গল্প - মৌলী আখন্দ

পাখির বাসা

 

আম্মু আম্মু দেখ দেখ ওই দেখ একটা টি রেক্স!

মীরা লামিয়ার আঙুল অনুসরণ করে তাকাল। সত্যিই এক টুকরো মেঘ ভেসে যেতে যেতে এমন একটা আকৃতি তৈরি করেছে মনে হচ্ছে যেন একটা টি রেক্স। মীরা নরম গলায় বলল, এই মেঘটার নাম কী মনে আছে?

চার পেরোনো লামিয়া উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠে বলল, আছে তো! কিউমুলাস মেঘ!

মীরা হাতের ঝাঁঝরিটা নামিয়ে রেখে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আর ওই পেছনে দেখ, কেমন জমাট বেঁধে আছে তুলোর মত! মনে হচ্ছে মেঘের উপর একটা প্রাসাদ!

ওই প্রাসাদে কারা থাকে আম্মু?

পরীরা থাকে আর তোমার মত পরীর বাচ্চারা থাকে।

আমার মত পরীর বেবিরা আর তোমার মত পরীরা থাকে?

মীরা মুখ টিপে হেসে বলল, হ্যাঁ।

লামিয়া মুখে আঙুল দিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ওখানে কি আমরা যেতে পারব আম্মু?

মীরা নিচু হয়ে লামিয়ার গালে চুমু খেয়ে বলল, নিশ্চয়ই যেতে পারব আম্মু, যখন তুমি অনেক বড় হবে, তোমার যখন দুটো পাখা হবে, তখন তুমি উড়ে উড়ে ওই মেঘের ওপর বাড়িটাতে উড়ে চলে যেতে পারবে!

সত্যি আম্মু?

সত্যি, সত্যি, সত্যি! তিন সত্যি!

তখন ওটা আমাদের বাড়ি হবে?

হ্যাঁ আম্মু! আমাদের মেঘবাড়ি! কিন্তু কাউকে বলো না যেন! ওটা আমাদের সিক্রেট!

লামিয়া ঘাড় কাত করল। বলবে না সে।

এখন বল তো ওটা কী মেঘ! মনে আছে?

ওটা কিউমুলোনিম্বাস।

মীরা নিচু হয়ে লামিয়াকে জড়িয়ে ধরল। তোমার সব মনে থাকে মা?

লামিয়া মাথা কাত করে বলল, হ্যা-এএ!

মীরা আবার ঝাঁঝরি হাতে তুলে নিল। গাছে পানি দেওয়া শেষ হয়নি। আর লামিয়া ভেসে যাওয়া মেঘে কখনো তিমি, কখনো বা শুয়োপাকা আরও কত কত আকৃতি খুঁজে পেতে লাগল আর মাকে ডেকে ডেকে দেখাতে লাগল। মীরা গাছে পানি দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে লামিয়ার কথার টুকটাক উত্তর দিতে থাকে।

এই ছাদে অনেক গাছ। আমড়া গাছ, কামরাঙা গাছ থেকে শুরু করে আমগাছ পর্যন্ত আছে। আছে অপরাজিতা, টাইম ফুল, নয়নতারা, গোলাপ গাছ, লেবুগাছ, কমলাগাছ। মোট বত্রিশটা টব। এতগুলো টবে পানি দেওয়ায় কম সময় লাগে না। নিচের দারোয়ান মাঝে মাঝে টবের আগাছা পরিষ্কার করে দিয়ে যায়, কিন্তু শুধু তার উপর ভরসা করে থাকলে চলে না।

ওরা মা মেয়ে এসেছিল ছাদে কাপড় নেড়ে দিতে। কাপড় নেড়ে দিয়ে গাছে পানি দিয়ে ঘরে ফিরে মীরা দেখল একটা চড়ুই পাখি পাগলের মত সারা বাসায় উড়ে বেড়াচ্ছে।

লামিয়া খুশিতে লাফাতে লাগল। আম্মু দেখ একটা চড়ুই পাখি বেড়াতে এসেছে আমাদের বাসায়!

বেচারার ভয়ার্ত ছোটাছুটি দেখে মীরার মায়াই লাগল। ড্রয়িং রুমের থাই গ্লাসের ওপাশে আরও অনেক চড়ুই জড়ো হয়ে গেছে। তারা তাদের ভেতরে আটকে পড়ে যাওয়া সাথীর জন্য উদ্বিগ্নভাবে কিচির মিচির করছে।

কীভাবে ঢুকল এটা, কে জানে? কোনো ভেন্টিলেটর কিংবা খোলা জানালা দিয়ে হবে নিশ্চয়ই। এখন আর বের হয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না।

মীরা আস্তে করে ড্রয়িং রুমের থাই গ্লাসটা খুলে দিয়ে চড়ুইটাকে সেদিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। লামিয়া চিৎকার করে বলল, ওকে বের করে দিচ্ছ কেন আম্মু, ওকে আমরা পুষব!

চড়ুইটা বের হতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। লামিয়া অভিমানী মুখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

আমি আজকে তোমার সাথে কথাও বলব না, ভাতও খাব না!

ছুটে ভেতরের ঘরে চলে গেল লামিয়া।

মীরা ভেতরে ঢুকে লামিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বলল, বোকা মেয়ে! ওরা বুঝি এমন বদ্ধ জায়গায় থাকতে পারে?

লামিয়ার কান্না তাতে থামল না। দ্বিগুণ বেগে বইতে লাগল।

মীরা তখন বলল, চলো আমরা একটা পাখির বাসা বানাই!

পাখির বাসা?

কান্না ভুলে লামিয়া তাকিয়ে রইল মীরার দিকে। কীভাবে আম্মু?

আগে চলোই তো, দেখবে!

রান্নাঘরে একটা দইয়ের মাটির হাঁড়ি পড়ে ছিল, সেটা তুলে নিল মীরা। সকালে নাস্তার জন্য ভেঙে রাখা ডিমের খোসা এখনও ফেলে দেওয়া হয়নি, তুলে নিল সেটাও।

বাসার নিচে গ্যারেজে কাঠমিস্ত্রী ফার্নিচার বানাচ্ছে। মীরা লামিয়াকে নিয়ে সেখানে গেল।

কাঠের ফার্নিচার বানানোর পর মসৃণ করার সময় নিচে যে কাঠের খোসাগুলো পড়ে থাকে, আঁচল ভরে সেগুলো কুড়িয়ে আনল মীরা। লামিয়াও আনল তার ছোট্ট দুই হাতে যতটুকু আঁটে।

দইয়ের হাঁড়িতে সেই খোসাগুলো চেপে চেপে বসিয়ে দিল মীরা। দেখতে লাগছে ঠিক যেন খড়।

ডিমের খোসাগুলোর মধ্যে একটার ভাঙা অংশে তুলো গোল করে বসিয়ে সেই তুলোর দুই পাশে আঠা দিয়ে দুটো কালো বোতাম লাগিয়ে দিল মীরা। আর লামিয়ার ছবি আঁকার শক্ত কাগজ থেকে একটা কমলা রঙের কাগজ তিন কোণা আকৃতি করে কেটে সামনে আটকে দিল। দেখতে লাগল ঠিক যেন একটা ডিম ফুটে এই মাত্র একটা পাখির বাচ্চা বেরুচ্ছে।

আরেকটা ডিমের খোসার ভাঙা অংশ নিচের দিকে দিয়ে আস্ত অংশটা সুন্দর করে কাঠের খোসাভর্তি দইয়ের হাঁড়িতে বসিয়ে দিল মীরা।

ব্যস, হয়ে গেল আমাদের পাখির বাসা! এই যে একটা ডিম ফুটে ছানা বেরুচ্ছে, আরেকটা ডিম এখনও ফোটেনি!

লামিয়া আনন্দে হাততালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল।

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা