মৌলি আখন্দের গল্প


ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক



আজ লামিয়ার জন্মদিন। ওর বয়স আজকে ছয় বছর পূর্ণ হলো। 

সকাল থেকে আজকে বাসায় সাজ সাজ রব। আম্মু ভোরে উঠে রান্নাবান্না করছে।

আব্বু বেলুন, মোমবাতি কিনে এনেছে। বাসা সাজানো হচ্ছে রঙ বেরঙের বেলুনে আর রঙিন কাগজ দিয়ে।

আম্মু কেক বানাচ্ছে বেবি শার্ক থিম দিয়ে। লামিয়ার নতুন জামা বের করে রেখে দিয়েছে বিছানার ওপর।

গোসল করে নতুন জামা পরবে লামিয়া। একটু পর গিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে জামাটা। 


ওদের বাসায় কাজ করতে আসে যে বুয়া তার মেয়ে সেলিনাও লামিয়ার বয়সীই হবে। সেও এসে দেখে যাচ্ছে।

“কি সুন্দর পাখাওয়ালা জামা! এই জামার দাম কত আপু? হাজার টাকা, না?”

দামটা লামিয়াও সঠিক জানে না। আব্বুকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

বিকেল হতে না হতেই সবাই এসে পড়ল। গুলশান থেকে ছোট ফুপি, উত্তরা থেকে বড় খালামণি, ধানমণ্ডি থেকে মেজ চাচু আর দাদা দাদি পরীবাগের মামা সবাই চলে এল একে একে। সাথে সবার ছেলেমেয়েরা।

বড় ফুপি দেশের বাইরে থাকে, কেক কাটার সময় তাকে ভিডিও কল করা হবে। ছোট ফুপি আবার মিস্টার বেকার থেকে আরেকটা ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক নিয়ে এসেছে। লামিয়ার চোখে জল এসে গেছে দেখেই। ব্ল্যাক ফরেস্ট ওর সবচেয়ে প্রিয়।

কেক কাটা হলো ঠিক সাতটায়। লামিয়ার আম্মু কেক কেটে সবার হাতে হাতে দিয়ে দিল।

বুয়া রোজদিন বিকেলের আগেই চলে যায়। তাকে আজ রাত পর্যন্ত থাকতে বলা হয়েছে।

আম্মু কেক কেটে কেটে প্লেটে প্লেটে ভাগ করেছে। সেলিনার হাতে কেকের শেষ প্লেটটা তুলে দিয়ে কেকের খালি বক্সটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল আম্মু। ছোট ফুপি পেছন পেছন গিয়ে অসহিষ্ণু গলায় বলল, “ব্ল্যাক ফরেস্ট পুরোটাই শেষ করে ফেললে ভাবি?”

লামিয়ার হাতে একটু কেক লেগে গিয়েছিল। সেটা ধোয়ার জন্য রান্নাঘরে যেতে যেতে সে শুনতে পেল আম্মু বলছে, “কেন কী হয়েছে?”

“কী হয়েছে? কেন তুমি জানো না আমার সাদিব ব্ল্যাক ফরেস্ট কত পছন্দ করে? আমি ভাবছিলাম একটু বক্সে করে নিয়ে যাব! বুয়ার মেয়েকে না দিয়ে তুমি সাদিবকে আরেকবার দিতে পারতে না?”

আম্মু শান্ত গলায় বলল, “সাদিব তো অনেক ব্ল্যাক ফরেস্ট খেয়েছে, পরেও খাবে! ওরা তো আর এসব জিনিস খেতে পায় না!”

“ওরা ব্ল্যাক ফরেস্টের মর্ম বুঝবে? খেয়েছে জীবনে?” রাগে গজগজ করতে লাগল ফুপি।

“না বুঝলে নেই। তবে জীবনে খায়নি বলেই তো ওদেরই আগে দেওয়া উচিত!”

ফুপি রেগে গিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লামিয়া ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে ঢুকে হাত ধুয়ে এল।

কিছুক্ষণ পর লামিয়া খেয়াল করল ফুপি দাদির কাছে গিয়ে নিচু গলায় কী যেন বলছে। দুই একটা শব্দ শুনে বুঝতে পারল আম্মুর সম্পর্কেই কিছু বলছে ফুপি।

মনটা খারাপ হয়ে গেল লামিয়ার। আম্মুর কী দরকার ছিল সেলিনাকে ব্ল্যাক ফরেস্ট দেওয়ার। সাদিবকে দিলেই পারত।

লামিয়া খেয়াল করল ছোট ফুপি আজকে আগে আগেই বেরিয়ে গেল, খাওয়ার পর পরই। দাদির মুখ গম্ভীর। আম্মুর সাথে ভালো করে কথা বলছে না।

দাদিও যাওয়ার সময় আব্বুকে আলাদা করে ডেকে কী যেন বলে গেল। আব্বু তখন হেসে উড়িয়ে দিলেও রাতে শোবার সময় লামিয়া টের পেল আব্বু আম্মুর সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছে।

রাতে ঘুম পাড়ানোর সময় লামিয়া বলেই ফেলল, “আম্মু, তুমি ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকটা সাদিবের জন্য রাখলেই পারতে?”

গম্ভীর হয়ে গেল আম্মু। লামিয়াকে কাছে ডেকে বলল, “মামণি, তুমি বা সাদিব তো প্রতি বছরই জন্মদিন কর। সেলিনা কি করতে পারে?”

লামিয়া কী বলবে বুঝতে পারল না। আম্মু ওর চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলল, “ওর আব্বু তো ওর জন্মের আগেই ওর মাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাই ওর মা আমাদের বাসায় কাজ করে। তাই বলে ওর কি ইচ্ছে করে না জন্মদিনের কেক খেতে?”

“আমি বুঝেছি, আম্মু।“ চোখ বন্ধ করল লামিয়া।

পরদিন সেলিনাকে জিজ্ঞেস করল লামিয়া, “তোমার জন্মদিন কবে?”

“জানি না তো, আপু!”

“বুয়া খালা, ওর জন্মদিন কবে!”

“কে জানে! গরিবের আবার জন্মদিন!”

গজগজ করতে করতে উত্তর দিল বুয়া। মন খারাপ হয়ে গেল লামিয়ার।

রাতে খেতে বসে ঘোষণা করল লামিয়া, “আব্বু, আমি সেলিনার জন্মদিন করতে চাই।“

ভ্রূ কুঁচকে গেল আব্বুর। “কার?”

“সেলিনা, আমাদের বুয়া খালার মেয়ের।“

আব্বু অবাক হয়ে তাকাল আম্মুর দিকে। “তুমি শিখিয়েছ?”

“আমি শেখাব কেন!”

আব্বু লামিয়ার দিকে ফিরে বলল, “কবে জন্মদিন?”

“তারিখ তো ওরা জানে না! কিন্তু তাই বলে কি জন্মদিন হবে না?”

আব্বু কিছু বলার আগেই আম্মু বলল, “নিশ্চয়ই হবে!”

“আমরা কাউকে দাওয়াত করব না?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করব! সেলিনার কোনো বন্ধু আছে কিনা, ও কাউকে দাওয়াত করতে চায় কিনা, ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে।“

তার কিছুদিন পর দেখা গেল একটা অবাক করা দৃশ্য। কড়াইল বস্তির সামনে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে, যেখানে চায়ের দোকানে আড্ডা হয়, সেখানে বিকালে একটা টেবিল পাতা হলো।

পরীর মত পাখাওয়ালা গোলাপি জামা পরা ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে সেই টেবিলের ওপর একটা কেক রেখে তার ওপর মোমবাতি জ্বালিয়ে এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিয়ে তারপর কেক কাটল। তাকে ঘিরে থাকা আরও অনেকগুলো বাচ্চা হাততালি দিয়ে বলল “হ্যাপি বার্থডে সেলিনা!”

একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার মা যখন চোখ মুছছিল তখন বাচ্চাগুলো কাড়াকাড়ি করে কেক খাচ্ছিল।

ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা