একাত্তরের গণহত্যা - হাসান মোরশেদ
মুক্তিযুদ্ধ : গবেষণা ও অনুসন্ধান
এইখানে শুয়ে আছেন শহীদ অজিত চক্রবর্তী
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে।
শায়েস্তাগঞ্জের কাছাকাছি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার চক্রমনাত গ্রাম। এই গ্রামের সামনে দিয়েই তখন হবিগঞ্জ-বাল্লা রেল লাইন চালু ছিলো। হিন্দুপ্রধান এ গ্রামে প্রায়ই পাকিস্তান আর্মির ছোট ছোট দল এসে হানা দিতো মুলতঃ নারী নির্যাতনের উদ্দেশ্যে।
এদিকে তখনও মুক্তিবাহিনীর সংগঠিত প্রতিরোধ শুরু হয়নি।
পাক আর্মির অত্যাচারে অতিষ্ঠ গ্রামের মানুষেরা- হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন ,যার যা আছে তাই নিয়েই প্রতিরোধ গড়বেন।
এরকম আরেকদিন পাকিস্তান আর্মির কয়েকজন সৈনিক এসে হিন্দু পাড়ায় ঢুকে নারী নির্যাতন করে ফিরে যাবার সময় গ্রামের মানুষেরা লাঠি, শাবল, লাঙ্গল হাতে নিয়ে তাদেরকে তাড়া করেন। গ্রামবাসীর সামনে ছিলেন স্থানীয় সুকড়িপাড়া হাইস্কুলের ছাত্র অজিত চক্রবর্তী। আর্মিরা রেললাইন ধরে দৌড়ে গিয়ে একটা ব্রীজের পাশে পজিশন নিয়ে গুলীবর্ষন শুরু করে। অজিত সহ কয়েকজন ভয় না পেয়ে সামনে এগিয়ে গেলে, অজিত গুলীবিদ্ধ হন।
অজিত লুটিয়ে পড়লে পাকিস্তানীরা পালিয়ে যায়।
সুকরীপাড়া গ্রামের মুরব্বী জহুর আলী জানান, সুকরীপাড়া হাইস্কুলেই অজিত চক্রবর্তী’র সাথে তিনি পড়তেন। সেদিন তিনিও ছিলেন, দেখেছেন নারী নির্যাতন শেষে পাকিস্তানীরা এখানে এসে বিশ্রাম নিয়েছে। তারপর রেললাইন ধরে এগিয়ে গেলে গ্রামবাসী তাদেরকে আক্রমন করেছে, আক্রমন ভাগে ছিলেন অজিত চক্রবর্তী।
সুকরীপাড়া হাইস্কুলের স্যামনে দিয়ে সোজা সড়োক ধরে চক্রমনাত গ্রাম। এই গ্রামের আশুদত্ত বলেন- যুদ্ধের সময় এদিকে পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ ছিলো। মানুষ চলাচল খুব ছিলো। পাকিস্তান আর্মি দুদিন পর পরই এসে হামলা করতো। এর আগে গ্রামের হিন্দু-মুসলমান মুরব্বীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা হবার হবে, আবার এলে এদের প্রতিরোধ করা হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরেকদিন এলে একটা মুসলিম বাড়ি থেকে এদের প্রথম দৌড়ানি দেয়া হয়। তারপর গ্রামের সবাই বেড়িয়ে আসে। রেল লাইন ধরে এদিকে পাকিস্তানীরা আসলে অজিত চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তারাও ধাওয়া করেন। তারাই সবার সামনে ছিলেন। রেলের ব্রীজের কাছে গিয়ে হঠাৎ করে পাকিস্তানীরা বসে পড়ে পজিশন নেয় এবং গুলী বর্ষন শুরু করে।
সবার সামনে থাকায় অজিত গুলীবিদ্ধ হন। তার হাতের নীচ দিয়ে গুলী ঢুকে বের হয়ে যায়।
আশু দত্ত জানান, সাথে সাথে তাকে পানি খাওয়ানো হয়েছিলো, তারপর সুকরীপাড়া স্কুলে রক্তাক্ত অজিতকে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু বাঁচানো যায়নি। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আর্মি আর কোনদিন এই গ্রামে আসেনি।
অজিত চক্রবর্তীর বাড়ি আছে এখনো এই গ্রামে। তাঁর বড় ভাই টগর চক্রবর্তী শুধু বেঁচে আছেন, আর কেউ নেই। বাড়ির অবস্থা হত দরিদ্র।
বৃদ্ধ, অসুস্থ টগর চক্রবর্তী জানান- অজিতের ডাক নাম ছিলো গোপাল। তাদের সবচেয়ে আদরের ছোটভাই। তখন মেট্রিক পরীক্ষার্থী। টগর চক্রবর্তী বলেন, সেদিন তিনি অন্য কোথাও কাজে ছিলেন। খবর পেয়ে বাড়ি আসেন। পাকিস্তানীরা আবার আক্রমন করতে পারে, সেই ভয়ে ধর্ম মতো দাহ করা যায়নি। রাতের অন্ধকারে হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে এক জায়গায় তাকে সমাহিত করেন।
পাকা সড়কের পাশে একটা জংগলের মতো জায়গা। আলাদা করে কোন চিহ্ন নেই, সীমানা নেই, স্মৃতিস্তম্ভ নেই।
শহীদ তালিকায় তাঁর নাম নেই। সরকারী কোন স্বীকৃতি বা ভাতা পায়নি এই শহীদের পরিবার।
স্থানীয় প্রশাসন বা কোন সংগঠন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে কখনো শহীদ অজিত চক্রবর্তীকে মনে করেনি।
হলদারপুরে বিমান আক্রমন, পাকিস্তানীদের নাপাম গ্যাস?
হলদারপুর , হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার একটি ছোট গ্রাম।
এপ্রিল ১৩, ১৯৭১- এই গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি ছমেদ লণ্ডনীর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে পুরো গ্রাম উৎসবমুখর ছিলো। গ্রামের মাঠে লাঠিখেলা হয়েছিলো সেদিন। লাঠিখেলা চলার সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার কিছুক্ষনের জন্য গ্রামের আকাশে চক্কর দেয়। শেরপুর প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষ হয়েছে তখন। গ্রামবাসী তাৎক্ষনিক ভাবে আতংক গ্রস্ত হলেও কিছুক্ষন পর হেলিকপ্টারটি চলে গেলে তারা আবার উৎসবে মেতে উঠেন।
এর পাঁচদিন পর, দুপুরের দিকে হঠাৎ করেই পাকিস্তানী দুটো জঙ্গী বিমান উড়ে আসে। প্রথমে নীচু হয়ে গ্যাস ছাড়ে , পুরো গ্রাম ধোঁয়ায় ভরে যায়- শ্বাসকষ্ট শুরু হয় মানুষের। দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠে, মানুষ গ্রামের পুকুরের ঝাঁপ দেয় আর তখনই ছমেদ লন্ডনীর বাড়ি ও পুকুর লক্ষ্য করে শুরু হয় মেশিনগানের গুলী। বাড়ির উঠোনে শিশুদের মক্তব ছিলো।
গ্যাসে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়া শিশুরা বাড়ির চৌকির নীচে আশ্রয় নেয়, কিন্তু চৌকি ভেদ করে তারা গুলীবিদ্ধ হয়, গুলিবিদ্ধ হয় পানি খেতে গিয়ে, গুলীবিদ্ধ হয় পুকুরে।
সেদিন ১১ জন মারা যান। আহত হন অনেকে।
আহতদের মধ্যে কেউ কেউ পরে অন্ধ হয়ে যান, বেঁচে থাকা কেউ কেউ এজমা সহ নানা ধরনের শ্বাসকষ্টের অসুখে ভুগছেন এখনো।
হলদারপুর গ্রামের মনোহর আলী জানান, তখন তাঁর বয়স ছিলো ১৮ বছরের মতো। গ্যাস ছাড়ার পরই আগুন লেগে গেলে ও শ্বাসকষ্ট শুরু হলে গ্রামের পুকুরে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেকেই কাঁথা গায়ে জড়িয়ে পুকুরে নামেন। তাঁর মা বোন চাচী সহ গ্রামের বহু মানুষ এভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানগুলো পুকুর লক্ষ্য করে গুলীবর্ষন শুরু করে। মনোহর আলীর মা, বোন, চাচী, চাচাতো বোন নিহত হন। তিনি নিজেও হাতে গুলীবিদ্ধ হন। মনোহর আলী তার এক চাচার কথা জানান, যিনি বেঁচে গেলেও পরে অন্ধ হয়ে যান। তাঁরা ধারনা করেন ঐদিনের গ্যাসের প্রতিক্রিয়াতেই এই অন্ধত্ব।
একই গ্রামের তাজুল ইসলামের বয়স তখন সাত বছর থাকলেও সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। বাড়ির বাইরে খেলায় ছিলেন, মক্তবে অন্য বাচ্চারা পড়ছিলো। হঠাৎ ভীষন শব্দ করে আকাশ থেকে নীচু হয়ে নেমে আসে জঙ্গী বিমান, ধোঁয়ায় কালো হয়ে যায় চারদিক। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, একটু পরই ধানের গোলা ও বাড়ির চালে আগুন। মক্তবের বাচ্চারা দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় তাদের বাড়িতে। এরপর বিমানগুলো ফিরে এসে শুরু করে গুলী বর্ষন। গুলীর মধ্যেই তাঁর বাবা দৌড়ে গিয়ে তাকে বাইরে থেকে নিয়ে এসে খাটের নীচে ঢুকান। কিন্তু গুলী কাঠের খাট ভেদ করে বিদ্ধ করে অনেককে। তাঁর সামনেই মাথায় গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা যায় মক্তবের একটা শিশু।
তাজুল ইসলামের মা বয়োবৃদ্ধ। ভীষন রকম শ্বাসকষ্টে ভুগেন, কথা বলতে কষ্ট হয়। তিনি জানান, আগে এই অসুখ ছিলোনা তাঁর। সেদিনের ঘটনার পর গ্রামের অনেকেই শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, কেউ কেউ অন্ধ হয়ে গেছেন। বিয়ে উপলক্ষে তাঁদের বাড়িতে অনেক অতিথি ছিলেন, তাঁর মা ও এসেছিলেন বেড়াতে। গোয়ালঘরে বাঁধা কয়েকটি গরু আগুনে পুড়ে মারা যায়। গুলী বর্ষন শুরু হলে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষদের নিয়ে তারা খাটের নীচে আশ্রয় নেন, মক্তবের বাচ্চারা ও এসে লুকায়। একটা বাচ্চার মাথা দিয়ে গুলী ঢুকে, রক্তের স্রোতে ভেসে যায়। তাঁর মায়ের পায়ে প্রথমে গুলী লাগে, পরে শরীরের অন্যান্য অংশ বিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর মেয়েও গুলীবিদ্ধ হয়। পরে বেঁচে গেলেও তার পা কেটে ফেলতে হয়।
হলদারপুর গ্রামে ঢুকার মুখেই সেদিনের ঘটনার শিকার ১১ জন শহীদের কবর মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতা।
সেই সাথে চিন্তার খোরাক- বর্বর পাকিস্তানীরা কি সেদিন নাপাম গ্যাস ব্যবহার করেছিলো?
পান্ডব গ্রাম ও সতেরো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অরক্ষিত সমাধি
ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর যুদ্ধের পর অক্টোবরের শেষ দিকে ইসলামপুর ইউনিয়নের পান্ডব গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ডিফেন্স গড়ে উঠে। বাঁশতলা সাব-সেক্টরের ‘পাপা’ কোম্পানির ও থার্ড বেঙ্গলের কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এখানে।
পাণ্ডব থেকে দুই কিমি পূর্বে হাদাটিলায় ছিলো পাকিস্তান আর্মির বাংকার। আব্দুল মছব্বির নামে স্থানীয় একজন জানান, এই বাংকারে অনেক বাঙ্গালী নারীদের যৌনদাসী হিসাবে বন্দী করে রেখেছিলো পাকিস্তান আর্মি। স্থানীয় মানুষদেরকে মাঝেমাঝে বাধ্য করতো বাংকারে গিয়ে কাজ করতে। তখন তারা দেখেছেন নগ্ন, অর্ধ নগ্ন বন্দী নারীদের- রক্তাক্ত তারা, চোখে কান্না। কিন্তু অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার ছিলোনা তখন।
বাঙালী নারীদের বন্দীশালায় পরিনত হওয়া হাদাটিলা দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা চেষ্টা করছিলেন আর পাকিস্তানী আর্মি চেষ্টা করছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স ভেঙে দিতে। দুপক্ষ থেকেই থেমে থেমে আক্রমন- পালটা আক্রমন চলছিলো কয়েকদিন ধরে।
যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। নভেম্বর মাসের শেষের সপ্তাহে রাজাকারদের বুদ্ধিতে পাকিস্তান আর্মি প্রতারণার আশ্রয় নেয়। রাজাকাররা ভোরবেলা উত্তরের মুক্ত এক গ্রামের দিক থেকে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে এগুতে থাকে, তাদের পেছনে পেছনে পাকিস্তান আর্মি। মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা ভেবেছিলেন- সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার বাঁশতলা থেকে হয়তো তাদেরই কোন দল আসছে। একেবারে কাছে আসার পর যখন ভুল ভাঙে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। তবু আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করেন।
ডিসেম্বরের ছয় তারিখে ছাতক মুক্ত হলে গ্রামবাসী ফিরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পান। এগুলো ক্ষতবিক্ষত এবং শেয়াল কুকুরের খাবারে পরিনত হয়েছিলো। গ্রামবাসী ১৭/১৮ জনের মৃতদেহ একত্র করতে পারলেও ধারনা করা হয় নিহতের সংখ্যা আরো বেশী ছিলো। পান্ডব গ্রামের বিশিষ্ট মুরব্বী জনাব সুলতান উল্লাহ তার নিজের জায়গায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের ব্যবস্থা করেন পূর্ণ ধর্মীয় মর্যাদায় এবং তার পুত্র আরশ আলীকে নির্দেশ দিয়ে যান, মৃত্যুর পর তাকে ও যেনো শহীদদের পাশে কবর দেয়া হয়।
আরশ আলী জানান পিতার ইচ্ছার মর্যাদা দিয়ে তাঁরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষন করছেন পারিবারিকভাবে। কিন্তু সরকারী ভাবে এখানে কোন স্মৃতিফলক গড়ে উঠেনি বা দেয়াল দিয়ে আলাদা ভাবে চিহ্নিত ও করা হয়নি । যুদ্ধ চলাকালীন সময় আরশ আলী এবং তাঁর ভাই রাজাকারদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
নৈনগাঁও গণহত্যা
দোয়ারাবাজার উপজেলার নৈনগাঁও সুরমা নদীর তীরে একটি গ্রাম- হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বাস।
এ গ্রামের মানুষেরা সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে শুরু করেন।
এ গ্রামের বাসিন্দা রহমত আলী ছিলেন সাবেক বৃটিশ সৈনিক এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা। পরে তিনি ইংল্যান্ড চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করেন।
১৯৭১ এর আগষ্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার ফকির চেয়ারম্যানের প্ররোচনায় ছাতক থেকে দুই লঞ্চ ভর্তি পাকিস্তান আর্মি নদীপথে নৈনগাঁও আসে। এর কয়েকদিন আগের অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা এই গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া গ্যাস পাইপ লাইন উড়িয়ে দিয়েছিলেন গ্রামবাসীর সহযোগীতায়।
পাকিস্তান আর্মি প্রথমে পূর্বদিকের হিন্দু পাড়ার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, এখানে তারা গুলী করে হত্যা করে গজেন্দ্র দাশকে । তারপ রহমত আলীর বাড়িতে এসে তার বাড়িতে ও আগুন দেয়, তার স্ত্রী পুত্র পালিয়ে বাঁচলে ও রহমত আলীকে তারা ধরে ফেলে এবং নৃশংস ভাবে হত্যা করে। তারপর পুরো গ্রাম জুড়ে নারী নির্যাতন ও আগুন জ্বালানো চলতে থাকে।
যারা পালাতে পারেননি তারা মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকারেরা মসজিদের ভেতর থেকে তাদের টেনে বের করে এনে লাইন ধরিয়ে গুলী করে হত্যা করে। ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৯ জন, পরে আরো ৩ জন। পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকারদের ভয়ে নিহতদের দাফন করা ও সম্ভব হয়নি, বেশির ভাগ লাশ ভাসিয়ে দিতে হয়েছে নদীতে।
রহমত আলীর ছেলের মুহিবুর রহমান সহ নৈনগাঁও এর শহীদের সন্তানেরা জানান, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রতিটি পরিবারকে দুই হাজার টাকা এবং সমবেদনা জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর দীর্ঘ বছরে ও শহীদ তালিকায় নৈনগাঁও এর শহীদদের নাম উঠেনি, মিলেনি কোন স্বীকৃতি, গড়ে উঠেনি কোন স্মৃতিসৌধ।
পাঁচগাঁও গণহত্যা ও বেঁচে যাওয়া একজন
মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার একটি হিন্দু প্রধান গ্রাম পাঁচগাঁও। ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী লীলা রায় এর বাড়ি ছিলো এই গ্রামে।
১৯৭১ এর বৈশাখ মাসের একদিনে পাকিস্তান আর্মি এই গ্রাম ঘেরাও করে সব পুরুষদের ধরে নিয়ে আসে গ্রামের দীঘির পাড়ে। তাদের গায়ের কাপড় দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় বেঁধে লাথি দিয়ে ফেলে দেয় দীঘিতে। তারপর মেশিন গানের গুলী। নিহত হন শতাধিক মানুষ।
গুরুতর আহত হন অনেকে। আহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন একজন মাত্র। তাঁর নাম সুবোধ মালাকার। শারীরিক ক্ষত ও বয়সের ভারে ন্যুব্জ সুবোধ মালাকার বর্তমানে শয্যাশায়ী।
এ অবস্থায়ই তিনি জানান- তখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছরের মতো, এক সন্তানের জনক। সেদিন শুক্রবার ছিলো।আলাউদ্দিন চৌধুরী নামের গ্রামের প্রভাবশালী একজন মিলিটারী নিয়ে এসে বলেছে শান্তিকিমিটির মিটিং করবে। গ্রামের সবাইকে নিয়ে বসিয়েছে হীরেনবাবুর পুকুর পাড়ে।
সব মিলিয়ে একশো উনষাট জন। সব পুরুষ মানুষ। বসিয়েছে পশ্চিমদিকে মুখ করে আর মেশিনগান ফিট করেছে পূর্বদিক থেকে। প্রথমে একজন গোঁসাই ঠাকুরকে বলেছে- ধর্ম বদলে ফেলার জন্য- তাহলে পুরস্কার দিবে। উনি বলেছেন- ‘পুরস্কার দিয়ে আর কী করবো? আমাকে মেরে ফেলো।‘
গোঁসাই ঠাকুরকেই প্রথমে হত্যা করেছে।
তারপর গায়ে যার যা কাপড় ছিলো গায়ে , সেগুলো দিয়েই হাত পা বেঁধে ফেলছে জোড়ায় জোড়ায় । তারপর লাত্থি দিয়ে পুকুরে ফেলা শুরু করেছে। পানিতে ফেলেই গুলী শুরু এরপর পুরা গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দেয় তারা। সুবোধ মালাকারের চোয়াল দিয়ে গুলী ঢুকে বের হয়ে গিয়েছিলো।
সুবোধ মালাকারের স্ত্রী সুরঙ্গ মালাকার বলেন- সব পুরুষ মানুষদের পুকুর পাড়ে ধরে নিয়ে যাবার পর, নারীরা শিশুদের নিয়ে গ্রামের বাইরে একটা খালের আড়ালে আশ্রয় নেন, সেখান থেকেই তারা একটানা গুলীর শব্দ ও পুরুষদের আর্তনাদ শুনতে পান। কিন্তু তখন কিছু করার নেই, তারা লুকিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানীরা চলে যাবার পর একজন বেঁচে যাওয়া পুরুষ মানুষে তাঁদেরকে খুঁজে বের করেন এবং আরেক গ্রামে নিয়ে যান। সেই গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম সারংপুর, মুসলমান প্রধান গ্রাম। মুসলমানরা তাঁদেরকে আশ্রয় দেন।
সারং পুর যাওয়ার পর খবর পান, তাঁর স্বামী গুলীবিদ্ধ হয়ে বেঁচে আছেন। কিন্তু তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার মতো কেউ ছিলোনা। তখন ঐ গ্রামের চারজন সাহসী মুসলমান তরুন নৌকা নিয়ে গিয়ে সুবোধ মালাকারকে তুলে নিয়ে আসেন। সুরঙ্গ মালাকার সারংপুর গ্রামের মুসলমানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সুবোধ মালাকারের ক্ষত থেকে ঘা হয়ে পুঁজ পড়তো। অনেকদিন লেগেছে সুস্থ হয়ে উঠতে।
যুদ্ধের পর ভিক্ষা করে তাঁদেরকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো।
Comments
Post a Comment