নাফিসা নাহিয়ানের গল্প


মিস্টার অ্যালজেব্রা


রাত ১২টা বেজে ১মিনিট পার হয়েছে।

একটা পেঁচা ডাকতেই মিস্টার অ্যালজেব্রা বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। রোজকার মতো ধুলো পড়া জানালাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কারটায় নিজের চেহারা দেখে চুলগুলো এলোমেলো করে নিলেন। কিন্তু আজ কোন সাধারণ দিন নয়। আজ অনেক অনেক দিন পর কেউ এসেছে এই বাড়িতে থাকার জন্য। তাই তিনি মনের আনন্দে একটা গানের সুর গাইতে গাইতে নিজের অন্ধকার ধুলো পড়া ঘর থেকে বের হলেন। যারা এ বাড়িতে থাকতে এসেছে তাদের নাকি ছোট ছোট দুটি বাচ্চাও আছে। এই ভেবে মিস্টার অ্যালজেব্রা আরো খুশি হলেন।

আমরা এখানে যে মিস্টার জেব্রার কথা বলছি, মানে মিস্টার অ্যালজেব্রা (মিস্টার জেব্রা বললে তিনি আবার রেগে যান) আদতে তিনি মোটাসোটা উঁচু লম্বা ধরনের একটি ভূত।

এটুকু লিখতে এই মিস্টার অ্যালজেব্রা আমার কানের কাছে এসে হুংকার দিয়ে উঠলেন, "অ্যা!! ভূত বলে কি আমাদের কোনো সম্মান নেই? আমরা তো কোনো জড় বস্তু কিংবা জীবজন্তু নই যে আমাদের "একটি ভূত" বলতে হবে। 'একজন ভূত' লেখ।

আমি বেশ থতমত খেয়ে গেলাম আবার ঠিক করে লিখতে শুরু করলাম আর মিস্টার অ্যালজেব্রা বলতে লাগলেন। বাচ্চাদের ভয় দেখানো বেশ সহজ। তারা সহজেই ভয় পায়। শুধু ঘুমের সময় তাদের ঘরে গিয়ে একটু খুটখাট শব্দ করতে হবে। তবেই তারা ভয় পাবে। আহা! কতদিন পর ভয় দেখাবো, এই ভাবতে ভাবতে তিনি বাচ্চাদের রুম খুঁজতে লাগলেন, অবশেষে পেয়েও গেলেন। দোতালার একদম কোনায় ঘরটা, মা বাবার ঘর থেকে বেশ দূরে। তিনি বাক্সগুলোর রুমে ঢুকতে কি একটায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। তারপর উঠে দেখলেন সেগুলো ছিল অ্যালজেব্রার বই। তিনি পরম যত্নে বই গুলো গুছিয়ে রাখলেন। তিনি হোঁচট খাওয়ার ফলে বইগুলো পড়ে গিয়েছে।

বইগুলো তাকে পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিল। তিনি একসময় অ্যালজেব্রায় খুব ভালো ছিলেন। তাই তার এই উপাধি। তার আসল নাম থ্মাস স্টিভেন্স সিবাসটিয়ান অ্যালজেব্রা।

গভীর ঘুমে থাকা বাচ্চা দুটোর দিকে তাকালেন। দুজন একই রকম দেখতে। তিনি জানতেন না যে তারা জমজ। বইগুলো গুছিয়ে রাখার সময় তিনি তাদের নাম দেখেছেন। একজনের নাম এডওয়ার্ড শ্যারন, আর অন্যজন এডয়ার্ড ম্যারুন। মিস্টার অ্যালজেব্রা কেন যেন বাচ্চাটিকে দেখে তার নিজের দুই ছেলের কথা মনে হলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তার ভয় দেখানোর ইচ্ছেটা চলে যায়। এবার সেই তিনি যাবেন তখন দেখলেন বাচ্চা দুটো ড্যাব ড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বেশ থতমত খেয়ে গেলেন। বাচ্চাগুলো তার দিকে তাকিয়ে মোটেও ভয় পেলোনা কিংবা বাবা মাকে ডাকলো না।

উল্টো তার দিকে হাত বাড়িয়ে একসঙ্গে বলে উঠলো, "আমার নাম এডওয়ার্ড শ্যারন, আমার নাম এডওয়ার্ড ম্যারুন। আমাদের নামটা বেশ বড় তাই আপনি আমাদের শ্যান আর ম্যান বলতে পারেন। আপনার নাম কি? আপনি নিশ্চয়ই এই বাড়ির ভূত। শুনেছি এ বাড়িতে একজন ভূত আছেন"।

এটুকু শুনেই মিস্টার অ্যালজেব্রার তাদের প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল। তারা ভূতকে 'একজন' আর 'আপনি' বলে সম্বোধন করেছে। তিনি তাদের দিকে ফিরে যথাসম্ভব নরম গলায় বলার চেষ্টা করলেন (বলাই বাহুল্য অনেক দিন কথা না বলার দরুন ঘরঘরে এক ধরনের শব্দ বেরল যা হলো) আমি মিস্টার অ্যালজেব্রা তারা হাসি হাসি মুখ করে বলল, "নাইস টু মিট ইউ"। তারা তাকে আরও বলল, "আমরা কখনো ভূত দেখি নি এই বাড়িতে ভূত আছে শুনে আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম, যদিও বাবা-মা খুব ভয় পেয়েছিল বলতে গেলে আমরাই মা আর বাবাকে জোর করে রাজি করিয়েছি। আমরা আপনার কাছ থেকে ভূতের জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।"

এটুকু বলে তারা দম নিতে একটু থামল। তখন মিস্টার অ্যালজেব্রা পাশে থাকা চেয়ারে আয়েস করে বসে বললেন, "বল, তোমরা কি কি জানতে চাও?" তারা এরপর একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগলো। প্রশ্নগুলো অনেকটা এরকম, "আপনি কি ড্রাকুলা, জোমবি নাকি মমি? আপনি কি খান?

অনেক কথা শেষে মিস্টার অ্যালজেব্রা বিদায় দিয়ে তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা হলেন। এতদিন পর কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে পেরে তার খুব ভালো লাগলো। বেশ খুশি মনে ঘুমাতে গেলেন। এদিকে শ্যান আর ম্যান ঘুমালো। কিন্তু ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে ফেলল। পরদিন রাতেও মিস্টার জেব্রা তাদের ঘরে গেলেন অনেক গল্প বললেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই তাদের সাথে গল্প করতে লাগলেন। তাদের সাথে মিস্টার অ্যালজেব্রার বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল তারা এখন একটা স্কুলেও যায়। কিন্তু তারা নাকি অংকে বেশ কাঁচা। তাই মিস্টার অ্যালজেব্রা তাদের গল্পে গল্পে অনেক অংক শেখাতে লাগলেন। এদিকে রাতের বেলায় ছেলেদের ঘর থেকে আওয়াজ শুনে আরো ঘরের মধ্যে রাতে এমন শব্দ শুনে তাদের মা-বাবা বেশ শঙ্কিত হলেন। এছাড়াও তাদের অফিস আর স্কুল বেশ দূরে হওয়ায় সব মিলিয়ে তারা ঘরটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত করছিলেন। এই ব্যাপারটি তারা তাদের দুই ছেলেকে জানালেন। তারা খুব মন খারাপ করলো এবং সিদ্ধান্ত নিলো যে তারা মিস্টার অ্যালজেব্রাকে ব্যাপারটি জানাবে। এই কথা শুনে তিনি খুব মন খারাপ করলেন, তাদের নানা রকম বুদ্ধি দিতে লাগলেন। কোনটি কাজ করছে না দেখে তিনি নিজেই একটি কাজ করছেন।

পরদিন সকালে এডওয়ার্ড পরিবার যখন সকালের নাস্তার জন্য খাবার টেবিলে বসলেন, টেবিলে পড়ে থাকা একটি চিরকুট দেখে তাদের চোখ কপালে উঠলো। চিরকুটে লাল রক্ত দিয়ে লেখা: 'এই বাড়ি ছেড়ে কেউ কোথাও যাবে না!'

কিন্তু এতেও কোনো কাজ হলো না। বরং তাদের যাওয়ার দিন আরো এগিয়ে দেওয়া হল, আস্তে আস্তে তারা সবকিছু গুছিয়ে নিতে লাগল এবং একদিন সত্যিই তাদের চলে যাওয়ার দিন আসলো। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তারা বাড়িটি ছেড়ে রওনা দেবে সন্ধ্যাবেলা আর রাতের ট্রেনে করে চলে যাবে। তাদের সাথে কাটানো শেষ রাতে সে তাদের বিদায় জানিয়ে দিল। তারা চলে যাবার সময় সে তার ঘরের জানালা দিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো বাইরের অন্ধকারে গা ছমছমে পথের দিকে।

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা