গল্প - ইমতিয়ার শামীম

নদীরা কেন সমুদ্রে যায়


 


নদীরা কেন সমুদ্রে যায়?

এই গল্প অনেক আগের। এত আগের যে গল্পটা সবাই একদমই ভুলে গেছে। আমারও তা মনে নেই ভালো করে।

তবে এইটা জানি, পৃথিবীতে তখন কোনও নদী ছিল না।

তা হলে কেমন ছিল সেই পৃথিবী?

চিন্তা করতেই গা ছমছম করে ওঠে! নদী নেই মানে কোনও পানি নেই। নদী নেই মানে বৃষ্টি নেই, বর্ষা নেই, বন্যাও নেই। নেই কোনও ছোট্ট ডোবা। অনেক গর্ত আছে, খানাখন্দ আছে; কিন্তু একরত্তি পানি নেই তার ভেতর। ডোবাকে তাই কেউ ডোবা বলে না। নদী নেই বলে বানের টানে পানি এসে জমে না তার বুকের ওপর। আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এসে ঘুমিয়ে পড়ে না ডোবার কোলে।


এমনকি সমুদ্রও তখন ছিল না কোথাও।

তা হলে কী ছিল তখন?

ছিল তখন কেবলই অন্ধকার। ঘুটঘুটে কালো তীব্র অন্ধকার। আর ছিল সূর্য। তবে সে ছিল এখন যেখানে দেখো, সেখানকার চেয়েও অনেক অনেক দূরে। এত দূরে যে দেখাই যেত না তাকে। অবশ্য পৃথিবীতেও তখন এমন কেউ ছিল না যে সেই অন্ধকারের মধ্যে আতিপাতি করে সূর্যকে খুঁজে বেড়াবে।

তবে কোনও কোনও সময় সূর্যই মনে করত, যাই না কেন ওই অন্ধকারে! দেখি না কী আছে অন্ধকারে!

কিন্তু তা কি আর এতই সোজা? এতই কি সহজ অন্ধকারে কী আছে তা দেখা? অন্ধকারের তখন ভীষণ দাপট। এতই দাপট যে সূর্য কখনও একটু আলো ফেলার চেষ্টা করলেই অন্ধকার জোরে জোরে ঘন ঘন থাবা বসায়। অন্ধকারের সেই ঘন থাবা কী যে ভারি আর কী যে বড়সড়! সেই থাবায় আটকে হাসফাস করা সূর্যকে মনে হতো এক বিন্দু বালুর মতো। অন্ধকারের থাবায় সূর্য মুহূর্তের মধ্যে আতংকে নীল হয়ে যেত।

সূর্যকে আসতে দেয় না,তাই আলো থাকে না, তাপও থাকে না একরত্তি। অন্ধকারের মাঝেমধ্যেই তাই শীত-শীত লাগে। কিন্তু দেমাগের চোটে সে সূর্য থেকে দূরে থাকে। সূর্যের একরত্তি আলো দেখলেই থাবা বসিয়ে নীল করে দেয়। অনেক দূরের বিন্দুর মতো সূর্যকে সিন্ধু সিন্ধু অন্ধকার দিয়ে ঢেকে রাখে। তাপ নেয় না এতটুকু। তাই অন্ধকারের গায়ে জমা হতে লাগল ঠাণ্ডা আর ঠাণ্ডা

 শীত আর ঠাণ্ডায় জমতে জমতে অন্ধকারটা ধীরে ধীরে কাতর আর কাহিল হতে লাগল। তারপর একেবারে শক্ত কাঠ হয়ে গেল একদিন।

দিন যায়... না কি কেবল রাতই যায় সেই সময়...

শীতের চোটে অন্ধকার আর না পারে নড়তে, না পারে চড়তে। না পারে বসতে, না পারে দাঁড়াতে। এমনকি শুয়ে থাকতেও পারে না ভাল করে।

অন্ধকারের গায়ের ওপর ঠাণ্ডার চোটে ধোঁয়া-ধোঁয়া বরফের আস্তরণ পড়তে লাগল। বরফ জমতে জমতে একসময় তার গা শাদা ধবধবে হয়ে গেল। কিন্তু অন্ধকারটা এতই হিমকঠিন কাঠবরফ হয়ে গিয়েছিল যে নড়বার মতো শক্তিও ছিল না। ছিল না উঠে দাঁড়িয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে বরফ ঝেড়ে ফেলবার জোর।

ওদিকে অনেক দূরের সূর্য একদিন হঠাৎ অন্ধকারের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। সে দেখল, একরত্তি অন্ধকারও দেখা যাচ্ছে না কোনওখানে। ধবল রঙের কী যেন ছড়িয়েছিটিয়ে আছে সারা পৃথিবী জুড়ে। বুঝতে পারল সে, অহংকারী অন্ধকার ঠাণ্ডায় জমে গেছে।

সূর্য তাই সাহস করে দূর থেকে এগিয়ে আসে। একপা এগোয় তো দুই পা পিছিয়ে যায়। আবারও একপা এগোয়। এই করতে করতে শেষমেষ অন্ধকারের সামনে এসে দাঁড়ায়।

শাদা, ধবধবে অন্ধকার! অদ্ভূত, কেমন দেখাচ্ছে! সূর্য সাহস করে অন্ধকারের লম্বা আর শক্ত কাঠবরফ গায়ের ওপর আলোর হুল ফোটায় একটু একটু করে। তারপরই সরে আসে। ভয় হয়, এখনই বোধহয় অন্ধকার আবার জেগে উঠবে। রেগেমেগে ভারি আর বড়সড় থাবা বসাবে তার গায়ের ওপর। বরফ পড়তে পড়তে তা এতই হিমশীতল হয়ে আছে যে, সূর্যের তাপে সেটার কিছুই হবে না। বরং ঠাণ্ডায় হয়তো সূর্যই খানিকটা আলো আর তাপ হারাবে।

কিন্তু অন্ধকার তখন পড়ে আছে বেহুশ হয়ে। খুব মায়া হয় সূর্যের। অন্ধকারকে জাগানোর জন্যে তার গায়ে জোরে ধাক্কা মারে সে।

প্রথমে মনে হয়, বরফ হয়ে যাওয়া অন্ধকারের কোনও কিছু হয়নি। কোনও নড়াচড়া নেই, একটু বরফও গলছে না। বিস্ময়ে সূর্য অন্ধকারের একেবারে কাছে চলে যায়। ভয়ও লাগে। কে জানে, এখনই থাবা বাড়িয়ে দেবে না কি!

কিন্তু না, অন্ধকার কিছুই করে না। সূর্য তখন ভয়ে ভয়ে তাপ ছড়াতে থাকে। এইবার অন্ধকার একটু নড়ে ওঠে মনে হয়। ভয়ে সূর্য কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। আবারও আলো আর তাপ ছড়াতে থাকে।

এইবার অন্ধকারের কাঠবরফ শরীর গলে কলকলিয়ে প্রচ- জোরে জলের স্রোত বেরিয়ে আসে। পৃথিবীর চার ভাগের প্রায় তিন ভাগ জুড়ে তা সমুদ্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যের তাপ শুষে সেই স্রোত টগবগিয়ে ওঠে। জলের স্রোতের চূড়ায় লেগে থাকে বরফের মতো শাদা-শাদা ফেণা। টগবগ করতে করতে জলের সেই ক্ষিপ্ত তরঙ্গ লাফিয়ে ওঠে সূর্যের দিকে। মনে হয় গিলে খাবে সূর্যটাকেই।

এ তো দেখি ভয়ানক বেয়ারা! সূর্য খানিকটা দূরে সরে যায়। ঠিক করে সে, অন্ধকারকে না পারুক, এটাকে বাগে আনতেই হবে। সে তাই তাপ ছড়িয়ে সমুদ্রের জল শুষতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই আর বাগে আনা যায় না সেটাকে।। বরং সমুদ্রের ভেতরে জমা তাপও একটু একটু করে কমতে থাকে। তাপ হারাতে হারাতে সূর্যের শক্তিও কমতে থাকে। সূর্য তখন তাপ ছড়ানো বন্ধ করে হাপাতে থাকে।

তাপ নেই, তাই একবিন্দু সমুদ্রের জলও শুকায় না। অন্ধকারের কাঠবরফ গায়ের কোনও কোনও জায়গা গলবার জন্যে সূর্যের দিকে গলা বাড়িয়েছিল। কিন্তু সূর্য তো শক্তি হারিয়ে তাপ ছড়ানো তখন বন্ধ রেখেছে। কাঠবরফের সেই জায়গাগুলো তাই গলা উঁচানো অবস্থায় ফের জমতে থাকে। জমতে জমতে তারা পাহাড়পর্বত আর টিলা হয়ে যায়।

ওদিকে অন্ধকারের তখন নিজেকে হালকা লাগছে খুব। তার শরীরে জমে থাকা কাঠবরফ গলে সমুদ্র হয়ে গেছে। হালকা শরীরে আরাম করে শুয়ে থাকে সে।

ক্লান্ত সূর্য ভাবে, এর আবার কী হলো! আবার এর গায়ে বরফ জমছে নাকি? সূর্যের আলো তাই আলতো করে স্পর্শ করে অন্ধকারকে।

তখনও অন্ধকারের এখানেসেখানে ছড়িয়েছিটিয়ে কাঠবরফ লেগে আছে। আলোর ছটায় তার কাঠ-কাঠ গা আবারও কেঁপে ওঠে। হালকা হালকা শাল বের হয় গায়ের ভেতর থেকে। সূর্যের তাপে সেই হালকা হালকা শালগুলো আবার সবুজ ডগা হয়ে যায়।

ওই সবুজ ডগাগুলোর কোনওটা একদিন গাছ হয়ে যায়। কোনওটা হয় লতাপাতা। কোনওটা আবার হয় গুল্মলতা। আলোর ছোঁয়ায় তার কুঁজের মতো কাঠবরফ গায়ের ফাটলধরা বিভিন্ন জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে নদীর ধারা।

এর মধ্যে অন্ধকারের ক্লান্তি কেটে গেছে। দিব্যি টের পায় সে, সূর্যের তাপ গায়ে এসে লাগছে। রাগের চোটে গা-ঝাড়া দেয় সে। গা জুড়ে তখন সমুদ্রের জল থৈ থৈ করে ওঠে।

ও রে বাবা, এ আবার কী! বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভয় হয় অন্ধকারের। থাবাটা গুটিয়ে নেয় সে। আবারও তাকায় ভয়ে ভয়ে। সূর্যটা সমুদ্রের ওই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেটার গায়ে থাবা বসাতে হলে সমুদ্র পেরুতে হবে।

অতএব অন্ধকারের সব রাগ গিয়ে পড়ে ওই নদীদের ওপরে। নদীদের পিছু ধাওয়া করে সে। ভয়ে দিশেহারা নদীরা পাহাড় বেয়ে, পর্বত ডিঙিয়ে পালানোর চেষ্টা করে।

কিন্তু পালাতে পারে না নদী। কেননা পাহাড়পর্বত বনবনানী সবখানেই একটু না একটু অন্ধকার ছড়িয়ে আছে। নদী তাই রওনা হয় সমতলের দিকে। কিন্তু সমতলে এসে নদীরা আরও দিশেহারা হয়ে পড়ে। কোথাও পালানোর পথ খুঁজে পায় না। চিৎকার করতে করতে অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তারা।

দূরের আকাশ থেকে সূর্য নদীদের পালাতে দেখে। ভেঙেচুরে ছড়িয়ে পড়তে দেখে। মায়া হয় তার।

চিৎকার করে বলে ওঠে সূর্য, পালাও- পালাও, পালিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে যাও। সমুদ্রের সঙ্গে থাকলে অন্ধকার তোমাদের কোনও কিছু করতে পারবে না।

তা শুনে নদীরা ভাবে, সূর্য তো ঠিকই বলেছে। একেবেকে সমুদ্রের দিকে ছুটতে থাকে তারা।

নদীর পিছু পিছু ধাওয়া করে সমুদ্রের কাছে আসতেই অন্ধকার ভয় পেয়ে যায়। তারপর দূরে সরে যায়। সমুদ্রের ওপার থেকে ভীতুর ডিম অন্ধকারের এই অবস্থা দেখে হেসে ফেলে সূর্য। তার সেই হাসিতে ছড়িয়ে পড়ে দিনের আলো।

হাসতে হাসতে সূর্য আবারও ভাবে, একটু একটু করে তাপ ছড়িয়ে সমুদ্রের জল শুকাবে। কিন্তু অত জল শুষে নেবে কেমন করে? একটু পরেই আবার সে হাঁপাতে থাকে। শুষে নেয়া জলের বাষ্প সূর্যের পেটের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে।

জলের বাষ্পের সেই ঘুর্ণি একসময় আর সূর্যের সহ্য হয় না। পেটের মধ্যে থেকে বাষ্প বের করে দেয় সে। তখন পৃথিবীতে বৃষ্টি হতে থাকে। জলের বাষ্প বেশি থাকলে হয় ঝোড়োবৃষ্টি। কম থাকলে হয় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বৃষ্টির চোটে ডোবায় জল উপচে ওঠে, জল উপচে ওঠে নদীর দুই কিনারে।

ওদিকে সমুদ্রের ভয়ে দূরে চলে যাওয়া অহংকারী অন্ধকার খানিক বাদে আবারও প্রচ- রাগে ফুঁসতে থাকে। ফের নদীর পিছু পিছু ধাওয়া করে সে।

অন্ধকার এইভাবে পিছু ধাওয়া করে বলেই পৃথিবীতে রাত নেমে আসে। সারা রাত নদীর পিছু পিছু ধাওয়া করে সে। একসময় মুখোমুখি হয় সমুদ্রের। তাকে দেখেই ভয়ে পালায় অন্ধকার।

তখন পৃথিবীতে দিন নেমে আসে। সূর্যও ফের আলো ছড়াতে থাকে সমুদ্রকে শুষে নিতে। কিন্তু একসময় হয়রান হয়ে হাঁপাতে থাকে।

ওদিকে অন্ধকার খানিকক্ষণ লুকিয়ে থাকে। তারপর আবারও রাগেক্ষোভে একসময় নদীর পিছু ধাওয়া করে। পৃথিবীতে রাত নেমে আসে।

আর নদীও সমুদ্রের দিকে ছুটতে থাকে। ছুটতে থাকে। অন্ধকারে কান পাতলেই তাই শোনা যায় নদীর ছুটে চলার শোঁ শোঁ শব্দ ...

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা