বেগম জাহান আরার গল্প

 একজন রূপার কথা



 

- তুই বড়ো বিপদে ফেলিস ঝুমকি। খুব বিরক্ত হয়ে বলেন মারিয়াম।
- কি বিপদ মা?
- বুঝতে পারছিস না?
- কি বুঝবো? বলবে তো?
- গা থেকে সোয়েটার খুলে রূপাকে দেয়ার কি দরকার ছিলো?
- ওর শীত লাগছিলো মা।
- ওদের এতো শীত লাগে না।
- কি যে বলো না মা? শুধু আমাদেরই শীত লাগে? আমার তো আরও সোয়েটার আছে, তাই না? একটা দিলাম তো কি হলো?
- দেখলি না, তোর মামির মুখ কেমন হয়ে গেলো?
- দেখিনি তো! কেনো হলো?
- কেনো যে কিছুই বুঝিস না?
- আমার জিনিস কাউকে দিলে মামির ক্ষতি কি মা?
- এটা কি তোর নিজের বাড়ি? যেমন খুশি তেমন চলবি।
- বা রে, নিজের মামার বাড়ি কি পরের বাড়ি হলো?
- তুই সত্যিই অবুঝ। তোকে কিছু বলাই বৃথা। তবে কাজটা  ঠিক করিসনি।
 

একমাত্র মেয়েকে বেশি বকা ঝকা করতেও পারে না মারিয়াম। তাহলে মেয়ের বাবার গোস্বা উঠে যাবে। নিজের বাড়িতে ঝুমকি যা করে করুক। পরের বাড়িতেও তাই করতে হবে? সাড়ে তিন বছর পর এসেছিলো ভাইয়ের বাড়িতে। মেয়ের জ্বালায় সেটাও হবে না আর মনে হয়।

রূপাকে সোয়েটার দেয়াটা ঠিক নয় কেনো, সেটা কিছুতেই তেরো বছরের মেয়ে ঝুমকির মাথায় আসে না। কতো বয়স হবে মেয়েটার? বাঁধা বুয়াটা সাধারণত মেয়েকে সাথে করে নিয়ে আসে। হাতে পাতে কিছু কাজ করে দেয়। সেইটুকু লাভ। মামির ফুট ফরমাসও খাটে সে। রূপা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ে ক্লাস থ্রি-তে। বেলা এগারোটার আগেই চলে যায় স্কুলে। ছুটির পরে আবার মায়ের কাছে আসে সে। স্কুল ছুটির দিন সারাদিনই থাকে মায়ের সাথে। গৃহস্থের বাড়িতে বিড়াল কুকুর যেমন এঁটো কাঁটা পায়, ঝুমকিও তেমন কিছু খাবার পায়। বিশেষ করে পাউরুটির কেটে ফেলা ধারগুলো খুব ভালো লাগে তার।



বাড়িতে লোকজন বেশি না। কিন্তু বড়ো বেশি অতিথি আসে। ইরফান সাহেবের তিন ছেলেমেয়েই খুব বন্ধুবাজ। জমজ দুই ছেলে রাজা আর বাদশা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেয়ে নিশাত এইবার কলেজ শুরু করলো। মফস্বল শহরে প্রতিবেশিরা বোধ হয় কিছু বেশি মেলা মেশা করে। প্রতিদিন তাদের কারো না কারো বন্ধুরা বিকেলে মামার বাসায় আসে। তখন চা নাশতা দেন বেগম ইরফান, মানে নাজিয়া মামি। রূপার কদর তখন বেশি। টুক টুক করে খাবার দাবার নিয়ে যায় আসে। চা পানি এগিয়ে দেয়।

সামুসা, সিঙাড়া, পাকৌড়া, বড়া, চানাচুর এইসব ফেলে ছেড়ে খায় বন্ধুরা। সেগুলোর গুঁড়োগাড়া গুছিয়ে বাটিতে রাখে রূপা। বেশ একমুঠ হয়ে যায়। মজা করে খায় সেগুলো। ইচ্ছে করলে ওকেও একমুঠ চানাচুর বা একটা সামুসা দেয়া যায়। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা হয় না নাজিয়া মামির। এই প্রথম রূপা সেটা লক্ষ করেছে। কেমন যেনো লাগে তার।

তের বছরের মেয়ে ঝুমকি। লাউয়ের ডগার মতো বেড়ে উঠছে। এ যুগের টিনএজ মেয়ে। আধুনিক ঢঙের পোশাক পরে। রূপাকেই ধুতে দেন মা। ঝুমকিকে খুব পছন্দ করে রূপা। কাছে কাছে ঘোরে। ভালো লাগে ঝুমকিরও। মামাতো ভাই বোনদের সাথে সহজ হতে পারে না ঝুমকি। কেমন যেনো ওদের কথাবার্তা। কিছু কিছু বুঝতেও পারে না। আঞ্চলিক ভাষা বলতেও পারে না সে। কিন্তু রূপার সাথে গল্প করতে বেশ লাগে তার। কি মিষ্টি করে হাসে। দেখতেও সুন্দর মেয়েটা। মায়া মায়া দুটো চোখ।

রূপার জন্য খারাপ লাগে ঝুমকির। ডিসেম্বরের শেষে কিছু ঠান্ডা তো পড়ে। কিন্তু রূপার কোনো সোয়েটার নেই। সকালে ওর মায়ের শাড়ি ভাঁজ করে গায়ে দেয়। একটু রোদ উঠে গেলেই সেটা খুলে রাখে। স্কুলে যাওয়ার জন্য নেই কোনও গরম জামা। হয়তো একটাই ছিটের ফ্রক। গা থেকে খুলে ওর মা মাঝে মাঝে সাবান দিয়ে ধুয়ে দেয়। তখন একেবারে উদোম গা।

সেদিন চায়ের কাপ ছলকে গায়ে জড়ানো শাড়িতে পড়ে গেলো খানিকটা চা। অমনি বুয়াটা এসে রূপার পিঠে বসিয়ে দিলো গোটা দুই চার থাপ্পড়। কেড়ে নিলো শাড়ির চাদর। ছেঁড়া মলিন একটা গেঞ্জি গায়ে কুচিমুচি হয়ে বসে চায়ের কাপ ধুচ্ছিলো কলতলায়। খুব মায়া লেগেছিলো ঝুমকির। দুবছরের পুরনো সোয়েটার গা থেকে খুলে দিলো রূপাকে পরিয়ে। কি এমন অন্যায় সে করেছে? কাজটা ঠীক নয় কেনো?

ব্যাপারটা এখানে থেমে গেলে কথা ছিলো না। কিন্তু আরো গড়ালো। ঝুমকি মাকে বললো, রূপাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে। রূপা বলেছে, ওর মা বিয়ে ঠিক করেছে তার। বর রিকসা চালায়। একটা তিন বছরের মেয়ে বাচ্চা রেখে বৌ মারা গেছে। তাকে দেখ ভাল করতে পারলেই হলো। বিয়েতে রূপার মাকে সে পাঁচশো টাকা দেবে। মা রাজি হয়েছে।

মনে মনে ভাবে মারিয়াম, কি বদমায়েস লোক? ফুট ফুটে মেয়ে দেখেছে, অমনি বিয়ের কথা। বুয়াটাই বা কি? মাত্র পাঁচশো টাকার জন্য রাজি হয়ে গেছে কচি মেয়েটার বিয়ে দিতে? এটা একটা কথা হলো? বাচ্চা গরু ছাগলও তো বিক্রি করে না গৃহস্থ! হাতে পায়ে একটু বড়ো হতে দেয়। এমন পোড়া সমাজের উন্নতি হবে কবে?

ঝুমকি স্কুলে পড়ে। কিছু বুঝতে শিখেছে। সমাজ পাঠের আপা বাল্যবিবাহ নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করেন মাঝে মাঝে। রাতে রূপার গল্পের কথা আবার বলে মাকে। তার আবদার হলো, রূপাকে নিয়ে যেতে হবে ঢাকায় তাদের বাড়িতে।

পরদিন মারিয়াম বুয়াকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, তুমি নাকি রূপার বিয়ে ঠিক করেছো?
- হ খালাম্মা।
- রূপার বয়স কতো?
- এই পুষ মাসে নয় বচ্ছর হয়াছে।
- নয় বছরের মেয়েকে বিয়ে দিলে কি হবে জানো?
- কি জাইনবো খালাম্মা?
- ওকে লেখা পড়া করতে দাও।
- গরিবের লেখা পড়া করে কি হবে গো খালাম্মা?
- আমি কি করছি লেখা পড়া করে?
- অর পঢ়ার খরচ জুগাবে কে মা? আমি পারছিনাখো।
- ও তো সরকারি প্রাইমারি স্কলে পড়ছে। পড়তে দাও। সরকারি স্কুলে বেতন লাগে না, বইপত্র ফ্রি পাওয়া যায়। খরচ কিসে?
- সে কথা বুইলেন না খালাম্মা। খরচ লাইগবে না বুইলাই তো ইস্কুলে দিয়াছিনু। কিন্তু খাতা পেলসিন লাগে। চাঁন্দা লাগে।
- চাঁদা মানে? খাতা পেন্সিল বুঝলাম। কিন্তু চাঁদা কিসের ?
- আইজক্যা মিলাদ, কাইলক্যা নিকপিক, পরশু খেলা, কোচিং-এ জ্যাতে বলে, তার টাকা, এই সগ।
- আমি বলছি, রূপাকে পড়াও। আমি টাকা দেবো রূপার জন্য। ঠিক আছে?
- কি বুলবো মা?
- কিছুই বলবে না। কাজটা করবে। জানোতো, আমি কি চাকরি করি?
- না খালাম্মা।
- সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসের ডিরেক্টর। আমার কথা না শুনে যদি রূপার বিয়ে দাও, তাহলে জেলে দেবো তোমাকে। দশ বছরেও ছাড়া পাবে না জেল থেকে। বুঝেছো?
- বুঝনু তো খালাম্মা। কিন্তুক---
- কোনও কিন্তু নয় বুয়া। এই মেয়েটা এস এস সি পাশ করার আগে কোনও বিয়ে নেই। তারপর আমি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে নার্সিং-এ ভর্তি করিয়ে দেবো। ওকে বাঁচতে দাও।

[দুই]

রূপা ক্লাস নাইনে উঠেছে। ঝুমকি তার অভিভাবকের কাজ করে। গতো পাঁচ বছরের প্রতি জানুয়ারি মাসে রূপার জন্য বই পত্র এবং জামা কাপড়ের টাকা পাঠাবার দায়িত্ব সে পালন করছে। বাবা মাই টাকা দেন। রূপার সাথে ঝুমকি চিঠি পত্র লেখালেখি করে। যেনো দুই বোনের পত্রালাপ। মন্দ লাগে না মারিয়ামের।

একদিন রূপার লেখা একটা পোস্টকার্ড দেখেন মারিয়াম। মুগ্ধ হয়ে যান তার হাতের লেখা দেখে। কি সুন্দর গুছিয়ে লেখেছে ঝুমকিকে।

ঝুমি আপু
কেমন আছো? আমাদের স্কুলে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে এবার আমি আবৃত্তি করেছি। জানো আপু, ক্লাস নাইনের মেয়েরা এখন অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে। এবার একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আমিও আবৃত্তি করবো। আমার না একটা কালোপাড় সাদা শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয় আপু। মাকে বলিনি কথাটা। খুব রাগ করবে। তুমি কিন্তু রাগ করো না।

আমি ভালো আছি। মন দিয়ে লেখা পড়া করি। খালামনি আর খালু আব্বাকে সালাম দিও। তুমি কবে আসবে মামাদের বাড়ি? দেখতে ইচ্ছে করে তোমাকে। তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।

আমার ভালোবাসা নিও।

ইতি
রূপা


আহারে, কতোটুকু চাওয়া। তাও কতো সাবধানে বলেছে। সাধারন কালো পাড়ের একটা শাড়ি পাওয়ার ইচ্ছে মেয়েটার। ফোন চায়নি, বাড়তি টাকা চায়নি, জুতো ছ্যান্ডাল ছিঁড়ে গেছে, এসব বলেনি। মারিয়ামের চোখে পানি চলে আসে।

ঝুমকির চিঠিটা পড়ে ভাবে, জানুয়ারি মাসে রূপার জন্য টাকা পাঠানোর সময় কালোপাড় শাড়ির টাকাও পাঠিয়ে দেবে।

ঝুমকি এখন উনিশ বছরের নিটোল কিশোরি। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে বিএ প্রথম বর্ষে পড়ছে। এরই মধ্যে তাদের ছোটো একটা দল হয়েছে। সবাই নাকি দেশেই সমাজ সেবার কাজ করবে পেশা হিসেবে। তাদের প্রথম কাজ হবে সুবিধে বঞ্চিত মেয়েদেরকে লেখাপড়ার ব্যাবস্থা করে দেয়া। প্রত্যেকের বাড়িতেই অল্পবয়সি কাজের মেয়ে আছে। তারা সেই মেয়েকে লেখাপড়া শেখায় বাড়িতে। স্কুলে পাঠাতে পারে না।

অনেক চেষ্টা করেছে একটা সান্ধ্য-স্কুল করতে। মানে, কারও কোনও গ্যারাজে সন্ধে বেলায় একঘন্টা করে কয়েকজন কাজের মেয়েকে পড়াতে চেয়েছিলো। কিছুতেই হয়ে ওঠেনি। মেয়েদের নাকি সন্ধে বেলায় বাড়ির বাইরে কাজ করতে হয় না। কি আশ্চর্য কথা!

একমাত্র ঝুমকির পছন্দের মেয়েটাই স্কুলে যায়। খুব খুশি সে। রূপা লেখাপড়া শিখছে। আর মাত্র দুই বছর পর রূপা ঢাকায় আসবে। মারিয়ামও খুশি। বিশ্বস্ত একজন কেউ থাকবে বাসায়। পঁচিশ বছর পর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিতে চান তিনি। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া বাতের ব্যথাটা বড়ো কষ্ট দেয়। ঢের হয়েছে। আগামি বছর অবসরে যাবেন। পঁচিশ বছর হয়ে যাবে। মেয়ে তো ডানা মেলে কবে উড়ে যাবে। যদিও বলে, দেশেই থাকবে সে। মা বাবাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না সে। বললে কি হবে? দলের দুজন তো চলেই গেছে। একজন ফিলিপাইন, একজন কোরিয়া। ঝুমকি কোথায় যাবে সে জানে না। তবে যাবে। মারিয়াম নিশ্চিত। তখন হয়তো এই রূপাকে অবলম্বন করেই বাঁচতে হবে।

যথারীতি চলছিলো সবই। রূপা ক্লাস টেনে উঠে কোচিং করতে চাইলো। মারিয়াম বিরক্ত হন। গরিবের ঘোড়া রোগ দেখলে কার ভালো লাগে? ঝুমকি চায়, টাকাটা দেয়া হোক। অন্তত জুন থেকে পরীক্ষার আগ পর্যন্ত। কয়েকটা মাস মাত্র। মাকে বলে, মনে করো, রূপা তোমার আর একটা মেয়ে। রূপা ভালো ভাবে পাশ করুক এটা তো সবাই চাই। তাই না মা?

সত্যিই তো, ঝুমকির পরেরটা জন্ম নিলে তাকে তো ফেলে দেয়া যেতো না। সেই তারপর থেকে যে কি অসুখ হলো, আর কেউ এলো না তাদের ঘরে। মনটা নরম হয়ে যায় মারিয়ামের।

জুলাই থেকে কোচিং-এর টাকা দেয়া শুরু হলো। রূপা সপ্তায় একটা কার্ড লেখে। সুন্দর বাঙলা লেখে মেয়েটা। সহজ কথা সহজ করে জানায়। ঝুমকি খুব খুশি। রূপা নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এটাই সে চেয়েছে। মাকে বলেছে, যুব উন্নয়নের কোনও একটা প্রশিক্ষনে তাকে ভর্তি করতে হবে।

ডিসেম্বরে ঠিক টেস্ট পরিক্ষার আগে হঠায় রূপা অসুস্থ হয়ে যায়। এমন অবস্থা, লেখা পড়াই বন্ধ হয়ে গেলো। স্থানিয় হাসপাতালের ডাক্তার বলেছেন, গ্যাস্টিক আলসার হয়েছে। পুরনো হয়েছে রোগটা। টয়লেটের সময় রীতিমতো রক্ত যাচ্ছে। সাথে প্রচন্ড ব্যথা এবং বমি। খাওয়া দাওয়া করতে পারে না।

দিশেহারা হয়ে পড়ে ঝুমকি। মামা মামির সাথে যোগাযোগ করে। তাঁরা জানালেন, অবিলম্বে অপারেশন না করালে রূপাকে বাঁচানো যাবে না। তাদের কিছু করার নেই। কিন্তু কি করতে পারে ঝুমকি? বেশ বুঝতে পারে মা বাবা এই দায়িত্ব নিতে চাইবেন না।

তাহলে মেয়েটা মরে যাবে বিনা চিকিতসায়? কি করে হয়? ঝুমকির দলের এক বন্ধু নীলার কথা মনে হলো। তার বাবা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার। নামকরা সার্জন। গরিবের বন্ধু বলে চাচার অনেক সুনাম। অনেক গরিবের চিকিতসা করেছেন তিনি । নীলার সাথে গিয়ে তাঁকে বলে দেখবে কি? চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। নীলাকে ফোন করে রূপার অবস্থার কথা বলে ঝুমকি। তাদের দলের বন্ধুরা সবাই জানে রূপার কথা। বেশি বলতে হলো না। নীলা বললো, তুই চলে আয় কাল সকালে। বাবার কাল অফ-ডে। আমিও আছি তোর সাথে।

মারিয়াম বললেন, একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না ঝুমকি? এই পৃথিবীতে যতো দুঃখ, ততো উপশম কোথায়? আমরা চেষ্টা করেছিলাম রূপাকে মানুষ করে তোলার। ওর দুর্ভাগ্য। আমরা আর পারছি না।
- আমি এক্টু চেষ্টা করে দেখিনা মা।
- তুই কি করতে পারবি বাবা?
- নীলাকে চেনো না? ওর বাবা ডাক্তার। ওর সাথে কথা বলেছি। কাল ওর বাবার সাথে কথা বলবো। নীলা যেতে বলেছে মা।
- কাজটা কি ঠিক হলো ঝুমকি ?
- কেনো নয় মা? বলেই দেখি না। মেডিকেলে ভর্তি করতে পারলে হয়ত রূপা বেঁচে যাবে। ডাক্তার চাচা অনেকের উপকার করেন শুনেছি। বাকিটা রূপার কপাল।
- তোর বাবার সাথে কথা বলে নিস একবার।
- হংকং থেকে বাবার ফিরতে এখনো চারদিন বাকি। রূপার অবস্থা ভালো না মা। খুব তাড়াতাড়ি ওর চিকিতসা দরকার।


[তিন]


ঝুমকি আর নীলার চেষ্টায় রূপার সব ব্যবস্থা হলো। গাজিপুর থেকে ভ্যানে নিয়ে আসা হলো রূপাকে। সারা শরীর কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। ডাক্তার চাচা ভর্তি করে নিলেন হাসপাতালে। বিছানায় রূপা যেনো মিশে আছে। পনরো ষোলো বছরের মেয়েকে মনে হচ্ছে এক চিলতে বালিকা।

চাচার পেশেন্ট হিসেবে ভালো চিকিতসা শুরু হলো। চাচা নিজেই করেছেন অপারেশন। তিন সপ্তা পর উঠে বসলো রূপা। প্রচন্ড দুর্বল। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার।

ঝুমকির হাত ধরে বলে, আপু, তুমি না থাকলে মরেই যেতাম গো।

- শুধু আমি নই রে, এই যে নীলা, আমার বন্ধু, ও সাহায্য না করলে কি যে হতো ভাবতে পারি না। বিশেষ করে ওর বাবা, মানে ডাক্তার চাচা দেবদুত হয়ে এসেছিলেন তোর জীবনে।

চাচা এলেন রাউন্ডে। হাসি খুশি দয়ালু মানুষ। নীলা আর ঝুমকিকে দেখে বললেন, এই যে সমাজ সেবিকারা, তোমাদের জন্য মেয়েটা বেঁচে গেলো মা। আমি প্রশংসা করি তোমাদের।

মাথা নিচু করে ঝুমকি বলে, আমরা কিছু করিনি চাচা। আপনি না সাহায্য করলে কিছুই হতো না।
- না না বাছা, এই যুগে তোমাদের মতো সন্তান দেশের জন্য
আশীর্বাদ। দুঃখিকে ভালোবাসা মস্ত গুন। প্রার্থনা করি, আমাদের সন্তানেরা এমনই হোক। তাহলে দেশের সমস্যা অনেক কমে যাবে। বেঁচে থাকো মা।

রূপা ডাক্তার চাচার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে চায়। পারে না।
কৃতজ্ঞতায় ওই ছোট্ট মেয়েটার চোখ বেয়ে পানি ঝরছে।

চাচা বলেছেন, দুই মাস বিশ্রাম আর ভালো খাবার পেলে সেরে উঠবে তাড়াতাড়ি রূপা। কিন্তু হায়, এই দুই মাস কোথায় থাকবে রূপা? ঝুমকি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসে।

আবার মারিয়েমের কাছে ধর্না দেয় ঝুমকি। রাজি হন না তিনি। বলেন, আমারই শরীর খারাপ। ওর যত্ন নেবে কে?
- যত্নের দরকার নেই মা। রূপার দরকার বিশ্রাম আর তিন বেলা নিয়মিত খাবার।
- ঝামেলা করিস না ঝুমকি। ওকে গাজিপুরে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দে।
- ওদের ঝুপড়ি ঘরে থাকলে আবার ওর শরীর খারাপ হবে মা। নির্ঘাত মরে যাবে রূপা।
- ওরা অভ্যস্ত ঐ পরিবেশে থেকে। কিছুই হবে না।
- এতো নিষ্ঠুর হয়ো না মা। আমাদের গেস্ট রুম তো খালিই পড়ে আছে। মাত্র দুইটা মাসই তো। তুমি না সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের লোক। মানুষের উপকার করো। আজ নিজের ঘরে একজনকে আশ্রয় দাও, প্লিজ।
- বাবাকে বলে দেখ। বিব্রত হন মারিয়াম।
- তুমি রাজি হলে বাবা আপত্তি করবেন না।

অবাক হন মারিয়াম। উনিশ বছরের মেয়ে এতো পরিণত হলো কবে? মাকে বোঝাচ্ছে সে। নিজেই বুঝতে পারেন না, রূপাকে কেনো রাখতে চাইছেন না। অথচ রূপাকেই তো মনে মনে চেয়েছেন একা থাকার সঙ্গী হিসেবে। এতোকাল টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। নিমরাজি হয়ে কোচিং-এর টাকাও দিচ্ছিলেন। অবশ্যই তিনি চেয়েছেন, রূপা নিজের পায়ে দাঁড়াক। সারাদিন মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেন তাঁরা। সেজন্য শিক্ষা অনিবার্য।

মেয়েটা এগোচ্ছিলো ভালোই। কপাল মন্দ। অসুস্থ হয়ে পড়লো। অসুখ টানতে ইচ্ছে করে না তাঁর। ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই।
কাছে রেখে ঝুমকির মতো আর এক মেয়ে ভাবতে পারছেন না রূপাকে। কোথায় যেনো লাগছে সংস্কারে। আবার ঝুমকির জন্য গর্ব হচ্ছে। এমন সোনার মেয়ে তাঁর ঘরে দিয়েছেন দয়াময়। এই বয়সের ছেলেমেয়ে নিয়ে কতো মানুষের, কতো সমস্যা!

ঝুমকির জয় হলো। বাবার সহানুভূতি পাওয়া গেলো। ফলে রূপাকে এনে তুলতে পারলো বাসায়। গাজিপুর থেকে ওর মা এসেছিলো মেয়েকে দেখতে।

বুয়াটার যথেষ্ট বুদ্ধি। মেয়েকে দেখলো। কাছে বসে আদর করলো। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো বিকেলেই। থাকতেও চাইলো না।


*[সত্য ঘটনা অবলম্বনে]

 

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা