গল্প - পৃথিকা ইসলাম বৈশালী

যাদের কাছে ঋণী




বৃষ্টি একটা গাছের আড়াল থেকে দেখছে , বড় গাড়িটা এসে মাস্টার বাড়ির সামনে থামলো কয়েকদিন আগে থেকেই শোনা যাচ্ছে, মাস্টার বাড়ির ছেলে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসবে যদিও যুদ্ধের সময় ওরা এখানেই ছিলো তারপর আবার ঢাকা চলে গিয়েছে যুদ্ধের সময় বৃষ্টি বাড়ি থেকে বের হতো তবে মাস্টার বাড়ির যে নাতনি তার সাথে দেখা হয়নি ওরা বোধহয় বেশি সাবধান তাই কাউকে ঘর থেকে বের হতে দিতো না এখন যুদ্ধ শেষ ওরা মনে হয় বের হবে

গাড়িটাকে ঘিরে একটা বড় ভিড় সবাই গাড়ি দেখবে ছোট ছোট বাচ্চারা গাড়িটা ছোঁয়ার চেষ্টা করতে থাকে একজন একটু ছুঁয়ে এসে বন্ধুদেরকে গর্ব নিয়ে গাড়ি ছোঁয়ার কাহিনী বলতে থাকে

বৃষ্টি জানে মাস্টার বাড়ির নাতনি তার সমান বয়সীই তার সমান একটা মেয়ে গাড়িতে করে আসছে তার সামনে বৃষ্টির কেন জানি যেতে ইচ্ছে করলো না তাই বৃষ্টি একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছে

রিয়া গাড়ি থেকে নেমে একটু থতমত খেয়ে গেলো এতো মানুষ কি শুধু তাদেরকে দেখতে এসেছে? রিয়া একটু অবাক হয়ে সবাই কে দেখে কিছু কিছু মহিলা গাছের আড়াল থেকে দেখছে ছোট ছেলে মেয়েরা গাড়ি ছোঁয়ার চেষ্টা করছে রিয়া বুঝতে পারে, গ্রামের এই মানুষ গুলোর কাছে গাড়ি ছুঁয়ে দেখাটাই অনেক বড় ব্যাপার

 ***                  

সাদা বাছুরটা খুব দুষ্টু বৃষ্টি কে ধরাই দিচ্ছে না বৃষ্টির অবশ্য ওর সাথে ছোটাছুটি করতে খুব মজা লাগছে ক্ষেতের মধ্যে প্রতিদিনই বৃষ্টি বাছুরটার সাথে খেলে বাছুরটার নাম সে রেখেছে টুটুশ

টুটুশ আর পালাইস না! বৃষ্টি ক্ষেতের উপর বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে

টুটুশ যেন একটু মজা করার জন্যেই বৃষ্টির একদম সামনে দিয়ে ছুটে গেলো

ঠিক এমন সময়, বৃষ্টি দেখতে পেলো মাস্টার বাড়ির নাতনি ক্ষেতের আল ধরে হাঁটছে বৃষ্টি একটু অস্বস্তি বোধ করতে থাকে

রিয়া হঠাৎ দেখতে পায় তার বয়সী একটা মেয়ে ক্ষেতের উপর বসে আছে রিয়া তার দিকে এগিয়ে যায়

বৃষ্টি বিব্রত হয়ে যায় মেয়েটা তার দিকেই আসছে একটু কাছে এসে সে জিজ্ঞেস করে , এইযে তোমার নাম কি?

বৃষ্টি বললো, আমার নাম বৃষ্টি

এই সময় বলা উচিৎ তোমার নাম কি? কিন্তু বৃষ্টি বোধহয় সেটা জানেনা তাই রিয়া নিজেই বলে উঠলো, বাহ বৃষ্টি কি সুন্দর নাম! আমার নাম রিয়া।

বৃষ্টি কিছু না বলে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

রিয়া আবার বললো, এই গরুটা তোমার?

বৃষ্টি মাথা নাড়লো।

রিয়া বললো, তুমি আমার বন্ধু হবে? এখানে আমার কোনো বন্ধু নেই।

বৃষ্টি বললো, হ্যাঁ হবো।

রিয়া খুশিতে হাততালি দিয়ে বললো, কী মজা এখন থেকে আমরা একসাথে খেলবো!

বৃষ্টি এই প্রথম একটু হাসলো।  তারপর বললো, আমার গরুর সাথে বন্ধু হবানা?

রিয়া উত্তেজিত হয়ে বললো, হ্যাঁ হবো হবো!

বৃষ্টি তখন উঠে রিয়ার হাত ধরে তাকে নিয়ে টুটুশের কাছে নিয়ে গেলো। টুটুশ একটু সন্দেহ নিয়ে দেখলো যে এটা কি তাকে ধরার নতুন কোনো বুদ্ধি? তারপরও পালিয়ে গেলো না।

এর নাম টুটুশ।

টুটুশ! কী মজার নাম!

টুটুশ এদিকে আয়!

টুটুশ রিয়া আর বৃষ্টির দিকে এগিয়ে গেলো।

কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখা গেলো ক্ষেতের মাঝে রিয়া বৃষ্টি আর টুটুশ দৌড়া দৌড়ি করে খেলছে।

***

এই কয়দিনে রিয়া আর বৃষ্টির অনেক ভাব হয়ে গেছে। তারা সারাদিন খেলে , বিকেলে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটে আর গল্প করে। রিয়া অনেক বার বলেছে , এই গ্রামে আমি কেন যে জুতোগুলি নিয়ে এলাম! নরম ধুলায় পা ডুবিয়ে হাঁটার থেকে মজা যেন আর কিছুই না!

বৃষ্টি আর রিয়া অনেক গল্প করে। আজকে বৃষ্টি নিজের বাবার কথা বলছে, আমার বাবা এই করতো সেই করতো... যুদ্ধে যাওয়ার আগে। আবার যখন আসবে তখন আমরা আবার এই করবো সেই করবো...

রিয়া একটু অবাক হয়ে বলে তোমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা?

বৃষ্টি মাথা নাড়ে

যুদ্ধ তো ছয় মাস আগে শেষ? তোমার বাবা এখনো আসেনি?

বৃষ্টি মন খারাপ করে বললো, দেখেছো আমার বাবার কাজ! সেই কবে যুদ্ধ শেষ এখনো এলোনা! তবে আমি জানি আর কিছুদিন পরেই বাবা চলে আসবে।

রিয়ার কাছে হঠাৎ সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো যে বৃষ্টির বাবা যুদ্ধে মারা গিয়েছেনতিনি আর কোনোদিনই ফিরে আসবেন না।

তবু একবার বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,

হ্যাঁ বৃষ্টি তোমার বাবা অবশ্যই ফিরে আসবেন। আর যদি নাও আসেন, দেখো একদিন তোমার আর কষ্ট হবেনা, গর্ব হবে    

***

আজ ১৬ই ডিসেম্বরওদের গ্রামে কয়েকদিন আগে একটা শহীদ মিনার বানানো হয়েছে বৃষ্টি গ্রামের আরো সব বাচ্চাদের সাথে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাচ্ছে। হ্যাঁ, বৃষ্টি এখন জানে যে তার বাবা কোনো দিনই ফিরে আসবেন না তবু সে মন খারাপ করে থাকে না সে জানে তার বাবা আর তার বাবার মতো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই এদেশ স্বাধীন হয়েছে এটা নিয়ে মন খারাপ নয়, গর্ব করা উচিৎ এই দেশ যে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চিরদিনের জন্য ঋণী!

 

 [পৃথিকা ইসলাম বৈশালী, ষষ্ঠ শ্রেণী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ]

 

 

 

 

 

Comments

  1. It's really a wonderful story, Champ. Carry on. May Allah bless you.

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা