গল্প - বেগম জাহান আরা
তুষ্ট বাবুর ছাদ বাগান
মা বাবাকে বলে কয়ে ছাদের একটা কোনায় বাগান করেছে তুষ্ট। প্রথম এক বছর শুধু ফুলের গাছই ছিলো। কতোই আর জায়গা! দুই মিটার বাই তিন মিটার। বারোটা টবে চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, কিছু মৌশুমী ফুলের গাছ লাগালো। চমতকার ফুল ফুটেছিলো। তার ছাদ বাগান দেখে সবাই খুশি। উতসাহের চোটে দ্বিতীয় বছরে টবের সংখ্যা বাড়ানোর কথা ভাবছে সে।
মামা ফরহাদ বেড়াতে এসে বললো, তোর তো অনেক জায়গা মামা। একটা আম গাছ লাগা, এক্কেবারে কোনায়।
-সে তো অনেক
বড়ো গাছ মামা। ছাদ ভেঙে পড়বে না?
-কি বলে পাগল? কলমের গাছ লাগাবি। সে গাছ বেশি বড়ো হয় না।
-না মামা, শেষে আমার বাগানের সখটাই বাতিল করে দেবেন বাবা।
-কি যে বলিস!
আজই একটা কাটা ড্রাম কিনে আনবো।
-অতোটুকু ড্রামে
আম গাছ হবে না গো মামা।
-আমি তো করেছি দশটা গাছ। ছাদে না, পেছনের ছোটো বাগানে। সবগুলোই কাটা ড্রামে। এইবছর মুকুলও এসেছে।
-সত্যি মামা? খুশিতে উতসাহে ডগমগ তুষ্ট কাছে এসে মামাকে জড়িয়ে ধরলো।
মামা বলেছেন, তোকে যে গাছ দেবো, তার তিন ডালে তিন রকম আম হবে। শুনে তুষ্ট খুশি হয়েছে। কিন্তু
তার সখ ছিলো বারোমেসে আমগাছের। তাদের বাড়ির পাশেই একটা বারোমেসে আমগাছ আছে। প্রতি তিন, সাড়ে তিন মাস অন্তর তাতে মুকুল আসে। কখনও এপাশে, কখনও ওপাশে, কখনও মাঝ বরাবর। আমও হয়। তবে বেশি না। কাকেই খায়। দারোয়ান
ছাড়া কাউকে দেখা যায় না ওই বাড়িতে। গাছটা দাঁড়িয়ে থাকে এতিমের মতো।
মামাকে গাছটা দেখিয়েছে তুষ্ট। মামা
বললেন, এই গাছটার কলম করে না কেনো কেউ? লক্ষীছাড়া মানুষ আমরা। এমন অমূল্য গাছের কলম করতে পারিনা।
বারোমেসে ফলের গাছ হলো প্রকৃতির দান। বুঝলি মামা। তবে এক গাছে তিন রকম আমের গ্রাফটিং করিয়ে নিয়েছি আমি। মানে, একটা গাছে তিন জাতের আম ধরবে। সেটাও যথেষ্ট ভালো।
-আমার গাছে
কোন কোন আম ধরবে মামা?
-তুই বল।
-আমি, মানে আমি, শুধু ফজলি আম চিনি মামা। হাসে তুষ্ট।
-বিশাল বড়ো
বলে? কে বলবে যে তোর নানার বাড়ি চাঁপাই নবাবগঞ্জে!
-অন্য সব আম তো একই রকম লাগে দেখতে। হাসে তুষ্ট শব্দ করে।
-ওরে আমার
হাঁদা ভাগ্নে! এবার কোন ক্লাসে উঠবি?
-ক্লাস সিক্সে।
-মাশা আল্লাহ!
বড়োই তো হয়ে গেলি রে মামা। কাছে আয় তো দেখি, মাসল কেমন হয়েছে? শক্ত করে মুঠি কর।
এক দৌড়ে তুষ্ট দশ হাত দুরে চলে যায়।
বলে, মামা প্লিজ, প্লিজ, না না---, তোমার
মাসল দেখা মানে তিনদিন ব্যথা থাকবে সেই জায়গায়।
-হা হা হা, ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম। পোস্টবক্সটা ঠিক কর ভাগ্নে।
-তুমি খুব
অসভ্য মামা! লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে প্যাণ্টের জিপ টানে সে।
-হ্যাঁ, দোষ তো আমারই । চল, তাহলে তাসের যাদু শেখাই।
এক দন্ড এক জায়গায় বসে থাকে না মামা।
খুঁজে খুঁজে কাজ কিনে আনে। প্যাকিং কাঠের বাক্স এনে গতোবারে মা-কে কবুতরের খোপ বানিয়ে
দিয়েছে। দুজোড়া কবুতর সেখানে থাকতো। এখন তাদের দুজোড়া বাচ্চা হয়েছে। আবার কিছু একটা
করবে মামা। মাতিয়ে রাখে সবাইকে।
মাত্র দুমাসের মাথায় মামাই সব করে দিলো।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সারি থেকে আমের গাছ
এনে কাটা ড্রামে লাগানো হয়ে গেলো। কলমের গাছ, পরের বছরই দু চারটা
ফল ধরার কথা। দ্বিতীয় বছরে বেশি ধরবে। সখের গাছে ঝাঁকা ঝাঁকা আম তো ধরে না!
তবে সখ মিটে যায়।
-অনেকেই তো
তাহলে এমন গাছ করতে পারে মামা।
-পারেই তো। এতে সবুজও বাড়বে। গাছের প্রতি মানুষের মমতাও
বাড়বে।
-ঠিক বলেছো
মামা।
আমের গাছ যে এতো মিষ্টি হয় দেখতে, তা ভাবেনি তুষ্ট। বাদামি রঙের পাতলা কচি কচি পাতাগুলোর ওপর রোদ
পড়লে কি সুন্দর দেখায়! মনে হয় প্লাস্টিকের পাতা। হালকা বাতাসেই দুলতে থাকে। ছোট্ট গাছ, কয়েকটা সবুজ পাতা, কয়েকটা কচি পাতা, এই গাছে আবার কয়েক মাস পরে আম ধরবে? বিশ্বাস হতে চায়
না।
গাছটায় তিনটে প্রধান ডাল। প্রত্যেক ডালেই কিছু সরু সরু শাখা।
মামা বলেছেন, প্রচুর যত্ন
লাগবে। সার পানি নিড়ানি না হলে গাছ বাড়বে না। তাহলে আগামি বছর ফলও আসবে না। বাবা বলেছেন, তোমার গাছ, তোমাকেই যত্ন নিতে হবে।
প্রথম একমাস খুব যত্ন করলো তুষ্ট। সাথে
ফুলের বাগান তো আছেই। কিন্তু বিকেলে খেলার সময় কমে যায়। উড়ু উড়ু করে মন।দেখা গেলো, কোনদিন তুষ্ট বাগানের দিকেই গেলো না। চৈত্র মাসের কাঠফাটা
রোদে টব এবং ড্রামের মাটি শুকিয়ে যায়। পানি দেয়া হয় না। পরদিনও না। টবের দু একটা গাছ
মরেও গেলো।
হঠাত ফয়সাল মামা এসে হাজির একদিন। তুষ্টের
ছাদ বাগানের অবস্থা দেখে মামা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। মামা নিজে পানি দিয়ে, গাছ ধুয়ে, পাতা ধুয়ে, যত্ন
করে, সার দিয়ে, নিড়ানি দিয়ে, ছিরি ফিরিয়ে আনলেন বাগানের। তুষ্টকে বোঝালেন অনেক। আসলে ছোটো
মানুষ তো! তবে সখ আছে। শিখে যাবে যত্ন নিতে। মামা উতসাহ দিলেন। বলে গেলেন, গাছের যত্ন না নিলে ওদের কষ্ট হয়। ওদেরও প্রান আছে মামা।
ওদেরও খিদে তৃষ্ণা আছে। ওরাও ভালোবাসা বোঝে। লজ্জিত হয় তুষ্ট।
পরের বছর শিশুপানা আমগাছে মুকুল এলো।
কিন্তু তুষ্টের বৃত্তি পরিক্ষা, কোচিং, ছায়ানটের ক্লাস, সবটা মিলিয়ে সময় এমন ভাবে শেষ হয়ে যায়! তবু সময় বের করে তুষ্ট।
গাছে পানি দেয়। ধুয়ে দেয় গাছের পাতা। গুটি
গুটি মুকুলগুলো দেখে বিস্ময়ের শেষ থাকে
না, এগুলোই বড়ো হয়ে আম হবে। একা একাই কথা বলে গাছের সাথে। আদর করে বলে, আমার সোনা গাছ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
স্কুলে কে যেনো বলেছে, গাছ মানুষের কথা বুঝতে পারে। বিশ্বাস করেছে তুষ্ট। তাই
গাছের সাথে নিত্য কথা বলা। এই কেমন আছিস ভাই? পানি খাবি কি না? আমাকে আম দিবি কিন্তু। তোকে যত্ন করি না? ভালোবাসি না? আমাকেও ভালোবাসবি তুই।কেমন ভাই? আমার সোনা গাছটা! তোরা তো সব বুঝিস। এমনি সব কথা।
ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে নিজের নিজের ভাগে
অনেকেই বাগান করেছে। তবু হিংসে হিংসি আছে। মাঝে মাঝে বাগানে ফুল চুরি হয়। কেউ জানে
না, কে করেছে কাজটা। তুষ্টর বুক দুরু দুরু
করে ভয়ে। তার গাছের আম কেউ চুরি করবে না তো! ফুল চুরি মানা যায়। কিন্তু আম চুরি? মানা যাবে না কিছুতেই।
ভয় শুধু একজনকেই। নতুন ভাড়াটের ছেলে
কুবলাই। প্রতিবন্ধী ছেলে। তার বয়সীই হবে। এমনিতে বেশ ভালোই থাকে। হঠাত হঠাত ছাদে গিয়ে
যা তা কাজ করে ফেলে। ওকে দেখা শোনার একজন মানুষ আছে। তার গাফিলতিতেই হয় কাজটা। একদিন তুষ্টর আম গাছের কিছু মুকুল ছিঁড়ে
ফেললো কুবলাই। কেঁদেই বাঁচেনা তুষ্ট। তিনটে শাখার একটাকে নাড়া করে দিয়েছে একেবারে।
সহ্য হয় কি করে?
মা বাবাকে না বলেই তুষ্ট গিয়ে কুবলাইয়ের
মাকে নালিশ দিয়েছিলো। বেচারা মা রেগে মেগে বলেছিলো, আল্লাহ তোকে চোখে দেখেনা রে কুবলা? কি করতে তোকে পাঠিয়েছে দুনিয়ায়? কিছুই বুঝিস না? কি করি বল তো তোকে নিয়ে? কেঁদে ফেলেন মা।
কুবলাই দুর্বোধ্য চাহনিতে তাকিয়ে থাকে
মায়ের দিকে। ওকে দেখলে মনে হয় টেরা। ঠোঁটের দুপাশে পেচকি লেগেই থাকে। মায়ের কান্না
দেখে সেও কাঁদে।
কুবলাইয়ের কান্না দেখে কেনো জানি তুষ্টর
কান্না পেয়ে যায়। একছুটে বাসায় চলে আসে। মাকে বলতেও পারছেনা কিছু তুষ্ট। ভাবছে, কাজটা বোধ হয় ঠিক হয়নি। বাবা মা দুজনেই বলেছেন, কুবলাই হলো ‘স্পেশাল চাইল্ড’। ক্ষমায়
ভালোবাসায় ওদেরকে মানুষ করতে হয়।
একা একাই ঠিক করে, কুবলাইকে তার বাগান সেবার বন্ধু করে নেবে। তাহলে আর ভয়
থাকবে না। আসলে কুবলাই বাগান ভালোবাসে। ভয়ে
কেউ আসতে দেয়না নিজ নিজ বাগানে। তুষ্ট একদিন বাগাবে পানি দেয়ার কাজ দিলো কুবলাইকে।
চমতকার ভাবে কাজটা করলো সে। তারপর থেকে তুষ্টর কাছে চেয়ে চেয়ে বাগানে পানি দেয়ার কাজটা
করতো। ওদের বন্ধুত্ব দেখে দুই পরিবারের মানুষই খুশি।
তুষ্ট আন্টিকে বলেও কুবলাইয়ের জন্যে
দুটো টব কেনালো। দোলনচাঁপার গাছ লাগিয়ে দিলো
তাতে। কুবলাইয়ের খুশি দেখে কে? কুবলাই
আমের গাছ চেয়েছে তুষ্টর কাছে। মামাকে বলে রেখেছে তুষ্ট। আশ্বাস দিয়েছেন মামা। ব্যস, এবার কুবলাইয়েরও আম গাছ হবে। তিনতলার মিসিরও চেয়েছে আমের
গাছ। তাকেও দেবে। মামা বলেন, গাছের
সখ খুব ভালো। মানুষের মন ভালো থাকে।
স্কুলেই প্রথম শুনলো তুষ্ট ‘করোনা’ ভাইরাসের
কথা। তারপর বাসায়। তারপর পাড়ায়। তারপর খবরে। ইটালিতে নাকি মড়ক লেগেছে। দেখতে দেখতে
সারা পৃথিবী ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। স্কুল
বন্ধ হয়ে গেলো। সবারই এক কথা, বাড়িতে
বন্দি হয়ে থাকো। মুখে মাস্ক বাঁধো। বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধোও। দল বেঁধে থেকো
না। উমরা হজ বন্ধ করে দেয়া হলো। মক্কা শরিফে, মদিনা শরিফে নামামের জামাত বন্ধ করে দেয়া হলো। বন্ধ হলো বহু
বিমানের ফ্লাইট। সারা পৃথিবীর ওপর মৃত্যুর
কালো ছায়া। কি রোগ, কেউ জানে
না। কি চিকিতসা, কেউ জানে
না। কবে এই বালা দুর হবে, কেউ জানে না। সারা পৃথিবীসহ বাঙলাদেশের মানুষরাও ভীত আতঙ্কিত।
সবাই সতর্কতা অবলম্বন করছে। রোগটা মানুষ বাহিত। তাই মানুষকে
মানুষের স্পর্শ এড়িয়ে থাকতে বলা যাচ্ছে। অসুস্থ লোকের কাছে যাওয়া যাবে না। মৃত্যুর
পর গোসল হবে না। জানাজায় নাকি কেউ আসবে না। বিদেশে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে কবরে বা বিদ্যুত চুল্লীতে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। চিন্তায়
বড়োদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অসহায় কান্না আলাপ বিলাপ সব দিকে। তুষ্টর মা কাঁদেন আর
বলেন, এ কি বালা দিলে আল্লাহ! রক্ষা করো, ক্ষমা করো
পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে।
গল্পগুলো কুবলাই শুনেছে। বুঝতেও পেরেছে।
মৃত্যু সবাই বোঝে। সে তার মাকে বলেছে, আমি একটা ‘করোনা বোমা’ বানাবো। বাঁচাবো সবাইকে। দেখে নিও।
কুবলাইয়ের কথা শুনে মা হেসে কেঁদে সারা।
কথাটা তুষ্টকেও বলেছে কুবলাই। তুষ্ট বলেছে তার মাকে। মা বলেছেন বাবাকে। বাবা বলেছেন, পাশের বাড়ির প্রতিবেশিকে। একদিনের মধ্যে ফ্ল্যাটের বারোটা
পরিবারের সব্বাই জেনে গেলো, কুবলাই ‘করোনা’ ধ্বংস করার
বোমা বানাবে। কেউ খুশি হলো, কেউ হাসলো।
সবই ভালো। কিন্তু আমগাছের কাছে কুবলাইয়ের
ঘুর ঘুর করাটা তুষ্টর ভালো লাগেনা কিছুতেই।
আমগুলো ডাগর ডাগর হয়েছে। বোঁটার কাছে একটু রঙের আভাস। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে!
সুযোগ বুঝে তুষ্ট একদিন কুবলাইকে দুটো
চকলেট দিয়ে বলে, গাছে আম পাকলে
তোমাকে দুটো দেবো। প্লিজ, আম ছিঁড়ো
না ভাই কেমন? কেবল রঙ ধরেছে।
এই তো আর কিছু দিন, সবুর করো একটু।
কুবলাই বলে, ঠিক তো? আমাকে আম না দিলে কিন্তু গাছ কেটে ফেলবো তুষ্ট। বুকের ভেতর বোমা
ফাটে তুষ্টর। বলে কি ডাকাত! বাগান করে দিয়েছে
তবু বশে আসে না?
হঠাত কুবলাইয়ের অসুখ শোনা গেলো। সর্দি
কাশি জ্বর হয়ে একেবারে শয্যাশায়ী। তুষ্টর মা বললেন, ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে নাকি হাম, পানি বসন্ত, সর্দি জ্বর, হয় প্রায় ঘরে ঘরে। চিন্তার কিছু নেই। মায়ের সাথে তুষ্ট গেলো
কুবলাইকে দেখতে। চোখই খুলতে পারছে না বেচারা। তুষ্টর হাত ধরে বললো, তোমার আম গাছটাই আমাকে দাও না ভাই। আম ধরবে, সবাই খাবো। পাখি খাবে, বেড়াল খাবে, অনেক অনেক আম ধরবে। কি মজা! কি মজা! কেমন করে যেনো কথাগুলো বলে।
মন খারাপ করে তখনই চলে আসে তুষ্ট বাড়িতে।
কি পেয়েছে কুবলাই? তার গাছটাই নিতে হবে ওকে? ওরা বাগান করতে পারে না? রাগে দুঃখে কান্না এসে যায় তার। বন্ধুত্ব রাখা যাবে না
ওর সাথে। কথাও বলবে না, আমও দেবে
না। লোভী একটা। এমন কেনো ও?
তিনদিন পরে শোনা গেলো, কুবলাইকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। খুব বেশি জ্বর। সাথে জবর
সর্দি কাশি। ডাক্তার বলছেন, শক্ত নিউমোনিয়া।
আবোল তাবোল বকছে কুবলাই। আম গাছের কথাটাই স্পষ্ট। অন্য কথা ভালো করে বোঝা যায় না।
পরদিনই শোনা গেলো, কুবলাইকে আইসিইউ-তে নেয়া হয়েছে। অক্সিজেন দেয়া সত্বেও
দম নিতে পারছে না সে। ডাক্তার বলেছেন, ‘কিছু বোঝা
যাচ্ছে না। তবে, করোনা’ ভাইরাসের আক্রমন হতেও পারে।’ বাবা বলেছেন, হাসপাতালে কিট নেই যে পরিক্ষা করবে, কুবলাইয়ের করোনা হয়েছে কিনা? কি একটা অসহায় অপ্রস্তুত অবস্থা!
দুটো আম পেকে গেছে। কালই পেড়ে ফেলতে
হবে। ভেবেছিলো, পরেরগুলো
থেকে কুবলাইকে দেবে। কিন্তু বেচারার অসুখটা কঠিন। ওকেই আগে দেবে একটা আম। তুষ্টর ভারি
মায়া হচ্ছে কুবলাইয়ের জন্য।
রাতে বিছানায় শুয়ে তুষ্ট মুনাজাত করে
কুবলাইয়ের জন্য, ওকে ভালো
করে দাও আল্লাহ। তুমি রাহমানুর রাহিম। ওকে আমি দুটো আম গাছ দেবো। কোনোদিন ঝগড়া করবো
না ওর সাথে। নাহয় আমার আম গাছটা ওকে দিয়েই দেবো। কথাটা উচ্চারণ করতেই চিন চিন করে ওঠে
বুকের ভেতর।
-ও মা তুই? কখন এলি? খুশি হয়ে
বলে, তুই ভালো হয়ে গেছিস ভাই?
-একদম ভালো।
কুবলাই বলে।
-তোর বাগান
দেখেছিস?
-দেখে এলাম।
আমার আম গাছেও তো মুকুল
এসেছে।
-এতো তাড়াতাড়ি? মামা তো কদিন আগেই
লাগালেন গাছ!
-তাতে কি? কত্তো বড়ো হয়ে গেছে গাছ? দেখবি?
-মামাটা এই
রকমই। সব ভালোবাসা তাঁর পরের জন্যে। নিশ্চয় তোকে ভালো গাছ দিয়েছেন। আমার গাছে মুকুল
আসতে দুই বছর লাগলো। তোরটাতে কদিনেই?
-জানিসই তো, আমাকে সব্বাই মায়া করে বেশি বেশি।
-আমিও করতাম।
আর করবো না। তুই যা এখান থেকে। যা যা যা…
-যাই তবে, তোর গাছের আম ছিঁড়ে আনি। হাসতে হাসতে চলে গেলো কুবলাই।
-না কুবলাই, খবরদার না। ভালো হবে না কিন্তু। দাঁড়া, দাঁড়া ভাই, শোন শোন ...
উঠে বসে বিছানায় তুষ্ট। কুবলাই কোথায়
গেলি?
ভোর হয়েছে। নিচে অনেক মানুষের কোলাহল।
কান্নাও শোনা যাচ্ছে। মা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে এলেন।
-কুবলাই কই মা? ঘুমের ঘোর কাটেনি তখনও তুষ্টর। বলে, ওকে ধরো মা…, সব আম ও ছিঁড়ে নেবে বলেছে। ডাকাত, ডাকাত। ও সব পারে।
-কি বলছিস? আমার কথা শোন। মা বলেন।
-দাঁড়াও মা, আগে কুবলাইকে ধরে আনি।
-কি হচ্ছে
তুষ্ট? তুই স্বপ্ন দেখেছিস। তাকা, আমার দিকে তাকা।
-স্পষ্ট দেখেছি
মা। স্বপ্ন না। ডাকাতটা সত্যি আমার আম ছিঁড়ে নেবে আজ।
-না, নেবে না। সবার সঙ্গ ছিঁড়ে চলে গেছে কুবলাই। চল নিচে যাই
বাবা।
-মানে? তুষ্টর ঘুমের ঘোর কেটে গেছে; বলে, কোথায়
গেছে মা?
চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ওঠেন মা।
..........................
ড. বেগম জাহান আরা
সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
সক্রিয় ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক এবং কথা সাহিত্যিক,
প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১২ টা
Comments
Post a Comment