গল্প - মাহবুব আজাদ
কুঞ্জরা আর গুঞ্জরা
“কুঞ্জরা একটা ছোট্ট হাতির ছানা...।”
গল্পটা এভাবেই বলতে গেলাম আমার খুঁতখুঁতে ছোট্ট ভাগ্নে
ঘুতুমকে। কিন্তু গল্পের প্রথম চরণ আমার মুখ থেকে মাটিতে পড়ার আগেই সে তার ডান
হাতের তর্জনী তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বাম হাতের তর্জনী তুলে তার চশমাটা নাকের ডগা
থেকে দুই সেন্টিমিটার ঠেলে ওপরে তুললো। এই বয়সেই ঘুতুমের চোখে কেন এমন পেল্লায়
চশমা, আমি জানি না। কিন্তু আশেপাশে যা কিছু ঘটছে, সব কিছুর খুঁতই ঘুতুমের সে চশমার
কাচে ধরা পড়ে। আর তখনই সে তর্জনী তুলে সবকিছু থামিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে।
“ছোট্ট হাতির ছানা, নাকি হাতির ছোট্ট ছানা?” ছোট্ট ঘুতুমের
মুখে এমন প্যাঁচ-কষানো প্রশ্ন শুনে আমার মাথাটাই ঘুরে ওঠে। কিন্তু আমার বয়স চল্লিশ
আর ঘুতুমের বয়স নয়, তাই ভয় পাই না। বলি, “কুঞ্জরার মা-ও বেশ ছোটখাটোই যদিও, কিন্তু
তাকে ছোট্ট হাতি বলা চলে না। তোর কথাই সই, কুঞ্জরা এক হাতির ছোট্ট ছানা।”
এবার ঘুতুমের চশমা স্বস্তির বাষ্পে একটু ঝাপসা হয়ে ওঠে। সে
তর্জনীটা আস্তে আস্তে নামিয়ে আনে।
আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গল্প ধরে সামনে আগাই। “কুঞ্জরা থাকে এক পাহাড়ি জঙ্গলে। সে জঙ্গল এক দেশে শুরু হয়ে আরেক দেশ ফুঁড়ে অন্য দেশে শেষ হয়েছে। সে পাহাড় থেকে তিন নদী বেরিয়ে তিন দেশের তিন সাগরে পড়েছে। কত আজব সব জন্তু সে জঙ্গলে থাকে, নাম বলে শেষ করা যাবে না। কত পাখি, কত পোকা, কত গাছ সে জঙ্গলে...।”
ঘুতুমের চোখ একটু জ্বলজ্বল করে ওঠে, সে ফোঁসফাঁস নিশ্বাস
ফেলে, বলে, “বাঘ আছে, বাঘ?”
আমি বলি, “আরে, বাঘ ছাড়া জঙ্গল হয়?”
ঘুতুম বলে, “সিংহ আছে সিংহ?”
আমি বলি, “সিংহ তো জঙ্গলে থাকে না রে ঘোৎমা। সিংহ হচ্ছে
যাকে বলে ঘাসবনের জন্তু। না, কুঞ্জরার বনে সিংহ নেই। তবে ভালুক আছে, নেকড়ে আছে,
শেয়াল আছে, চিতাবাঘ আছে...।”
ঘুতুম বলে, “ওরা কুঞ্জরাকে খেয়ে ফেলে না?”
আমি বলি, “কী আপদ। তুই কার দলে, কুঞ্জরার না বাঘভালুকের?”
ঘুতুম কিছুক্ষণ চিন্তা করে নেয় জবাব দেওয়ার আগে। তারপর বলে,
“আমি যার গায়ে শক্তি কম, তার দলে। আর... আর... যার মাথায় বুদ্ধি বেশি, তার দলে।”
আমি পড়ে যাই মুশকিলে, কারণ গল্পটা কুঞ্জরাকে হাতির ছোট্ট
ছানা হিসেবে নিয়ে শুরু হলেও আস্তে আস্তে কুঞ্জরা বড় হয়। বড় হাতির গায়ে শক্তি তো
বাঘভালুকের চেয়ে বেশিই হওয়ার কথা। কিন্তু সে হিসাবে ফেঁসে না গিয়ে আমি এবার তর্জনী
তুলি, বলি, “না ঘুতুম, তুই কুঞ্জরার দলে। কুঞ্জরা বোকা হলেও। বোকাদের যদি
বুদ্ধিমানরা দেখে না রাখে, তাহলে কে রাখবে?”
ঘুতুম এবার খুশি হয় প্রশংসা শুনে। সে বলে, “তারপর কুঞ্জরার
কী হলো? ও কী খায়? সারাদিন কী করে?”
আমি মাথা ঝাঁকাই, বলি, “খুবই কাজের কথা তুলেছিস। কুঞ্জরা তো
এখনও ছোট, কিন্তু মায়ের দুধ খাওয়ার বয়স পার হয়ে গেছে। ও কচি ঘাস, কচি কচি পাতা,
কলাগাছ, জংলি লাউ-কুমড়ো, আমকাঁঠাল, মাঝেমধ্যে গাছের ছালবাকল খায়। আর পানি খায়
অনেক।” ঘুতুম তর্জনীটা পুরোপুরি তুলে খুঁত ধরার আগে আমিই নিজেকে শুধরে নিই, “পানি
খায় না, গেলে। একদিন জঙ্গলে কতগুলো মূর্খ লোক চড়ুইভাতি করতে গিয়ে কোকের বোতল আর
চায়ের হাঁড়ি ফেলে রেখে এসেছিলো, কুঞ্জরা সেদিন বোতলটা কুড়িয়ে পেয়ে কোক গিলে
দেখেছে, হাঁড়ি থেকে দুই চুমুক চা-ও পিয়েছে। কোনোটাই ওর ভালো লাগেনি। তবে কুঞ্জরা
চটপটি, চানাচুর আর চিপ্স খুব খায়।”
ঘুতুম এবার ভুরু কোঁচকায়। বলে, “হুম। কুঞ্জরা তো বেশ বোকা
মনে হচ্ছে। কোক তো খুব মজা। আর চা না গিললে ওর সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীর ম্যাজম্যাজ
করে না?”
আমি বলি, “নাহ। হাতির গা রে মামা। ম্যাজম্যাজের সাধ্য নেই
ওর শরীরে ভর করে। আর কুঞ্জরা ঘুম থেকে উঠেই ডন-বৈঠক দেয়, তারপর ওর মা-খালা-নানীর
সাথে দশ মাইল হাঁটে।”
ঘুতুমের কোঁচকানো ভুরু আর সমান হয় না। সে সন্দিহান চোখে
আমাকে মেপে নিয়ে তার স্পাইডারম্যান-আঁকা দুধের লোটায় একটা চুমুক দেয়। বলে, “তারপর
কী হলো? বাঘের সাথে দেখা হলো?”
আমি বলি, “বাঘ? নাহ, বাঘের কি সাহস আছে হাতির পালের কাছে ঘেঁষে?
কুঞ্জরার নানী দু’চারটা বাঘকে একসাথে শুঁড়ে পেঁচিয়ে আছড়ে মেরে পায়ে চেপে ভর্তা করে
দিতে পারে। সব বাঘ ওদের ডরায়। কুঞ্জরা নামটা শুনে বুঝিসনি, হাতির কত ওজন?”
ঘুতুম বলে, “না। কুঞ্জরা মানে কী?”
আমি এবার আমার চশমাটা আঙুলে ঠেলে নাকের ওপর দুই সেন্টিমিটার
তুলি। বলি, “কুঞ্জর মানে হচ্ছে যার পায়ের চাপে মাটি ডেবে যায়। কুঞ্জর মানে হাতি।
পুরনো দিনে কবিদের খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ ছিলো না তো, তাই তারা পশুপাখির এমন নাম
রাখতো। কুঞ্জরা হাতির মেয়ে, তাই তার নামের সাথে একটা আ-কার আছে।”
ঘুতুম বলে, “এইটুকু নামের এত বড় মানে কেন?”
আমি ওকে আশ্বাস দিই, “আরেকটু বড় হলেই বুঝবি। কু মানে মাটি
আর জর মানে ভেঙেচুরে যাওয়া। দুয়ে মিলে কুঞ্জর। তারপর শোন, একদিন কুঞ্জরার সাথে
দেখা হলো গুঞ্জরার।”
এবার ঘুতুম নড়েচড়ে বসে বড় এক চুমুক দুধ খেয়ে নেয়। ওর সাথে
আমার চুক্তি এটাই, গল্প শুনে মজা পেলে বড় এক চুমুক দুধ খেতে হবে। হতভাগাটা বিনা
গল্পে দুধ একেবারে খেতেই চায় না।
“গুঞ্জরা কে?” ঘুতুম শুধায়।
আমি বলি, “গুঞ্জরা একটা ছোট্ট পাখি। ছোট্ট মানে খুবই
ছোট্ট।”
ঘুতুম বলে, “মুরগির চেয়েও ছোট? কাকের চেয়েও ছোট? চড়ুইয়ের
চেয়েও ছোট?”
আমি বলি, “অবশ্যই। অবশ্যই। অবশ্যই।” চড়ুইয়ের চেয়ে ছোট পাখি
ঘুতুম দেখেনি এখনও, তাই টুনটুনির সাথে গুঞ্জরার তুলনা দিলেও ও বুঝবে না। আমি হাত
দিয়ে দেখিয়ে বলি, “এই যে এতটুকু ছোট।”
ঘুতুম এবার সাগ্রহে শুধায়, “গুঞ্জরা মানে কী? ওর পায়ের চাপে
কী ডেবে যায়?” বলে সে নিজেই ভুরু কুঁচকে হিসাব করতে বসে, আর চশমার ওপাশে ওর
চোখদুটো আরও গোল হয়ে ওঠে। কোঁৎ কোঁৎ করে রুদ্ধশ্বাসে লোটার আদ্ধেকটা দুধ সে
গিলে ফেলে সেই হিসাবের উত্তেজনায়।
কিন্তু আমিই তাড়াহুড়ো করে ওকে সেই ভুল পথ থেকে টেনে আনি।
বলি, “না রে ঘুতুম, না, ওভাবে ভাবিস না। গুঞ্জরণ হচ্ছে গুনগুন করা। গুঞ্জরা পাখিটা
এত জলদি ডানা ঝাপটায়, যে ও উড়লেই ভ্রমরের মতো বোঁ-বোঁ শব্দ হয়, তাই গুঞ্জরণ থেকে
ওর নাম গুঞ্জরা।”
ঘুতুম তবু চোখ গোল করে চেয়ে থাকে আমার দিকে। আমি বলি,
“শুনতে একরকম হলেও সবকিছু একরকম নয় রে ঘোৎমা।”
ঘুতুম বলে, “গুঞ্জরা কি হামিংবার্ডের মতো? আমি বইতে পড়েছি
হামিংবার্ড উড়লে বোঁ-বোঁ শব্দ হয়।”
আমি বলি, “হামিংবার্ডকেই বাংলায় গুঞ্জরা বলে। তারপর শোন কী
হলো। কুঞ্জরা আগে কখনও গুঞ্জরাকে দেখেনি। পালের সাথে চলতে চলতে ও এদিক-সেদিক দেখছিলো,
হঠাৎ দেখে গুঞ্জরা এক ফুল থেকে কিছুক্ষণ মধু খেয়ে আরেক ফুলের দিকে বোঁ-বোঁ করে উড়ে
চলে যাচ্ছে। কুঞ্জরা ভাবলো, এটা বুঝি মস্ত বড় কোনো মৌমাছি। ও তখন ডেকে ছড়া কেটে
বললো, “মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই?” তখন গুঞ্জরা মধু
খাওয়া থামিয়ে কুঞ্জরার কানের কাছে এসে চেঁচিয়ে বললো, “আমি মৌমাছি নই, আমি গুঞ্জরা!
তোমার চশমা কোথায়?”
ঘুতুম শুধায়, “কুঞ্জরাও চশমা পরে?”
আমি বলি, “না রে। হাতিরা চশমা পরতে পারে না। কানগুলো লটপট
করে এদিক-সেদিক নড়ে তো। কান নাড়ালেই তো চশমা নাক থেকে মাটিতে পড়ে যাবে। শোন তারপর...
কুঞ্জরা তখন ভয় পেয়ে বললো, “আমার তো চশমা নেই।” গুঞ্জরা তখন বললো, “বটে? দাঁড়াও
পরীক্ষা করে দেখি।” তারপর কিছুক্ষণ কুঞ্জরার এক চোখ থেকে আরেক চোখ অব্দি উড়ে উড়ে
ঠোঁট দিয়ে চোখের পাতা টেনেটুনে পরীক্ষা করে দেখে খানিক দূরে উড়ে গিয়ে ঠায় এক
জায়গায় ভেসে উড়তে উড়তে একটা ঠ্যাং বাড়িয়ে ধরে শুধালো, “বলো তো আমার পায়ে কয়টা
আঙুল?””
ঘুতুম বললো, “আমাকে ডাক্তার দেয়ালে ঝোলানো একটা বোর্ডে
ই-এফ-কে-জে পড়তে দিয়েছিলো।”
আমি বললাম, “গুঞ্জরার ঐ বোর্ডটা চুরি হয়ে গেছে রে। নইলে ও
নিশ্চয়ই কুঞ্জরাকে বোর্ড থেকে ই-এফ-কে-জে পড়তে দিতো। যা-ই হোক... কুঞ্জরা বললো,
“সাতটা।” অমনি গুঞ্জরা মাথা নেড়ে ইয়া বড় জিভ বের করে বললো, “নাহ, তোমার চোখ নষ্ট।
তোমাকে বেশি করে ভিটামিন এ খেতে হবে। এখন থেকে বেশি বেশি গাজর আর লালশাক খাবে।
চটপটি-চানাচুর-চিপ্স এসব একদম বাদ। আগামী বছর আবার এ তল্লাটে ফুলের মধু খেতে আসবো,
তখন আবার তোমার চোখ দেখে যাবো।” তারপর একটা কলাপাতায় ঠোঁট দিয়ে গুঁতিয়ে ওষুধপত্র
লিখে দিয়ে গুঞ্জরা আবার বোঁ-বোঁ করে উড়ে চলে গেলো।”
ঘুতুম চোখ গোল করে চেয়ে থেকে বললো, “ফুলের মধু কি খায় নাকি
গেলে?”
আমি বললাম, “ফুলের মধু তো ঘন জিনিস, সেটা গেলা কঠিন।
গুঞ্জরা যেটা করে, জিভ দিয়ে ফুলের ভেতর থেকে মধুটাকে চেটে নেয়। যা-ই হোক, কুঞ্জরা
তো চোখ নষ্ট হওয়ার কথা শুনে সারাদিন হাউমাউ করে কেঁদে-কেটে অস্থির। ওর মা বলে, “হায়
হায় তুই তো চশমাও পরতে পারবি না, নইলে চশমী হনুমানের দোকান থেকে তোকে একটা চশমা
কিনে দিতাম।” ওর খালা বলে, “বেশি করে গাজর আর লালশাক খা কুঞ্জরা, নইলে তো একদম
কানা হয়ে যাবি।” ওর নানী বলে, “ভোঁওওওওও কুঞ্জরা এখন থেকে চটপটি-চানাচুর-চিপ্স
একদম বাদ ভোঁওওওওও...।””
ঘুতুম বললো, “হাতি কি ভোঁওওওও করে ডাকে?”
আমি বললাম, “হুঁ, একদম ট্রাকের ভেঁপুর মতো। যা-ই হোক,
কুঞ্জরা সেদিনের পর থেকে চটপটি-চানাচুর-চিপ্স সব বাদ দিয়ে খুব মন দিয়ে গাজর,
মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে, লালশাক, মলা মাছ, ঢ্যালা মাছ এসব পুষ্টিকর খাবার খেতে লাগলো।”
ঘুতুম বললো, “তারপর ওর চোখ ভালো হয়ে গেলো?”
আমি বললাম, “হয়ে যেতো। কিন্তু কয়েক মাস পর জঙ্গলের আরেক
মাথায় আরেকটা পালের সাথে কুঞ্জরার ফুপাতো বোন হস্তিমি একদিন বেড়াতে এসে দেখে
কুঞ্জরা সব ফেলে চুপচাপ লালশাক খাচ্ছে। হস্তিমি তাই দেখে অনেক হাহাহিহি করলো,
বললো, “দ্যাখো দ্যাখো কুঞ্জরা কী বোকা, চটপটি-চানাচুর-চিপ্স ফেলে ও লালশাক খাচ্ছে!
কী খ্যাত রে বাবা! ভোঁওওওও!” তখন কুঞ্জরা লজ্জা পেয়ে বললো, “না না, আমি তো সবসময়
চটপটি-চানাচুর-চিপ্স খাই।” এই বলে সে গুঞ্জরার বাৎলানো ওষুধ লেখা কলাপাতাটা ছিঁড়ে
ফেলে দিয়ে আবার হাবিজাবি খাওয়া শুরু করলো।”
ঘুতুম বললো, “তারপর?”
আমি বললাম, “পরের বছর কুঞ্জরা একদিন পালের সাথে হাঁটতে
হাঁটতে চানাচুর খাচ্ছিলো, তখন হঠাৎ সে শুনতে পেলো সেই বোঁ-বোঁ শব্দ। গুঞ্জরা আবার
এসে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে উড়ে মধু খাচ্ছে। কুঞ্জরার তো চোখ দুটো একে ছোটো
ছোটো, তার ওপর আবার একটু নষ্ট, সে ভাবলো, ভীমরুল বুঝি এসেছে হুল ফোটাতে। সে
চেঁচিয়ে কানদুটো ঝাপটাতে ঝাপটাতে বললো, “ওরে ভীমরুলে, আমি তুলতুলে, জ্বালিও না হুলে!”
তখন গুঞ্জরা মধু খাওয়া থামিয়ে উড়ে এসে বললো, “আমি ভীমরুল নই, গুঞ্জরা। গাজর-লালশাক
খেতে বলেছিলাম, খাওনি, তাই না? আর এটা কী খাচ্ছো, চানাচুর?” কুঞ্জরা তো লজ্জায়
গুটিসুটি। গুঞ্জরা তখন এক জায়গায় ঠায় ভেসে উড়তে উড়তে তার আরেক ঠ্যাং বাগিয়ে বললো, “বলো
তো আমার আরেক পায়ে কয়টা আঙুল?” কুঞ্জরা তখন ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে বললো, “বাইশটা?””
ঘুতুম বললো, “কুঞ্জরার চোখ কি আরও খারাপ হয়ে গেছে?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। গুঞ্জরা তখন আবার আরেকটা কলাপাতায় ওষুধপত্র
লিখে দিয়ে বললো, “পরের বছর আবার আসছি, তার আগে খুব করে ঠেসে গাজর আর লালশাক খাও।
নাহলে চোখ তো যাবেই, ওজন বেড়ে গিয়ে আরও অসুখবিসুখ হবে।””
ঘুতুম বললো, “তারপর?”
আমি বললাম, “তারপর আগের বছর যেমন হয়েছিলো, তেমনটাই হলো।
কুঞ্জরা কিছুদিন খুব করে গাজর লালশাক খেলো, কিন্তু যেই না হস্তিমি বেড়াতে এসে ওকে
লালশাক খেতে দেখে হাসাহাসি করলো, অমনি সে আবার বখে গিয়ে চটপটি-চানাচুর-চিপ্সে মজে
গেলো। তার পরের বছর গুঞ্জরা যখন মধু খেতে এলো, কুঞ্জরা তখন বোঁ-বোঁ শব্দ শুনে
ভাবলো, দূরে হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। সে তখন হেঁকে উঠলো, “হেলিকপ্টার হেলিকপ্টার,
উড়ে কোথায় গেলিকপ্টার? কোন বনে কোন কোণে ঐ পাখা পেলিকপ্টার?” গুঞ্জরা তখন মধু
খাওয়া থামিয়ে উড়ে এসে কুঞ্জরার কানের ওপর বসে বললো, “আমি হেলিকপ্টার নই, গুঞ্জরা।
চোখদুটো তো একেবারেই গেছে তোমার। বলো দেখি আমার এ ডানায় কয়টা পালক?””
ঘুতুম বললো, “কুঞ্জরার চোখ আরও খারাপ হয়ে গেলো?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ রে। শুধু যদি হস্তিমির কথা কানে না তুলে
গাজরটা একটু বেশি করে খেতো। আর লালশাক। যা-ই হোক, কুঞ্জরা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে
বললো, “তিনটা?” গুঞ্জরা তখন আবার কলাপাতায় ওষুধপত্র লিখে দিয়ে বললো, “আগামী বছর
দেখা হবে কুঞ্জরা। আমি তোমায় দেখতে পাবো, কিন্তু তুমি আমায় দেখবে কি না, সেটা বলা
মুশকিল।”
ঘুতুম বললো, “কুঞ্জরা কেন হস্তিমির কথা শুনে
চটপটি-চানাচুর-চিপ্স খায়?”
আমি বললাম, “কুঞ্জরা নিজের ভালোর চেয়ে অন্যের খোঁটাকে বেশি
দাম দেয় রে ঘোৎমা। শোন তারপর কী হলো, সে বছরও কুঞ্জরা কিছুদিন লালশাক-কচুশাক খেয়ে
কাটিয়ে তারপর যে-ই কে সে-ই, হস্তিমির খোঁটা শুনে সব ভুলে চটপটি-চানাচুর-চিপ্স খেয়ে
একেবারে কানা হয়ে গেলো। এমনই অবস্থা, যে অন্যের লেজ শুঁড় দিয়ে ধরে তারপর ওকে চলতে
ফিরতে হয়। কখনও মার লেজ, কখনও খালার লেজ, কখনও নানীর লেজ ধরে বেচারাকে চলতে হয়।
কখনও গর্তে পড়ে বেচারা পায়ে চোট পায়, কখনও কাঁটাগাছে ঘষা লেগে চামড়া ছড়ে যায়।
ওদিকে হস্তিমির লেজ ধরতে গেলে হস্তিমি খুব বিরক্ত হয়ে, বলে, “য়্যাই কুঞ্জরা,
খবরদার আমার লেজ ধরবে না, লেজের বিনুনি আলগা হয়ে যাবে। তুমি এত খ্যাত কেন?””
ঘুতুম লোটার বাকিটা দুধ এক চুমুকে প্রায় শেষ করে ফেলে, বলে,
“হস্তিমিটা একটা কুটনি শয়তান।”
আমি বলি, “হ্যাঁ রে। কিন্তু কুঞ্জরা বোকা, তাই ওর কথার দাম
দেয়। যা-ই হোক, পরের বছর কুঞ্জরা দলছুট হয়ে একটা গাছের নিচে বসে চিপ্স
খাচ্ছিলো...।”
ঘুতুম বললো, “দলছুট কেন? ওকে ওর মা তাড়িয়ে দিলো?”
আমি বললাম, “না রে। হাতিরা কখনও মেয়ে বাচ্চাকে তাড়িয়ে দেয়
না। ছেলেগুলোকে দেয় অবশ্য। কুঞ্জরার তো একটাই শুঁড়, ওটা দিয়েই চিপ্সের ঠোঙা থেকে
চিপ্স বের করে মুখে পোরে, আবার ওটা দিয়েই মা-খালা-নানীর লেজ আঁকড়ে পথ চলে। কিন্তু
চিপ্স খেতে গেলে লেজ ছাড়তে হয়। তাই ও যতক্ষণ চিপ্স খায়, দলের বাকিরা এদিক-সেদিক
হাঁটাহাঁটি করে। শোন কী হলো... একটা বোঁ-বোঁ শব্দ হলো খুব আস্তে, কুঞ্জরা সেটা
শুনে ভাবলো, হয়তো দূরে পাণ্ডা বাঁশি বাজাচ্ছে...।”
ঘুতুম বললো, “পাণ্ডা বাঁশি বাজায়?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ রে। পাণ্ডা বাঁশ ছাড়া কিচ্ছু চেনে না।
সারাদিন বাঁশ নিয়েই মশগুল, মাঝেমধ্যে সেটায় ফুঁ দিয়ে সুর তোলে। খুব ভালো বাজায়,
সেটা বলা যাবে না। পাণ্ডার বাঁশির আসরে টিকেট খুব একটা বিক্রি হয় না, কিন্তু
হাতিদের কানগুলো বড় বলে ওরা দূর থেকেই সেটা শুনতে পায়। কুঞ্জরা তখন হেঁকে বললো,
“পাণ্ডা আমার পাণ্ডা, কী বাজাইলি গানডা, শুইন্যা আমার জানডা, আইসকিরিমের ঠাণ্ডা!”
গুঞ্জরা তখন কুঞ্জরার কানের কাছে বসে গুনগুন করে বললো, “কুঞ্জরা আমি পাণ্ডা নই,
গুঞ্জরা।” কুঞ্জরা তখন ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে কিছু না দেখেই বললো, “তোমার অন্য ডানায়
এগারোটা পালক!””
ঘুতুম বললো, “কুঞ্জরা কেন আন্দাজে ভুলভাল উত্তর দেয়? ও যে
দেখতে পায় না, সেটা বললেই তো পারে!”
আমি বললাম, “সেটা বললেই ভালো, কিন্তু কুঞ্জরা বোকা বলে
ভাবে, “পারি না” বললে লোকে লজ্জা দেবে। যা-ই হোক, গুঞ্জরা তখন বললো, “কুঞ্জরা, আমি
যে ফুলের মধু খাই, সেটা এই বনে আর ফুটছে না। আশেপাশে কোথাও পেলাম না। তিনদিন ধরে
আমি কিচ্ছু খাইনি।” কুঞ্জরা তখন চমকে উঠে বললো, “সে কী? তোমাকে কচি ঘাস এনে দিই?
কিছু পাতা? একটা কলাগাছ? তুমি কি কুমড়া খাও? দুটো কাঁঠাল? বটফল পেড়ে দিলে খেতে
পারবে?” গুঞ্জরা মাথা নেড়ে বললো, “না। আমি শুধু মধু খাই। মধুতেই আমার সব ভিটামিন
আর খনিজ। মধুতেই আমার সব শর্করা আর আমিষ। মধুর বাইরে জীবনে ভুল করে একবার একটু কোক
খেয়েছিলাম, আর একটু চা... ওয়াক থু!” কুঞ্জরা তখন বললো, “আচ্ছা তুমি এখানে একটু
বোসো, আমি আসছি।” এই বলে সে ভোঁওওওও করে চেঁচাতে চেঁচাতে “মা কোথায়, খালা কোথায়,
নানী কোথায়” বলে পালের সবাইকে ডেকে জড়ো করলো। মাকে সে বললো, “একটু মধু আনো”, খালাকে
বললো, “একটা লাউয়ের খোল আনো”, নানীকে সে বললো, “একটু পানি আনো।” কুঞ্জরার মা তখন
মৌমাছির রাণীকে বলে চাক থেকে এক চিমটি মধু নিয়ে এলো...।”
ঘুতুম বললো, “হাতি কীভাবে চিমটি দেয়?”
আমি বললাম, “শুঁড় দিয়ে। হাতির শুঁড়ে ডগাটা দুটো আঙুলের মতো,
বড় হয়ে কাছ থেকে দেখিস। যা বলছিলাম, কুঞ্জরার খালা একটা লাউ পেড়ে সেটার শাঁস
শোঁ-শোঁ করে টেনে খেয়ে ফাঁপা খোলটা নিয়ে এলো, আর কুঞ্জরার নানী ঝর্ণা থেকে তুলে
আনলো পানি। কুঞ্জরা খালার কাছ থেকে খোলটা নিয়ে মাকে বললো, “এর মধ্যে মধু ঢালো”, আর
নানীকে বললো, “এর মধ্যে পানি ঢালো।” তারপর শুঁড় দিয়ে খোলের মুখটা ঢেকে সেটাকে
ভালোমতো ঝাঁকিয়ে সে নিয়ে গেলো গুঞ্জরার কাছে। গুঞ্জরা বেচারা একদম হয়রান হয়ে চুপ
করে ডালে বসেছিলো, মধুর গন্ধ পেয়ে সে পড়িমড়ি করে উড়ে এসে লাউয়ের খোলটা থেকে চুকচুক
করে সারাদিন ধরে মধুর শরবৎ খেয়ে চাঙা হয়ে উঠলো। চলে যাওয়ার আগে সে কুঞ্জরাকে বলে
গেলো, “আহ কুঞ্জরা, তুমি বড় ভালো!” কুঞ্জরা বললো, “আবার এসো, গুঞ্জরা। যদি ফুল না
ফোটে, তবুও।”
ঘুতুম বললো, “তারপর?”
আমি বললাম, “তারপর তো জানি না রে। তোর কী মনে হয়, গুঞ্জরা
আবার আসবে কুঞ্জরার কাছে? ফুল না ফুটলেও?”
ঘুতুম লোটার বাকি দুধটুকু খেয়ে শেষ করে বললো, “হ্যাঁ।
কুঞ্জরা ওকে খেতে দেবে তো, তাই না?”
ঘুতুমের দুধের সাথে আমার গল্পও শেষ, আমি উঠে পড়ে বললাম,
“হ্যাঁ রে। বড়রা যদি ছোট্টদের দেখে না রাখে, তাহলে দুনিয়াটা চলবে কী করে?”
মাহবুব আজাদ
ডিসেম্বর ৩, ২০২০
Comments
Post a Comment