গল্প একাত্তর - বাদল সৈয়দ

পরাজয়



বেশ বড়সড় কক্ষটার চারিদিক বেশ অন্ধকার। শুধু মাঝখানটায় তীব্র পাওয়ারের একটা বাল্ব সরাসরি তাঁর নিচের চেয়ারটার উপর পড়েছে।  

অন্ধকার এক কোনায় একটা টেবিল ঘিরে তিনজন মানুষের  ছায়া দেখা যাচ্ছে। তাদের সামনে একটা ইলেক্ট্রিক প্যানেল। মাঝখানে  যিনি বসে আছেন তিনি  কর্নেল সেকান্দার খান। আলোতে গেলে বোঝা যাবে  তিনি একজন অসম্ভব সুদর্শন মানুষ। আজ তাঁর মনটা ও খুব ভাল। খুব ভাল। তিনি আনন্দিত চোখে আলোর নিচে চেয়ারে শুয়ে থাকা যুবকের দিকে তাকালেন। তীব্র আলোয় মানুষটির খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই, কারণ তার চোখের পাতা পিন দিয়ে গেঁথে দেয়া হয়েছে যাতে তা বন্ধ করা না যায়। হাত পা শক্ত করে প্যাড লাগানো রশি দিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধা। তাঁর পেটের উপর দুটো ইস্পাতের মাকড়সা নিরীহ ভঙ্গিতে  বসে আছে।

কর্নেল সেকান্দার চেয়ারে বাঁধা মানুষটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ঘামে ভেজা চকচকে মুখটির দিকে   তাকিয়ে হাসতে হাসতে মৃদু কণ্ঠে আবৃত্তি করতে লাগলেন, 
                " বাগানে ফুটেছে রক্ত গোলাপ  
                  মাতোয়ারা হল বুলবুল সব
                  হে সুরা প্রেমিক, কোথায় তোমরা?
                  চারিদিকে তোল আনন্দ রব।“  
পিনগাঁথা চোখের পাপড়ি নিয়ে মানুষটি তাঁর দিকে বিস্ফোরিত  চোখে তাকিয়ে আছেন, সেখানে রাজ্যের ভয়।
কর্নেল সেকান্দার ফুর্তিবাজ ভঙ্গিতে বললেন " হাফিজ। তোমাকে ‘হাফিজ” শুনালাম। আমার প্রিয় কবি।সকাল থেকে কেবল তাঁর কবিতা মাথায় ঘুড়ছে। কারণ আমার মনটা আজ খুব ভাল। কারণটা তোমাকে বলি, তোমার ও মনটা ভাল হয়ে যাবে। অনেক বছর পর কাল আমার স্ত্রী মা হয়েছেন। তাও আবার আমাদের প্রার্থনা কবুল করে খোদা আমাদের  কন্যা সন্তান দান করেছেন। এই অতি আনন্দের সময়ে আমি তোমাকেও একটা সুখবর দিতে চাই।" বলে তিনি নাটকীয় ভঙ্গিতে থামলেন। রশি বাঁধা শরীরের খোলা ঘোলা চোখগুলোতে বিন্দু বিন্দু আশা ঝিলিক দিয়ে ঊঠল। 
হাসি মুখে কর্নেল বললেন " আমার মেয়ের সম্মানে আমি তোমাকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।" 
পলক না পড়া চোখের মণিতে ঘন আকুতি। কর্নেল সেদিকে তাকিয়ে বললেন "হা, সত্যি তোমাকে ছেড়ে দেব। শুধু তুমি আমাকে ছোট্ট একটা ফেভার কর। খুব ছোট। তারপর মাথা ঝুঁকে অনুচ্চ স্বরে বললেন " তুমি বল, তোমার বন্ধুদের কোথায় পাওয়া যাবে? তোমাদের লিডার কে? যারা গত কয়েকদিন ঢাকাতে বোমা ফাটাচ্ছে। আমাদের সৈনিকদের আচমকা হামলা করে খুন করছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র উড়িয়ে দিচ্ছে। প্লিজ বল।"
তীব্র আলোর নিচে পিনবদ্ধ চোখগুলোতে প্রথম ফুটে উঠলো আশা ভঙ্গের বেদনা, তারপর ভেসে উঠলো  এক ধরনের নির্লিপ্ততা।
কর্নেলের কন্ঠ ঠাণ্ডা, সেখানে কোন রাগ নেই, বিদ্বেষ নেই। তিনি বন্দীর চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা নিজের মনেই বলতে লাগলেন " তুমি খুব সাহসী মানুষ। আমরা তা জানি। আমরা তোমাকে সালাম জানাই। কাল রাত থেকে তুমি থেকে ঠিকে আছ। কিন্তু তোমাকে তো বলতে হবেই। হয় এখন নয় কিছুক্ষন পর। তাহলে এখন নয় কেন? তুমি নিজে ও জানো শেষ পর্যন্ত সবাই বলে। এমনকি যে বন্ধুদের তুমি গোপন  করছ তারা ও এখানে থাকলে বলে দিতো। কেউ শেষ পর্যন্ত ঠিকতে পারেনা। তাহলে দেরি কেন। বলে ফেল। তারপর ঘুমাও। নিরিবিলি একটানা নরম বিছানায় ঘুম। আমি এদেশে পোস্টেড সাত বছর, তাই জানি ঘুমের পর তুমি কি খেতে পছন্দ করবে। গরুর মাংসের সাথে  গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত। টমেটো আর ধনেপাতা দেয়া ঘন ডাল। তার উপর ভাসছে বুক ফাড়া  কাঁচা মরিচ। খাওয়া শেষে  ঘন দুধ দেয়া চা। তারপর বাড়ি।  মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া। তুমি শুনে  অবাক হবে যে আমি যখনি আমার মায়ের কাছে ফিরে যাই  তিনি দাবী  করেন তিনি পরিষ্কার সব  দেখতে পাচ্ছেন। অথচ আমরা  সবাই জানি তিনি অন্ধ। 
চেয়ারে বাঁধা চোখগুলো নির্লিপ্ত। 
কর্নেল  সেকান্দার  হতাশ ভঙ্গিতে হালকা মাথা নাড়লেন টেবিলে বসে থাকা ক্যাপ্টেনের দিকে। সে ঠিক কী  করল বুঝা গেল না, শুধু আবছা দেখা গেল তার ডান হাত ইলেকট্রিক প্যানেলে। 
সাথে সাথে খালি গায়ে বসে থাকা মানুষটির পেটে ইস্পাতের মাকড়সাগুলো নড়েচড়ে উঠলো, তারপর ঠিক নাভির দু’ পাশে কামড়  বসাল।
প্রথম বোঝা  গেল না কী  হচ্ছে। তারপর দেখা গেল চেয়ারে বসে থাকা শরীরটি হেঁচকা টানে অদৃশ্য কেউ যেন উপরের দিকে টানছে, কিন্তু শক্ত বাঁধনের জন্য পারছেনা। তারপর ভেসে আসলো অমানুষিক আর্তনাদ। ভয়াবহ। মানুষটির হা করা মুখটি আওয়াজের মতই ভয়ঙ্কর  দেখাচ্ছে। লাল জিব্বা , আলা জিব্বা সব যেন ছিটকে  বেড়িয়ে  আসবে।
মাত্র  একমিনিট পরেই  মাকড়সাগুলো  নিথর  হয়ে এল।  মানুষটি ও  হাঁপাতে লাগলেন, ঘাম, রক্ত আর চোখের জল সব মিলে  বাদামি তরল হয়ে গড়াতে   লাগলো নিচের দিকে।
কর্নেল সেকান্দার একটু দূরে সরে এলেন।  কেমন যেন  দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। তারপর কিছুটা মন খারাপ করে বললেন " কাজটা কি ঠিক্ হচ্ছে?  বলে ফেললেই হয়। বন্ধুদের সাথে  বেঈমানির কথা ভাবছ?  সেটা তো  তোমার রক্তে আছে। তোমরা দুই ভাই । বাবা ছোট বেলায় মারা গেলেন । তোমাদের মা চেয়েচিন্তে  তোমাদের বড় করলেন। তারপর তোমার বড় ভাই  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে রোডস স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। এখন অনেক বড় চাকুরি করেন। কিন্তু মায়ের খবর নেন  না। তিনি এখনো চেয়েচিন্তে  তোমাকে পড়ান। তোমার ভাই যদি  মায়ের সাথে বেঈমানি করতে পারেন, তুমি  ও  বন্ধুদের সাথে বেইমানী করতে পারবে। পারা উচিত। তাছাড়া লাভ কী এসব করে? পাকিস্তান তো আর মাটির মানচিত্র নয় যে দুই একটা টুসটাস করলেই ভেঙ্গে যাবে। 
অসহায় বেদনার্ত  চোখগুলোতে  কঠিন নীরবতা। তারপর  আস্তে আস্তে ঠোঁটগুলো নড়ে উঠলো। কর্নেল বিপুল উৎসাহে ঝুঁকে এলেন। "গুড,  গুড, এই তো লক্ষী ছেলের মত বলতে শুরু করেছ। কথা দিচ্ছি এখান থেকে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে আর্মি মেসে ডিনার খাওয়াবো" বলতে বলতে তিনি বন্দী যুবকের মুখের কাছে কান নামিয়ে আনলেন, সে কী বলছে  ঠিকমত বোঝা যাচ্ছেনা।তারপর তাঁর  চোখে ফুটে উঠলো বিস্মিত বিহ্বল ভাব। অবাক কণ্ঠে তিনি অনুচ্চ স্বরে বললেন " বাস্টার্ড!!!!!!!! 
তারপর যেন ভ্যাপসা ঘরের দমবন্ধ বাতাসে  প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন "বাস্টার্ড??????? 
পাঞ্জাবের গহীন গ্রামে আমার মা কখনো ঠিকমত সূর্যের আলো দেখেননি, আর তুমি আমাকে বাস্টার্ড বললে"?? তাঁর কথা শেষ হওয়া মাত্রই সঙ্গের তরুণ ক্যাপ্টেন  বন্দীর পেঠে প্রচণ্ড শক্তিতে ঘুষি বসিয়ে দিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই কর্নেল সেকান্দার বাঁশফাটা আওয়াজে তাঁর অধস্তনের গালে থাপ্পড় দিয়ে হিস হিস করে বলে উঠলেন, "স্টপ।  একদম স্টপ। এই ছেলেটি তার কড়ে  আঙ্গুলে যে সাহস   ধারণ করে  তা  তোমার চোদ্দ গুষ্টির  সম্মিলিত সাহসের চাইতে বেশি।"   
বলতে বলতে তিনি  তাঁর   ডান হাতের হাতের বুড়ো আঙ্গুলটি   ইলেকট্রিক প্যানেলের পিছনে বসা লোকটির  দিকে তাক করলেন ।  মুহূর্তের মধ্যে ইস্পাতের কাঁকড়াগুলো  লাফ  দিয়ে উঠল, তারপর তাদের প্রাণহীন ঠোঁটে  দেখা গেল  অসহায় মানুষটির বুকের মাংস কিলবিল করছে।  বিশাল  সমুদ্র গর্জনের মত চিৎকারের সাথে ভূমিকম্পে যেন রুমটি কাঁপছে।
তারপর কেবল মৃদু  গোঙ্গানি, ঘাম এবং রক্তের  আঁশটে গন্ধ।
কর্নেলের মুড ফিরে এসেছে। তিনি তাঁর বন্দীর খুবলে তোলা ক্ষতস্থানে ছোট্ট একটি বোতল থেকে লবন মেশানো গোল মরিচ ঢালতে ঢালতে বললেন " এটা হচ্ছে নির্বোধের সাহস। বেকুবের দেশপ্রেম।" চেয়ারের মানুষটির শব্দ করার  ক্ষমতা  নেই। শুধু তাঁর শরীর মোচড়াচ্ছে। একটু পর তা ও বন্ধ হয়ে  এল। কর্নেল তাঁর  ট্রাউজারে হাত মুছতে মুছতে অন্যদের বললেন "আমাদের বন্ধু কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়েছে। ওকে,  জেন্টেলম্যান, লাঞ্চ ব্রেক।“ 
 
সেদিন কর্নেল সেকান্দার তাঁর  ইউনিটের অফিসারদের সাথে দুপুরের খাবার খেলেন। তাঁর কন্যা সন্তানের জন্ম  উদযাপন উপলক্ষ্যে  মধ্যাহ্ন ভোজ। তার আগে কয়েকটি খাঁচাবন্দী পায়রা মুক্ত করা হল।  তাঁর ধারনা  খাঁচার পাখিদের মুক্তির স্বাদ তার মেয়ের জীবনে  আশীর্বাদ বয়ে  আনবে। খাওয়াটা ও বেশ জমলো। তন্দুরে পোড়া মুরগি, খাসির কষা, বেশি মসলার মাংস, ঘিয়ে ভাজা পরোটা, সালাদ, সবশেষে কফি। তৃপ্তির সাথে খাওয়া  শেষ করে কর্নেল সেকান্দার একটা "ডেভিড অফ" চুরুট ধরালেন তারপরক তাঁর সহকা্রীদের বললেন " চল, দেখি আমাদের বন্ধুর জ্ঞান ফিরেছে কিনা? আমার মনে হচ্ছে এবার সে গান গাইবে। ভালমতই গাইবে, আফটার অল সবার একটা ব্রেকিং পয়েন্ট আছে। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের সাহসী বন্ধু সে পয়েন্টে পৌঁছে গেছে।
আধ খাওয়া চুরুট টানতে টানতে তিনি যখন রুমে পৌঁছালেন সেখানে কেমন যেন  অন্য  রকম গন্ধ। একটু থমকে দাঁড়িয়ে কর্নেল কক্ষের মাঝখানে চেয়ারটির দিকে  তাকালেন। তাঁর চেহারা  হতচকিত  হয়ে উঠলো। তিনি দ্রুত  পায়ে  বন্দী যুবকের কাছে গিয়ে  ঝুঁকে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধিরে সোজা হলেন, তাঁর  দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে দিশেহারা ভাব। তারপর  অনুচ্চ স্বরে  অনেকটা হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল তাঁর  কণ্ঠ,  
“চলে গেল!!!!!!!   কিছুই বলাতে পারলাম না!!!!!!!! কিছুই জানতে পারা গেল না????????? কিছুই না????????
তাঁর চেহারায় আস্তে আস্তে জমতে লাগলো বরফ, তারপর সেখানে দেখা দিল থমথমে লাল  রাগ।
এরপর কর্নেল সেকান্দার "শত্রু শিবিরের মৃত সৈনিক সব সময় বীরের সম্মানে সম্মানিত".... এই সামরিক আপ্ত বাক্যটি ভুলে গিয়ে অসীম সাহসী মানুষটির প্রাণহীন মুখে জলন্ত চুরুটটি ঠেসে ধরলেন।
মাংস পোড়া গন্ধে সবার নাক কুঁচকে আসছে, কিন্তু কর্নেল সেকান্দারের কোন অনুভুতি নেই, শুধু তাঁর  বাদামি চোখের তারায় ফুঠে উঠেছে "পরাজয়".........

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা