাবোনা! আমি ভাত খাবো! কে যেন আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি কিন্তু থালা ছাড়িনি। এক হাতে থালাটা বুকে চেপে ধরেই দৌড়াচ্ছি। ডাল পড়ে জামা ভিজে যাচ্ছে টের পেয়েছি। ভাবছি যাক ডাল যাক, শুধু ভাতই খাবো!”

“তারপর?” বাবুই প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে।

“একটু এগোতেই দেখি কে একজন দুহাত বাড়িয়ে এলোমেলো ছুটতে ছুটতে আমাদের দিকে আসছে। আসলে লোকটা পিঠে গুলি খেয়েছিলো, আমি ভাবলাম সে আমার ভাত কেড়ে নিতে আসছে! আমিও চেঁচাতে লাগলাম- ভাত দেবো না, ভাত দেবোনা বলে! ”

জলাটা যখন পেরিয়ে গেলাম, পিছনে খুব কাছেই কার প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনে তাকিয়ে দেখি সারা গায়ে আগুন নিয়ে একটা মেয়ে ছুটে আসছে। ওদের পাড়ায় পাকসেনারা আগুন দিয়েছিলো, আগুনে পুড়তে পুড়তেই সে পালিয়ে এসেছে। সে ছুটে এসে লাফিয়ে পড়লো জলার পানিতে, আমার তখনো মনে হলো সেও বুঝি আমার ভাতের থালাটা কেড়ে নিতেই আসছে। আমি আরো জোরে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালাম জঙ্গলের ভেতর। হাঁপাতে হাঁপাতে সাবধানে থালাটা সোজা করলাম। দেখি...”

“কী?” একসাথে বলে উঠলো ওরা দুইজন।

“দেখি একটাও ভাত নাই, একটাও না...সব পড়ে গেছে! আমি পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে থালা চাটতে লাগলাম, আর কে যেন আমার মুখ চেপে ধরলো, শব্দ করিস না, চুপ চুপ!”

পাপাই বাবুইও একদম চুপ! দাদুর ভাত খেতে না পারার দুঃখে ওদের চোখে কখন যে পানি চলে এসেছে। ওরা অবাক হয়ে দেখে দাদুর দু’চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়ছে পানি। দাদু তার মধ্যেই একটু হেসে বললেন, “সেই থেকে একটু মাথার ব্যারাম হয়ে গিয়েছে দাদুভাইরা, খেতে বসলেই সেই গুলি খাওয়া লোকটাকে দেখি, সেই সারা শরীরে আগুন জ্বলতে থাকা মেয়েটাকে দেখি, মনে হয় আমার ভাত বুঝি কেউ কেড়ে নেবে...মনে হয় এক্ষুণি বুঝি পাকসেনারা আসবে, আমাকে অন্ধকার জঙ্গলে ছুটে পালাতে হবে...”

দাদু এবার চোখ দুটো মুছে ফেলেন। পাপাই বাবুই চোখ মোছেনা, কিচ্ছু বলেও না। ওদের মনে পড়ে, স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা আপা বলেছিলেন, বাংলাদেশের পতাকার লাল রংটার পিছনে অনেক রক্ত অনেক কান্না আছে! আজ যেন সেই রক্ত সেই কান্নার কিছুটা ওরা বুঝতে পেরেছে!

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা